চলে গেলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ
পক্ষকাল সংবাদ-
জীবদ্দশাতেই পরিণত হয়েছেন কিংবদন্তিতে। আজীবন কাজ করেছেন মানুষের কল্যাণে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা। সেই মহিরুহ ব্যক্তিত্ব স্যার ফজলে হাসান আবেদকে হারিয়েছে দেশ। শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)।
ব্রিটিশ সরকারের নাইট উপাধি পাওয়া একমাত্র বাংলাদেশি ফজলে হাসান আবেদ গত ২৯ নভেম্বর হাসপাতালে ভর্তি হন। তিনি মস্তিস্কের টিউমারে ভুগছিলেন। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তিনি এক ছেলে, এক মেয়ে, স্ত্রী এবং অসংখ্য অনুসারী, সুহৃদ, শুভাকাঙ্ক্ষী রেখে গেছেন। যে ক’জন বাংলাদেশির কর্মকাণ্ড বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়েছে, তাদের অন্যতম ফজলে হাসান আবেদ।
শুক্রবার রাত ৯টা ৫ মিনিটে ব্র্যাকের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ ও ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক ডা. মুহাম্মদ মুসা বিবৃতিতে বলেন, ‘গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি স্যার ফজলে হাসান আবেদ, প্রিয় আবেদ ভাই, আর আমাদের মাঝে নেই।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘এই মুহূর্তে, কোনো সমবেদনা বা সান্ত্বনার ভাষাই তাকে হারানোর কষ্ট কমাতে পারবে না। যে কোনো কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে শান্ত থাকা ও এগিয়ে যাবার শিক্ষাই তিনি সবসময় আমাদের দিয়েছেন। জীবনভর যে সাহস আর ধৈর্যের প্রতিচ্ছবি আমরা তার মাঝে দেখেছি, সেই শক্তি নিয়েই আমরা তার স্মৃতির প্রতি যথাযথ সম্মান জানাব।’
ব্র্যাক গ্লোবাল বোর্ডের চেয়ারপারসন আমিরা হক এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, রোববার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ফজলে হাসান আবেদের মরদেহ ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হবে। দুপুর সাড়ে ১২টায় সেখানে তার জানাজা হবে। জানাজার পর ঢাকার বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
স্যার ফজলে হাসানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিপুল অবদান রেখেছেন। দেশের উন্নয়নে তার অবদান জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। প্রধানমন্ত্রী শোকবার্তায় বলেন, তার মতো মানবতাবাদী মানুষের মৃত্যুতে দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তিনি তার বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন স্মরণ করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। শোক জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানসহ মন্ত্রিসভার সদস্য, রাজনীতিক, বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।
স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে ৩৬ বছর বয়সে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন ফজলে হাসান আবেদ। এটি এখন পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এনজিও। ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ওই বছর ব্র্যাকের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন ফজলে হাসান আবেদ। গত আগস্টে এই পদ থেকে অবসরে যান তিনি। এরপর তিনি ব্র্যাকের ইমেরিটাস চেয়ারপারসন নিযুক্ত হন। আমৃত্যু তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কীর্তিমান মানুষ তিনি। পাবনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের পর যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোতে যান নেভাল আর্কিটেকচার পড়তে। তা বাদ দিয়ে লন্ডনের চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউনট্যান্টস থেকে ১৯৬২ সালে প্রফেশনাল কোর্স সম্পন্ন করে দেশে ফেরেন। এরপর শেল অয়েল কোম্পানিতে যোগ দেন।
১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তার জীবনের মোড় পরিবর্তন করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি চাকরি ছেড়ে লন্ডনে চলে যান। সেখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ এবং ‘হেল্প বাংলাদেশ’ নামে দুটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭২ সালে তিনি সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনে কাজ করার উদ্যোগ নেন।
ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার পর লন্ডনের ফ্ল্যাট বিক্রি করে মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণ তৎপরতা শুরু করেন ফজলে হাসান আবেদ। এ কার্যক্রম থেকে ‘বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিস্ট্যান্স কমিটি’ বা ব্র্যাকের যাত্রা শুরু হয়। পরের বছর ত্রাণ তৎপরতার গি পেরিয়ে গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে তার নেতৃত্বে এটি বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্স কমিটি বা ব্র্যাক নামে অভিযাত্রা শুরু করে।
দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামাঞ্চলে এর কার্যক্রম ছড়িয়ে রয়েছে। তাই ফজলে হাসান আবেদকে গ্রামবাংলার পালাবদলের স্বপ্নদ্রষ্টা বলা হয়। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার মাধ্যমে ব্র্যাক নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। শিক্ষা খাতেও রেখেছে বিশেষ অবদান। বিশ্বের ১১টি দেশে ব্র্যাক ১০ কোটিরও বেশি মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছে।
দারিদ্র্য বিমোচনে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ফজলে হাসান আবেদকে ২০১০ সালে ব্রিটেনের অন্যতম সম্মানজনক ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এ ছাড়া অসংখ্য দেশি-বিদেশি পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। ২০১১ সালে অর্জন করেন কাতার ফাউন্ডেশন প্রবর্তিত শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘ওয়াইজ প্রাইজ’। এগুলো ছাড়াও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অসংখ্য পুরস্কার এবং সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।
বিশ্ব জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান এবং দরিদ্র মানুষের সুরক্ষায় কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য স্যার ফজলে হাসান আবেদ ২০১৬ সালে ‘টমাস ফ্রান্সিস জুনিয়র মেডেল অব গ্লোবাল পাবলিক হেলথ’ পদক পান। খাদ্য ও কৃষিক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০১৫ সালে বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার, ২০১৪ সালে লিও তলস্তয় আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক ও ২০১৩ সালে হাঙ্গেরির ‘সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি’ (সিইইউ) প্রদত্ত ‘ওপেন সোসাইটি প্রাইজ’ পান। ২০১৪ সালে তিনি স্পেনের সর্বোচ্চ বেসামরিক নাগরিক সম্মাননা ‘অর্ডার অব সিভিল মেরিট’ পান।
তিনি ২০০৭ সালে প্রথম ক্লিনটন গ্লোবাল সিটিজেন অ্যাওয়ার্ড, ২০০৪ সালে মানব উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখায় ইউএনডিপি মাহবুবুল হক মানব উন্নয়ন অ্যাওয়ার্ড, ২০০১ সালে ওলফ পামে প্রাইজ, ১৯৯২ সালে ইউনিসেফ মরিস পেট অ্যাওয়ার্ড, ১৯৮০ সালে র্যামন ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড ফর কমিউনিটি লিডারশিপ লাভ করেন।
তিনি অশোকার সম্মানজনক গ্লোবাল একাডেমি ফর সোশ্যাল এন্ট্রাপ্রেনিওরশিপের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এ ছাড়া তিনি সম্মানসূচক একাধিক ডিগ্রি পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব ল (২০০৮), ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব হিউম্যান লেটারস (২০০৭), প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি (২০১৪), যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি (২০১২), বাথ ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজ (২০১০), কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজে (১৯৯৪) ভূষিত হন।
তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ২০০৭ সালে পেয়েছে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদক স্বাধীনতা পুরস্কার।
২০১৯ সালে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নে কয়েক দশকব্যাপী অনবদ্য ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ নেদারল্যান্ডসের নাইটহুড ‘অফিসার ইন দ্য অর্ডার অব অরেঞ্জ-নাসাউ’ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ।
২০১৯ সালে শিক্ষা উন্নয়ন বিষয়ে অত্যন্ত মর্যাদাসূচক এবং অর্থমূল্যের দিক থেকে সবচেয়ে বড় পুরস্কার ইদান প্রাইজ লাভ করেন তিনি। হংকংভিত্তিক ইদান প্রাইজ ফাউন্ডেশন এ পুরস্কার ঘোষণা করে।
২০১৮ সালে প্রাক-শৈশব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অসাধারণ অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ লেগো ফাউন্ডেশন, ডেনমার্কের লেগো পুরস্কার পান তিনি।