‘মিস্টার দশ পার্সেন্ট’
পক্ষকাল সংবাদ ডেস্ক_
সরকারের গত দুই মেয়াদে পিরোজপুরে প্রকৌশল বিভাগ, গণপূর্ত, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগে যেসব কাজ হয়েছে; তার প্রতিটি কাজ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন নিয়েছেন পিরোজপুর-১ আসনের সরকার দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য একেএমএ আউয়াল। এমনকি সরকারিভাবে দুর্যোগ প্রবণ এলাকা ইন্দুরকানি ও মঠবাড়িয়ায় চারটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের সময়ও আউয়াল নগদ ৮০ লাখ টাকা ও ২ হাজার ডলার নিয়েছেন। তার দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে অনুসন্ধান করে এসব তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আউয়ালের সম্পদের অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশন, উপ কর কমিশনারের কার্যালয় (পিরোজপুর), একাধিক ব্যাংকসহ ৩০টি প্রতিষ্ঠানের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুদকের উপপরিচালক মো. আলী আকবর।
পিরোজপুরে ‘মিস্টার টেন পার্সেন্ট’ নামে পরিচিত আউয়ালের পাশাপাশি তার স্ত্রী লায়লা পারভীন ও বড় ছেলে আবদুর রহমানের বিরুদ্ধেও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পেয়েছে দুদক।
তবে এসব অভিযোগকে পাত্তা দেন না সাবেক সংসদ সদস্য আউয়াল। দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে একেএমএ আউয়াল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা সুনাম ক্ষুণ্ন করতেই অভিযোগ দিয়েছে। এটাই বাস্তবতা। তবে দুদকের এখানে কোনও উদ্দেশ্য আছে বলে মনে করি না।’ দুদক তাকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে জানিয়ে আউয়াল বলেন, ‘আমি আমার বক্তব্য দিয়েছি। তারা খতিয়ে দেখছে। এখনও সম্পদ বিবরণী চায়নি। সম্পদ বিবরণী চাইলে জমা দেবো।’
জানা গেছে, ২০১৭ সালের জুন মাসে আউয়ালের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, সরকারি অর্থ ও সম্পদ আত্মসাতের অভিযোগ জমা হয় দুদকে। পরে এ বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। আর এ বছরের ১৯ মে আউয়ালকে সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সম্পদ বিবরণী দাখিল ও হাজির হওয়ার জন্য নোটিশ পাঠান দুদকের উপপরিচালক (বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-২) সৈয়দ আহমেদ। ওই নোটিশে তাকে ২৩ মে হাজির হতে বলা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রথম দফায় হাজির না হওয়ায় দ্বিতীয় দফায় গত ১৯ জুন আবারও নোটিশ পাঠিয়ে ২৭ জুন আউয়ালকে দুদকে হাজির হতে বলা হয়। দ্বিতীয় দফা নোটিশে দুদকে হাজির হয়ে বক্তব্য দিয়েছেন আউয়াল। তবে সেই বক্তব্যে সন্তুষ্ট হতে পারেনি দুদক।
এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য। বলেন, ‘অনুসন্ধান শেষ হয়নি। বিস্তারিত বলার সময় হয়নি এখনও।’
আউয়ালের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে প্রথমে নিয়োগ পেয়েছিলেন দুদকের উপপরিচালক সৈয়দ আহমেদ। সম্প্রতি তিনি অবসরে গেছেন। পরে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান দুদকের উপপরিচালক মো. আলী আকবর।
দুদকের নির্ভরযোগ্য ঊর্ধ্বতন সূত্র জানায়, সাবেক সংসদ সদস্য আউয়াল দুদকে গিয়ে বক্তব্য দিলেও সার্বিকভাবে দুদককে খুব বেশি সহযোগিতা করেননি তিনি।
এরপর গত ২৪ অক্টোবর আউয়ালের হালনাগাদ রিটার্নের তথ্য চেয়ে পিরোজপুরে উপ কর কমিশনারের কার্যালয়ে (সার্কেল-৬) দুদক থেকে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিটি পাঠান অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক মো. আলী আকবর। ১১ নভেম্বরের মধ্যে হালনাগাদ রিটার্নের তথ্য দুদকে পাঠানোর অনুরোধ জানান তিনি। একই দিনে আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনের সচিবের কাছেও চিঠি পাঠায় দুদক। ওই চিঠিতে বলা হয়- ‘সাবেক সংসদ সদস্য আউয়াল বিগত সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সময় নির্বাচনি হলফনামার সঙ্গে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিল করেছেন। অনুসন্ধানের স্বার্থে ওই সম্পদ বিবরণীর সত্যায়িত ফটোকপি ৪ নভেম্বরের মধ্যে দুদকে পাঠানোর অনুরোধ করা হলো।’ তবে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও নির্বাচন কমিশন ও উপ কর কমিশনারের কার্যালয় দুদকে তথ্য পাঠায়নি।
দুদক জানায়, গত ২৪ অক্টোবর থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত ৩০টি প্রতিষ্ঠানের কাছে চিঠি পাঠিয়ে আউয়ালের সম্পদের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে। তথ্য পাঠানোর জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এক মাসের টার্গেট নিয়ে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে আউয়ালের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ পেয়েছে দুদক:
১. মেসার্স বুশরা এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স সুভাষ এন্টারপ্রাইজ নামে দু’টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আউয়াল ও তার পরিবারের সদস্যরা পিরোজপুরে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করেন।
২. সরকার প্রকৌশল বিভাগ, গণপূর্ত, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করেন আউয়াল ও তার পরিবারের সদস্যরা।
৩. প্রতিটি ঠিকাদারি কাজে আউয়াল ও তার পরিবারের সদস্যদের দিতে হয় ১০ শতাংশ কমিশন।
৪. আউয়ালের দুই মেয়াদে পিরোজপুরে ৭৬৪ জন পুলিশ সদস্য নিয়োগ হয়েছে। ওই নিয়োগে বাণিজ্য করেছেন আউয়াল ও তার পরিবারের সদস্যরা।
৫. প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় আড়াই হাজার জনবল নিয়োগেও বাণিজ্য করেছেন তারা।
৬. প্রাথমিকে ৩২৪ জন দফতরি কাম নৈশ প্রহরী নিয়োগেও নেওয়া হয়েছে উৎকোচ।
৭. আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের কমিটি গঠনে করা হয়েছে পদ বাণিজ্য।
৮. চাহিদা মতো টাকা না দেওয়ায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ায় ভূমিকা রেখেছেন আউয়াল ও তার পরিবারের সদস্যরা।
৯. বেকুটিয়া ফেরিঘাট ও বলেশ্বর সেতুর টোল আদায়।
১০. চারটি কার্গোর মালিক আউয়াল ও তার পরিবারের সদস্যরা। এরমধ্যে দু’টির লাইসেন্স নেই।
১১. এক ডজনেরও বেশি বাড়ি দখল ও জোর করে লিখে নেওয়া।
১২. ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে (১৫টি ইউনিয়ন) দলীয় প্রার্থীর বাইরে বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থন ও তাদের কাছ থেকে উৎকোচ নেওয়া।
১৩. ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সুধাংশু শেখর হালদারকে পরাজিত করতে মানবতাবিরোধী অপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষ নেন আউয়াল। বিনিময়ে একটি প্রাইভেট কার এবং নগদ ২০ লাখ টাকা উৎকোচ পান তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন আউয়াল। ২০১৪ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয় দফা নির্বাচিত হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দলীয় নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। পিরোজপুর আওয়ামী লীগের বড় অংশই আউয়ালের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এ কারণে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি তিনি।
সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
এন এইচ, ১৪ নভেম্বর