মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর ২০১৯
প্রথম পাতা » জেলার খবর » মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলেন রাণীনগরের ১০ বীরাঙ্গনা
মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলেন রাণীনগরের ১০ বীরাঙ্গনা
লাল সালাম মা
পক্ষকাল ডেস্ক-
এই ১০ বীরাঙ্গনার ৪ জন ইতোমধ্যেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আর বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অনটন আর অসুস্থতার মধ্যেই চলছে বাকি ৬ জনের জীবন সংগ্রাম
স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর অবশেষে মুক্তিযোদ্ধার সম্মাননা পেলেন নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের আতাইকুলা পালপাড়া গ্রামের ১০ বীরাঙ্গনা নারী। এই ১০ বীরাঙ্গনার ৪ জন ইতোমধ্যেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আর বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে বেঁচে আছেন বাকী ৬ জন।
সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয় একটি গেজেটের মাধ্যমে তাদের নাম প্রকাশ করে। এরমাধ্যমেই মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ও সকল সুযোগ-সুবিধা পেতে যাচ্ছেন এসব নারী ও তাদের পরিবারবর্গ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১০ বীরাঙ্গনার মধ্যে বানী রানী পাল, ক্ষান্ত রানী পাল, রেনু বালা ও সুষমা সূত্রধর রোগাক্রান্ত হয়ে অভাব-অনটনের সংসারে উন্নত চিকিৎসার অভাবে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। অন্যদিকে জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছেন মায়া রানী সূত্রধর, রাশমনি সূত্রধর, সন্ধ্যা রানী পাল, কালীদাসী পাল, সন্ধ্যা রানী ও গীতা রানী পাল। একাত্তরের সেই দুর্বিসহ যন্ত্রণা ও সামাজিক বঞ্চনার পাশাপাশি দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অনটন আর অসুস্থতার মধ্যেই চলছে তাদের জীবন সংগ্রাম।
রাণীনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে নওগাঁর ছোট যমুনা নদীর তীরে ছায়াঘেরা শান্ত আতাইকুলা পালপাড়া গ্রাম। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী স্থানীয় রাজাকার ও আলবদরদের সহযোগিতায় সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের ওপর নির্যাতন চালায়। তখন পাকবাহিনী গণহত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটসহ ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ওই দিন পাক বাহিনী “জয়বাংলা বলতে হ্যায় নৌকামে ভোট দিতে হ্যায়” বলে গোবিন্দ চরণ পাল, সুরেশ্বর পাল, বিক্ষয় সূত্রধর, নিবারণ পালসহ ৫২ জন মুক্তিকামী জনতাকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। এ সময় নারীরা স্বামী সন্তানকে বাঁচানোর জন্য আকুতি জানিয়েও পাকিস্তানি বাহিনীর মন গলাতে পারেননি। উল্টো পাক-জান্তারা নারীদের ওপর চালায় পাশবিক নির্যাতন।
বীরাঙ্গনা কালী দাসী পাল (৭৫) বলেন, ওই দিন সকালে যখন আমাদের গ্রামে পাঞ্জাবি (পাকিস্তানি সেনা) আসে তখন আমরা স্বামীসহ বাড়ির দরজা লাগিয়ে আত্মগোপনের চেষ্টা করি। কিন্তু স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় গেটের দরজা ভেঙ্গে আমার স্বামীকে টেনে হিঁচড়ে পাঞ্জাবিরা রাইফেল দিয়ে মারতে মারতে যোগেন্দ্রনাথের বারান্দায় ফেলে রাখে। স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাইতে গিয়ে আমার কথা না শুনে চোখের সামনে আমার স্বামীসহ ৫২ জনকে হত্যা করে উল্টো আমার উপরও তারা নানা কায়দায় নির্যাতন চালায়। আমার এক ছেলে আছে। অভাবের সংসারে সে দিন মজুরের কাজ করে। আমি ও পেটের তাগিদে কখনও ধান কুড়িয়ে, বয়লারের চাতালে কাজ করে, কিংবা অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করে দু’মুঠো ডাল ভাত খেয়ে কোনো মতো বেঁচে আছি। ভেবেছিলাম বেঁচে থাকতে আর মনে হয় স্বীকৃতি পাবো না। তবে অবশেষে এই স্বীকৃতি পেয়ে আমি অনেক খুশি। এই সরকারকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
বীরাঙ্গনা সন্ধ্যা রাণী পাল (৭০) বলেন, ওই দিন সকাল নয়টার দিকে পাঞ্জাবিরা আমার স্বামী বাড়িতে কাজ করা অবস্থায় সুরেশ্বর পালের বাড়িতে ধরে নিয়ে লাইন করে রাখে এই দিকে পাঞ্জাবিরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লুটপাট ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগসহ নানা ধরনের নির্যাতন চালায়। আমি ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে পাশের বাড়ির এক বড় মাটির ডাবরের (পাত্র) ভেতর আশ্রয় গ্রহণ করি। বাচ্চার কান্না পাঞ্জাবিরা শুনতে পেয়ে আমাকে সেখান থেকে বের হওয়ার কথা বলে। তখন আমি পালিয়ে মাঠের মধ্যে দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাক-বাহিনীরা এই গ্রামের মেয়েদের সাথে অনেক খারাপ আচরণ করেছে। আমাদেরকে অবশেষে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনেক ধন্যবাদ। স্বামী হারানোর পর থেকে ৪৭টি বছর অভাব-অনটনের মধ্যে জীবন কাটালাম। তাই স্বীকৃতির পাশাপাশি সকল সুযোগ-সুবিধা যদি দ্রুত আমাদেরকে দেওয়া হতো তাহলে যে কদিন বাঁচি তা ভোগ করে যেতে পারতাম।
রাণীনগর উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অ্যাডভোটেক ইসমাইল হোসেন বলেন, “অনেক চেষ্টার পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার অবশেষে আতাইকুলাগ্রামের ১০বীরঙ্গনাকে স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে নাম গেজেটভুক্ত করেছেন। এই স্বীকৃতিপ্রাপ্তির সকল প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই সম্পন্ন করা হয়েছে। বরাদ্দ এলেই আগামী বিজয় দিবসে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদের হাতে সম্মাননা তুলে দেওয়া হবে বলে আমি আশা করছি।”
নওগাঁ-৬ (আত্রাই-রাণীনগর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো. ইসরাফিল আলম বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার ও বীরাঙ্গনাদের ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক। অবশেষে আমাদের সবার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আতাইকুলা পালপাড়া গ্রামের এই নারীরা মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা পেয়েছে। এটি আমাদের অনেক বড় একটি সফলতা। আমার খুব ভালো লাগছে। যে কয়জন এখনও বেঁচে আছেন, তারা অন্তত তাদের ন্যায্য প্রাপ্যটুকু একটু হলেও ভোগ করতে পারবেন। আর স্বীকৃতি নিয়ে সমাজে বেঁচে থাকতে পারবেন।”
বাংলা ট্রিবিউন