রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০১৯
প্রথম পাতা » অপরাধ | অর্থনীতি | রাজনীতি » পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রবাসী নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তার দাবিতে প্রগতিশীল নারী সংগঠনের স্মারকলিপি পেশ
পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রবাসী নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তার দাবিতে প্রগতিশীল নারী সংগঠনের স্মারকলিপি পেশ
পক্ষকাল সংবাদ -
সৌদি আরবে নারী গৃহশ্রমিক নির্যাতন-ধর্ষণ-হত্যা বন্ধ ও প্রবাসী নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে প্রগতিশীল নারী সংগঠনসমূহ (সিপিবি নারী সেল, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম, শ্রমজীবী নারী মৈত্রী, বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্র, নারী সংহতি, বিপ্লবী নারী ফোরাম, হিল উইমেন্স ফেডারেশন) এর উদ্যোগে আজ ১৭ নভেম্বর ২০১৯ সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সমাবেশ ও মিছিল করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ করা হয়। সিপিবি নারী সেলের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক লক্ষ্মী চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে এবং সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শম্পা বসুর পরিচালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন শ্রমজীবী নারী মৈত্রীর সভাপতি বহ্নিশিখা জামালী, বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত, নারী সংহতির কেন্দ্রীয় নেত্রী সুলেখা রহমান, বিপ্লবী নারী ফোরামের আহ্বায়ক আমেনা আক্তার, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নেত্রী নীতি চাকমা।
সমাবেশে বক্তাগণ বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবে নারী গৃহশ্রমিকদের দুঃসহ জীবন ও লাশ হয়ে দেশে ফেরার ঘটনা দেশবাসীকে ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। এবছর জানুয়ারি থেকে মধ্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই সাড়ে ৮মাসে ৮৫০জন নারী সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। এর মধ্যে আগস্ট মাসের ১ দিনেই ১০৯ জন ফিরেছেন। এদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এরা প্রায় প্রত্যেকেই শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার। তাদের ভাষ্য মতে, সৌদি আরবে ৩০ থেকে ৪০ সদস্যের এক একটি পরিবার। ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাজ করতে হয় গভীর রাতেও কাজ শেষ হয় না। ঘরে পর্যাপ্ত খাবার থাকার পরও এরা গৃহশ্রমিকদের খেতে দেয় না। কথায় কথায় মারধর করে। অনেক সময় বেধে রেখে মারধর করে। যে বাসায় সে কাজ করে ঐ বাসার সব পুরুষই যৌন নিপীড়ন করে। এমনকি ৯/১১ বছরের ছেলেও যৌন নিপীড়ন করে। সৌদি আরবে গৃহশ্রমিককে দাসী মনে করে। গৃহশ্রমিককে অত্যাচার করা যায়, ধর্ষণ করা যায়, এমনকি হত্যাও করা যায়। গৃহশ্রমিকদের জীবন আছে, মর্যাদাবোধ আছে ওরা সেটা মনে করে না।
বক্তাগণ বলেন, নির্যাতনের অভিযোগে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন সৌদিতে গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিলে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে সৌদি আরব। এরপর থেকে গত জুলাই মাস পর্যন্ত ৩ লাখ নারী কর্মী গেছেন সৌদি আরবে। দুই বছরের চুক্তিতে যাওয়া নারী গৃহকর্মীরা মাসে বেতন পান বাংলাদেশী টাকায় মাত্র ১৭ হাজার টাকা। চুক্তি অনুযায়ী গৃহকর্মীদের বিনা খরচে সৌদি আরব যাওয়ার কথা; কিন্তু দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ১০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা লেগে যায় সৌদি আরব যেতে। ওখানে যেয়ে যে কাজ পাওয়ার কথা অনেক সময় তাকে সে কাজ দেওয়া হয় না। বাংলাদেশের দরিদ্র, প্রান্তিক, সরল, শিক্ষাবঞ্চিত নারীরা ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর আশায় বিদেশে যান কাজ করতে। কিন্তু পদে পদেই তাদের উপর নেমে আসে নির্যাতন। প্রবাসী শ্রমিকরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তারা বিদেশে কাজ করতে যেয়ে লাশ হয়ে ফিরছেন, নির্যাতন সইতে না পেরে সব খুইয়ে দেশে ফিরে আসছেন আর আমাদের সরকার প্রবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলেও রেমিটেন্সের গল্প শোনাচ্ছেন। দেশে রেমিটেন্স পাঠনো এই শ্রমিকদের নিরাপত্তায় সরকার কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। প্রবাসী কল্যাণ সংস্থা ও প্রবাসে দূতাবাসগুলো তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না। এসকল অনিয়ম ও দায়িত্বে অবহেলার বিচার যদি হতো তাহলে শত শত গৃহশ্রমিককে লাশ হয়ে ফিরতে হতো না।
এ প্রেক্ষিতে জাতীয় প্রেসক্লাবে সমাবেশ শেষে মিছিল করে প্রগতিশীল নারী সংগঠনসমূহের পক্ষ থেকে নি¤œাক্ত দাবিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ করা হয়।
ক) অনতিবিলম্বে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশে নারী গৃহকর্মীসহ অভিবাসী নারী শ্রমিক পাঠানো হয়েছে তাদের প্রয়োজনীয় আইনী সুরক্ষা, নিরাপত্তা নিশ্চিত, শ্রম আইন ও বিধি অনুযায়ী উপযুক্ত মজুরী আদায়ে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
খ) অভিবাসী নারী গৃহকর্মী ও শ্রমিকদের শারীরিক মানসিক অত্যাচার ও যৌন নির্যাতন বন্ধে বাংলাদেশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের মধ্যে প্রয়োজনীয় দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর ও তার দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
গ) প্রবাসী গৃহকর্মী ও নারী শ্রমিকদের উপর সংঘটিত শারীরিক-মানসিক ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা ও তথ্য জানার পরও দুতাবাস ও কনস্যুলেট যে চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে এসেছে সে ব্যাপারে অনতিবিলম্বে তদন্ত কমিটি গঠন, দায়ী কর্মকর্তাদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের উদ্যোগ নিতে হবে।
ঘ) অভিবাসী নারী গৃহকর্মী ও শ্রমিকেরা যেসব দেশে কর্মরত রয়েছেন সেসব দেশের নিয়োগকর্তাদের নাম, বাড়ী ও কর্মস্থলের বিস্তারিত ঠিকানা, অভিবাসী নারী শ্রমিকদের হালনাগাদ সকল তথ্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইটে হালনাগাদ থাকা নিশ্চিত করতে হবে। সৌদিআরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দুতাবাস ও কনস্যুলেটে অভিবাসী গৃহকর্মী ও নারীশ্রমিকদের অধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সার্বক্ষণিক ডেস্ক চালু করতে হবে। এই ব্যাপারে দুতাবাসের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব ও জবাবদিহীতা নিশ্চিত করতে হবে।
ঙ) বাংলাদেশের যেসকল রিক্রুটিং এজেন্টদের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে নারী গৃহকর্মী ও শ্রমিকদেরকে পাঠানো হয় তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য, কি চুক্তি ও শর্তে নারী গৃহকর্মী ও শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানো হচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্যাবলী আবশ্যিকভাবে মন্ত্রণালয়ে থাকতে হবে। প্রতারক, রিক্রুটিং এজেন্টদের লাইসেন্স বাতিলসহ তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতারিত নারী শ্রমিকদেরকে প্রয়োজনীয় ক্ষতিপুরণ প্রদানে এসকল রিক্রুটিং এজেন্সিকে বাধ্য করতে হবে।
চ) কর্মস্থলে আত্মহত্যা, নিহত হওয়া এবং যৌন নিপীড়নসহ শারীরিক মানসিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে অভিবাসী শ্রমিক ও তার পরিবার এবং প্রয়োজনে দুতাবাস ও কনস্যুলেট বাদী হয়ে যাতে সংশ্লিষ্ট নিয়োগকর্তা বা কোম্পানীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। দেশে ফেরত আসা নারী শ্রমিকরাও যাতে তাদের বকেয়া মজুরীসহ তাদের উপর সংগঠিত অপরাধের বিচার পেতে পারে সে ব্যাপারে দ্বি-পাক্ষিক চুক্তিসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
ছ) গৃহকর্মীসহ অভিবাসী যেসব নারী দেশে ফিরে এসেছেন তাদের আর্থিক, সামাজিক ও পারিবারিক অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। ফেরত আসা নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
জ) সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারী গৃহকর্মীসহ অভিবাসী শ্রমিকদের উপরোক্ত ন্যায্য ও যৌক্তিক আইনী সুরক্ষা ও নিরাপত্তা ন্যূনতম মাত্রায় নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সৌদিআরবসহ এসকল দেশে নারী গৃহশ্রমিক পাঠানো বন্ধ রাখতে হবে।
ঝ) সৌদি আরবসহ প্রবাসে ধর্ষণ, নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হয়ে যেসকল নারীরা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের প্রত্যেক পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।