সোমবার, ৯ ডিসেম্বর ২০১৯
প্রথম পাতা » অপরাধ | ব্রেকিং নিউজ | শিক্ষা ও ক্যারিয়ার » মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম-প্রশিক্ষণ প্রকল্পে লুট ৯৬ কোটি
মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম-প্রশিক্ষণ প্রকল্পে লুট ৯৬ কোটি
পক্ষকাল সংবাদ-
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন ও তথ্যপ্রযুক্তিতে শিক্ষকদের দক্ষ করার প্রকল্পে বিভিন্ন খাতের প্রায় ৯৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে। বিগত অর্থবছরে দুই ধরনের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন এবং ওই প্রশিক্ষণসামগ্রী কেনাকাটায় অনিয়মের এ অভিযোগ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা পড়ে।
এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) একদফা তদন্ত করে। পরে ব্যয়ভিত্তিক অনিয়ম-দুর্নীতি ও অর্থ লুটপাটের চিত্র বের করতে আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়। প্রথম কমিটি এরই মধ্যে প্রতিবেদন দিয়েছে। যুগান্তর’র এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়নাধীন ‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন (দ্বিতীয় পর্যায়)’ শীর্ষক ওই প্রকল্পে দুই ধরনের প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হয়। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রায় ২৮ কোটি টাকা ছাড় করা হয়। এসব শিক্ষককে প্রশিক্ষণের জন্য আবার প্রশিক্ষক তৈরির প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হয়। এ খাতের জন্য বরাদ্দ ছিল প্রায় ৬৭ কোটি টাকা। এ দুই ধরনের প্রশিক্ষণের জন্য প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টাকার বিভিন্ন সামগ্রী কেনাকাটা করা হয়। এ তিন খাতের অর্থ ব্যয়ে পরতে পরতে সরকারি নিয়মনীতি লঙ্ঘন ও অনিয়ম করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সবচেয়ে বড় অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন খাতের টাকা প্রশিক্ষণ খাতে একীভূত করে একত্রে ছাড় করার প্রক্রিয়ায়। প্রশিক্ষণ খাতে অগ্রিম অর্থ উত্তোলনে প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) ক্ষমতা ৩০ লাখ টাকা। কিন্তু ৯৬ কোটি টাকা অগ্রিম তোলার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুমোদন নেয়া হয়নি। সূত্র বলছে, মাউশির তদন্তে বেশকিছু অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এ প্রসঙ্গে পিডি অধ্যাপক ড. আবদুস সবুর খান বলেন, ‘প্রকল্পের আর্থিক ব্যয়, অর্থ ছাড়, প্রশিক্ষণ ও কেনাকাটা সবই বিস্তারিত প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) মেনে সম্পন্ন করা হয়েছে। কোনো অনিয়ম ও অর্থের নয়ছয় করা হয়নি। যেহেতু এসব বিষয় তদন্ত চলছে তাই বিস্তারিত কথা বলতে চাচ্ছি না।’
অভিযোগ রয়েছে, প্রশিক্ষণ সামগ্রী কেনাকাটায় অনিয়ম হয়েছে। কোটেশন ছাড়া প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল ও সার্টিফিকেট ছাপানো হয়। প্রশিক্ষণের উপকরণ ও পরিবহন ব্যয় সরবরাহের ক্ষেত্রে পিপিআর (সরকারি ক্রয় বিধিমালা) অনুসরণ করা হয়নি। প্রকল্প থেকে সরবরাহ করা হয় উপকরণসামগ্রী। কিন্তু এর বিল পরিশোধ করা হয় প্রশিক্ষণ ভেন্যু থেকে। বিষয়টি জুনে কুমিল্লা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষের পাঠানো এক চিঠি থেকে জানা গেছে। ওই চিঠিতে সরকারি আরেক পত্রের রেফারেন্স দিয়ে বলা হয়, এভাবে অর্থ পরিশোধ করা যায় না।
জানা গেছে, দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো টেন্ডার প্রক্রিয়া ছাড়া প্রায় ১ কোটি ১৬ লাখ টাকা মূল্যের বই ও সার্টিফিকেট ছাপানো হয়। আরো প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ টাকার প্রশিক্ষণ উপকরণ এবং প্রায় ৫৩ লাখ টাকার পুরস্কারসামগ্রী টেন্ডার কোটেশন ছাড়া কেনা হয়েছে। এরপর এসব উপকরণ প্রশিক্ষণ ভেন্যুতে পাঠাতে পরিবহন ব্যয়ের প্রায় ২৪ লাখ টাকাও ছাড় করা হয়। প্রকল্প দপ্তর এসব কর্ম করলেও তা ব্যয়ের অর্থ পাঠানো হয় প্রশিক্ষণ ভেন্যুতে। এরপর তা একটি বেসরকারি হিসাবের মাধ্যমে প্রকল্প কার্যালয়ে ফেরত আনা হয়।
এ বিষয়ে পিডি জানান, এ খাতের ব্যয় নিয়ম মেনে করা হয়েছে। বেসরকারি হিসাবের মাধ্যমে কোনো অর্থ ফেরত আনা হয়নি। কয়েক খাতের টাকা এক খাতে আনার বিধান অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী করা যায়। না জেনে অভিযোগ করা হচ্ছে।
বেসিক টিচার ট্রেনিং (বিটিটি) ও প্রতিষ্ঠান প্রধান ট্রেনিংয়ের (এইচআইটি) ১ হাজার ১৮৯টি ব্যাচের ভেন্যু চার্জ, রুম চার্জ, ইন্টারনেট বিল ও বিবিধ খাতের ১৯ কোটি টাকা বিল ভাউচার দেখানো হয়েছে। ওই অর্থ বাস্তবে ব্যয় হয়েছে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এছাড়া ইন-হাউজ ট্রেনিং কোর্সে ইন্টারনেট বিল বাবদ আরো ১ কোটি ৭৭ লাখ ৮১ হাজার টাকা ব্যয় নিয়েও সন্দেহ আছে।
৬ দিনের এই ইন-হাউজ ট্রেনিং কোর্সের জন্য ছাড় করা হয়েছে ২৭ কোটি ৮৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। এ ট্রেনিং শুরু হয় জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে। অথচ ওই কোর্সের ১ লাখ ২০ হাজার ম্যানুয়াল এবং সমসংখ্যক সার্টিফিকেট ছাপানোর জন্য ২টি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়া হয় ১৭ জুন। ফলে প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল ছাড়াই প্রশিক্ষণ শেষ করেন। আবার ৬ দিনের ইন-হাউজ ট্রেনিং হলেও কোথাও ৩ দিনে, আবার কোথাও আধাবেলা করে ৪ থেকে ৬ দিনে নামেমাত্র হয়েছে বলে অভিযোগ এসেছে।
প্রশিক্ষণ কোর্সের ভেন্যু চার্জ, জনপ্রতি রুমচার্জ ও প্রতি ব্যাচের ইন্টারনেট বিল এবং প্রতি কোর্সের বিবিধ বিলসহ ১৯ কোটি টাকার শতভাগ খরচ দেখানো হয়েছে। অথচ প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয় সরকারি প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভেন্যু চার্জ বা রুম চার্জের টাকা খরচের সংস্থান নেই।
এছাড়া প্রশিক্ষণ কোর্সের সমাপনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি এবং প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর উপস্থিত না থাকলেও প্রতিটি কোর্সের সম্মানী নিয়েছেন। প্রশিক্ষণে না থাকলেও প্রকল্প কর্মকর্তাদের ১ কোটি টাকার বেশি সম্মানী দেয়া হয়েছে। এভাবে দুই ধরনের প্রশিক্ষণে অর্থ নয়ছয় হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়াও প্রকল্প দপ্তরের গাড়ির জ্বালানি, মেরামত, আপ্যায়ন, স্টেশনারি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নগদ কেনাকাটা এবং কোটেশনে নিয়ম লঙ্ঘন, ব্যয়ের সীমা অতিক্রম এবং সরকারি বিধিবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে।
এসব বিষয়ে পিডি বলেন, ‘আমার হাতে কোনো নথিপত্র নেই। সংশ্লিষ্ট অফিসার অফিসে নেই। তাই এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারছি না। আমার কোনো কিছু মুখস্থ নেই। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তদন্ত চলছে। তদন্তাধীন বিষয়ে কথা বলতে পারব না। তবে কোনো কাজই ডিপিপির বাইরে করিনি। অতিথিরা অনুষ্ঠানে গিয়েই সম্মানী নিয়েছেন।’
প্রকল্প দপ্তরে ফেরত আনা বা ভাগবাটোয়ারার অভিযোগ সঠিক নয় বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘সাবেক একজন পিডি রহস্যজনক কারণে এ প্রকল্পের সবকিছু নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছেন। অথচ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওই কর্মকর্তাকে এ প্রকল্প থেকে সরিয়ে প্রায় দেড় বছর ধরে ওএসডি করে রাখা হয়েছে।’ ওই কর্মকর্তার এর আগে ‘ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রেনিং সেন্টার’ স্থাপন প্রকল্পে কর্মরত ছিলেন। সেটি তদন্তের জন্য তিনি সরকারের সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানান।
২০১৫ সালে এ প্রকল্প শুরু হয়। দেড় বছর কোনো পিডিই নিযুক্ত করা হয়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে অধ্যাপক জসিমউদ্দিনকে পিডি নিয়োগ করা হয়। কিন্তু নানা অভিযোগে তাকে সরিয়ে ২০১৮ সালের জুনে ওএসডি করা হয়। বর্তমান পিডি গত বছরের সেপ্টেম্বরে যোগ দেন। ২০২০ সালের জুনে শেষ হবে এ প্রকল্পের মেয়াদ। এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৫০ হাজার মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের কথা আছে। অথচ আজ পর্যন্ত একটিও স্থাপন সম্ভব হয়নি।
এ ঘটনায় প্রথম দফায় পরিচালিত তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন মাউশির সদস্য সাবেক পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘যে পদে থেকে তদন্ত কাজ করেছি সেই পদে আমি এখন আর নেই। সম্প্রতি বদলি হয়েছি। তাই বিস্তারিত মন্তব্য করা সমীচীন মনে করছি না। তবে বস্তুনিষ্ট তদন্ত করেছি- এটুকু বলতে পারি।’
তবে এরআগে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রকল্প পরিচালক নিয়ম না মেনে সরকারি অর্থ খরচ করেছেন। সরকারি টাকা কিভাবে খরচ করতে হয়, তা না-জানার কারণে অনিয়ম হয়েছে। প্রকল্প কর্মকর্তা অনভিজ্ঞ। কিন্তু সরকারি বিধিবিধান মানা জরুরি ছিল।’
এ বিষয়ে দ্বিতীয় তদন্ত কমিটির প্রধান ও বর্তমানে মাউশির অপর পরিচালক (প্রশিক্ষণ) অধ্যাপক প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য বলেন, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো কীভাবে অর্থ পেয়েছে, তা কীভাবে ব্যয় করেছে, প্রশিক্ষণসামগ্রী এবং অন্যান্য বিষয়ে তথ্য চেয়ে ২৫ নভেম্বর চিঠি দেয়া হয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে তথ্য পাঠিয়েছে। সব তথ্য পাওয়ার পর প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হবে।