শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২০
প্রথম পাতা » ব্রেকিং নিউজ » সক্ষমতার পরেও বসে বাপেক্স, আগ্রহ বিদেশি কোম্পানিতে
সক্ষমতার পরেও বসে বাপেক্স, আগ্রহ বিদেশি কোম্পানিতে
পক্ষকাল সংবাদ-
বাংলাদেশকে জ্বালানি তেল আমদানিতে বছরে প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয় । ডিজেল, কেরোসিন, জেট ফুয়েলসহ দেশে ৬০ লাখ টন তেল আমদানি করতে হয়। গত কয়েক মাস বিশ্ববাজারে তেলের দাম উর্ধ্বমুখী। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে চলমান উত্তেজনায় সেই দাম আরও বাড়ার শঙ্কা করা হচ্ছে।
এছাড়া নতুন করে এলএনজি (লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস) আমদানিও বাড়ছে। এদিকে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর জন্য কয়লা আমদানির প্রক্রিয়া চলমান। আমদানি করা জ্বালানির দাম বেশি হওয়ায় সরকারকেও বাড়াতে হচ্ছে তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম। এতে সকল ধরণের পণ্য উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দায়িত্বে নিয়োজিত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা পেট্রোবাংলা এ বিষয়ে অনেকটা নির্বিকার। তবে সক্রিয় আমদানির ক্ষেত্রে। সমকাল’র এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে।
পেট্রোবাংলার অধীনস্ত তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাপেক্সের হাতে কাজ নেই। অলস বসে আছে। সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কয়েকটি বিদেশি কোম্পানিকে কাজ দেয়া হয়েছে। কিন্তু নানা কারণে তারাও সক্রিয় নয়। ফলে বিদেশ থেকে অতিরিক্ত দামে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। দেশে উৎপাদিত গ্যাসের চেয়ে আমদানি করা গ্যাসের দাম প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। আমদানির পরিমাণ যত বাড়বে, ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দামও তত বাড়াতে হবে। কারণ এত বেশি ভর্তুকি দেয়ার সক্ষমতা সরকারের নেই। এমন পরিস্থিতিতেও পেট্রোবাংলা তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কোনো কার্যক্রম নেই।
দেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ৪২০ কোটি ঘনফুট। সেখানে সরবরাহ করার ক্ষমতা আছে ৩২০ কোটি ঘনফুট। ঘাটতি ১০০ কোটি ঘনফুট। বর্তমানে প্রতিদিন আমদানি করা গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে ৬০ কোটি ঘনফুট। পাইপলাইন সীমাবদ্ধতার কারণে আরও ৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা জানান, পৃথিবীর ব-দ্বীপ দেশগুলো তেল-গ্যাসসমৃদ্ধ। তেমনি বাংলাদেশে এখনো অনেক গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। বিশেষ করে, বঙ্গোপসাগরে সম্ভাবনা ব্যাপক। সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বড় বাধা ছিল সীমানা সমস্যার সমাধান হয়েছে। মিয়ানমার তাদের প্রান্তে গ্যাস আবিস্কার করে সেই গ্যাস তুলে বিদেশে রপ্তানি করছে। ভারতও তাদের সীমানায় সাগরে গ্যাস আবিস্কার করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো সাগরে জোরেশোরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কাজই শুরু করতে পারেনি।
গত জুনে গ্যাসের দাম ৩২ শতাংশ বাড়ানো পর এখন আবারো বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে। চলতি বাজেটে রাজস্ব আহরণের যে টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জন করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। ফলে তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম ক্রমান্বয়ে বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর ইউএসজিএস ২০০১ সালে বলেছিল, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ সীমানায় অন্তত আট টিসিএফ উত্তোলনযোগ্য গ্যাস থাকতে পারে। ২০০৪ সালে মার্কিন তেল-গ্যাস কোম্পানি ইউনিকল একটি জরিপ করে বলেছিল, দক্ষিণের জেলা ভোলাতে কমবেশি চার টিসিএফ গ্যাস থাকতে পারে। ফলে শুধু সাগর ও ভোলাতেই মোট ১১ টিসিএফ গ্যাসপ্রাপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া বর্তমানে আবিস্কৃত যে ক্ষেত্রগুলো আছে, সেখানে উত্তোলনযোগ্য মজুদ রয়েছে এখনো আট টিসিএফ। দেশে বর্তমানে প্রতিবছর গ্যাসের চাহিদা হলো গড়ে এক টিসিএফ। অর্থাৎ, এ হিসাবে দেশে মোট ২০ বছরের চাহিদা পূরণ করার মতো গ্যাস আছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, অনুসন্ধান কাজ যদি জোরদার থাকত তাহলে এসব তেল-গ্যাস আবিস্কার করা সম্ভব হতো। এ বিপুল পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করতে পারলে অতি উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি করার প্রয়োজন হতো না। পরবর্তী ১০ বছরে এলএনজি আমদানিতে যে কয়েক লাখ কোটি টাকা খরচ হবে, সেটাও হতো না।
মালয়েশিয়ার তেল-গ্যাস কোম্পানি পেট্রোনাস এবং ভারতের ওএনজিসি কয়েক দশকে ব্যাপক সক্ষমতা অর্জন করেছে। শুধু নিজের দেশ নয়, তারা বিদেশে গিয়েও তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও তোলার কাজ করছে। সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের সক্ষমতাও অর্জন করেছে এ দুই কোম্পানি। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স সেই সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি একমাত্র রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে। বাপেক্স সাগরে না হলেও সমতল ভূমিতে মাটির নিচে গ্যাস অনুসন্ধান ও তুলতে যথেষ্ট অভিজ্ঞ। কিন্তু এরপরও বাপেক্সকে বাদ দিয়ে সমতল ভূমির বহু তেল-গ্যাস ব্লক বিদেশি কোম্পানিকে দেয়া হচ্ছে।
২০১২ সালে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় কোম্পানি গ্যাজপ্রমকে টেন্ডার ছাড়াই বাংলাদেশে মোট ভূমির ১০টি কূপ খননের অনুমোদন দেয়া হয়। ২০১৫ সালে আরো পাঁচটি কূপের অনুমোদন দেয়া হয়, সেটাও টেন্ডার ছাড়াই। অথচ এ কূপগুলো খনন করার সক্ষমতা বাপেক্সেরই ছিলো। গত ৩০ বছরে বাপেক্স হাজার হাজার লাইন কিলোমিটার ভূতাত্ত্বিক জরিপ করেছে, একের পর এক গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার করেছে। অথচ হাতেগোনা কিছু অনুসন্ধান কূপ খনন করার অনুমোদন পেয়েছে।
বিশ্নেষকরা দাবি করেন, বাপেক্সের প্রতি পেট্রোবাংলার তেমন কোনো আগ্রহ নেই, আগ্রহ বিদেশি কোম্পানিতে। বাপেক্সকে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিতে চায় না পেট্রোবাংলা। অবশ্য বাপেক্সকে শক্তিশালী করতে কূপ খননের জন্য বেশ কয়েকটি রিগ কেনা হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। বেশ বিনিয়োগও করা হয়েছে এ সংস্থায়। তবে এ রিগগুলো বর্তমানে কূপ খননের অভাবে অলস পড়ে আছে বলে জানা গেছে।
২০১৪ সালে শ্রীকাইলে দুটি কূপ খননের পর ‘শ্রীকাইল ৪ নম্বর কূপ’ থেকে গ্যাস উত্তোলনের অনুমোদন চায় বাপেক্স। কিন্তু অনুমতি মেলেনি। অথচ একই স্তরে অবস্থিত বাঙ্গুরার চারটি কূপ থেকে উত্তোলনের অনুমোদন পেয়েছে সিঙ্গাপুরের তেল-গ্যাস কোম্পানি ক্রিস এনার্জি। এ কূপগুলো থেকে বাপেক্সকে দিয়ে গ্যাস উত্তোলন করালে মাত্র ১০ ভাগের ১ ভাগ খরচে গ্যাস পাওয়া যেত।
বাপেক্সের বদলে বিদেশি কোম্পানি দিয়ে কাজ করালেই আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়ে। কারণ প্রতিটি কূপ খনন করতে বাপেক্স নেয় ৮০ কোটি টাকা। আর বিদেশি কোম্পানি নেয় গড়ে ১৫০ কোটি টাকা। থ্রিডি জরিপ করতে বাপেক্স নেয় ৯ থেকে ১৩ লাখ টাকা আর বিদেশি কোম্পানি নেয় সর্বোচ্চ দুই কোটি টাকা।
১৯৯৭ সালে মাগুরছড়ায় এবং ২০০৫ সালে টেংরাটিলায় বিদেশি কোম্পানির কূপ খননকাজ চলার সময় তিনটি ভয়াবহ গ্যাস বিস্টেম্ফারণ ঘটে। এ বিস্টেম্ফারণগুলোতে দেশের প্রায় ৫৫০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ধ্বংস হয়ে যায়। অপূরণীয় ক্ষতি হয় পরিবেশের। টেংরাটিলায় নাইকোর অদক্ষতার কারণেই যে বিষ্ফোরণ ঘটেছে, সে বিষয়ে বাপেক্সের কাছে নাইকোর লিখিত স্বীকারোক্তিও আছে। অথচ বাপেক্সের প্রায় ৩০ বছরের খনন ইতিহাসে একটি দুর্ঘটনারও নজির নেই। কিন্তু সেই রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্সের প্রতি রাষ্ট্রের সুনজরের ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
মাইলের পর মাইল জরিপ করে গ্যাসের সন্ধান পায় বাপেক্স, আর গ্যাসকূপ খনন ও উত্তোলনের অনুমতি পায় বিদেশি কোম্পানি। বিদেশিরা খনন করে বাপেক্সের দ্বিগুণ খরচে, গ্যাস বিক্রিও করে বাপেক্সের তিন গুণ দামে। বিদেশিদের ত্রুটিপূর্ণ খননে গ্যাসকূপ নষ্ট হয়, আর শেষ পর্যন্ত সেগুলো মেরামতও করে বাপেক্স। তারপরও বাপেক্সকে বিনিয়োগ করতে প্রয়োজনীয় অর্থ দেয়া হয় না। বাপেক্স কূপ খননের অনুমোদন পায় না। বরং জনগণের ওপর এলএনজি আমদানির বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয় আক্ষরিক অর্থেই ১০ গুণ বাড়তি দামে।