কানাডার বেগম পাড়ার বেগমরা ভাল নাই
বিশ্বায়ন, অভিবাসন আর বর্ণবাদের বাইপ্রডাক্ট বেগম পাড়া : এখানকার অধিবাসীদেরকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে প্রতিকূলতার সঙ্গে
প্রবাসী কণ্ঠ : বেগম মহলের নাম শুনেছেন সবাই। বেগম বাজার বলেও একটি জায়গা আছে পুরানো ঢাকার বংশাল এলাকায়। কিন্তু বেগম পাড়ার নাম শুনেছেন কেউ? তাও আবার এই টরন্টোতে?
টরন্টো প্রবাসী যে কোন বাঙ্গালীকে জিজ্ঞেস করা হলেই তিনি বলবেন- হ্যা, শুনেছি বেগম পাড়ার নাম। যদি জিজ্ঞেস করা হয় কোথায় সেই বেগম পাড়া? এর উত্তর হয়তো অধিকাংশ বাঙ্গালীই দিতে পারবেন না। আর যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এই বেগম পাড়ায় কারা থাকেন তা জানেন কি? এর উত্তরে হয়তো তারা বলবেন, বাংলাদেশে যারা অতি ধনী লোক তাদের বেগম সাহেবাগণ।
টরন্টো প্রবাসী বাঙ্গালীদের মধ্যে গত কয়েক বছর ধরেই এই বেগম পাড়া বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ঘরোয়া আড্ডায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই বেগম পাড়া নিয়ে প্রায়শই আলোচনার ঝড় উঠছে। এমন কি টরন্টোর মেইন স্ট্রিম মিডিয়াতেও বেগম পাড়া নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। হিন্দীতে একটি শর্ট ফ্লিমও তৈরী হয়েছে এই বিষয়ের উপর।
অতি সম্প্রতি বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে টরন্টোর এই বেগম পাড়া সম্পর্কে কথা বলেছেন। কথা বলেছেন জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদও যিনি বর্তমান প্রধামন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
মির্জা ফকরুল গত জানুয়ারী মাসে অভিযোগ করে বলেন, “বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকেই টরন্টোর বেগম পাড়ায় বাড়িঘর কিনছেন।” অন্যদিকে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ আরো কয়েক বছর আগেই এই অভিযোগ তুলেন। ২০১৪ সালে বাজেটের উপর সংসদে দেয়া বক্তৃতায় টাকা পাচার, ব্যাংক ও শেয়ারবাজারের টাকা লুটপাটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “মালয়েশিয়া ও কানাডায় টাকা পাচার হচেছ। অনেকে সেখানে বাড়ি করছেন। কানাডায় বেগম পাড়া গড়ে তুলেছেন তারা। এত টাকা তারা কোথায় পেলেন?”
উল্লেখ্য যে, বিএনপির নেতা আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলেছেন সেই একই অভিযোগ তার দলের নেতাদের বিরুদ্ধেও আছে। আর হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের কীর্তিতো সবাই জানেন।
টরন্টোর রিচমন্ড এলাকায় অবস্থিত কিছু বাড়িঘরের মালিক বাংলাদেশী অতি ধনী ব্যক্তিদের কেউ কেউ। সেই কারণে স্থানীয় বাংলাদেশীরা এর নাম দিয়েছেন বেগম পাড়া। এখানে ঐ ধনী ব্যক্তিদের বেগম ও সন্তানেররাই প্রধানত থাকেন। আর ঐ ধনী ব্যক্তিরা থাকেন বাংলাদেশেই। তারা আসা যাওয়ার মধ্যে থাকেন। কারণ দেশে রয়েছে তাদের ব্যবসা বা চাকরী অথবা রাজনীতি। আবার অভিযোগ রয়েছে, এই বেগম পাড়ার বাড়ির মালিকদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা কালো টাকার মালিক। দেশে কাল টাকা রাখার জায়গা পান না বলে এখানে এনে তা বিনিয়োগ করেন।
লন্ডন প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফ “সেকেন্ড হোম : বেগম পাড়ার সাহেব ও দেশ বিক্রির কচ্ছপেরা” শিরোনামে তার একটি লেখায় বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সিরাজুল ইসলামের একটি উদ্বৃতি দিয়েছেন যেখানে বলা হয়েছে “কানাডার টরন্টোর একটি এলাকাকে স্থানীয় বাংলাদেশিরা ‘বেগম পাড়া’ ডাকে। এই বেগম পাড়ার বেগমদের সাহেবরা তাঁদের সঙ্গে থাকেন না। তাঁরা বাংলাদেশে থেকে কষ্ট করে টাকা বানান; টাকা বানাতে ক্লান্তি লাগলে পরে এসে সেখানে পরিবারের সঙ্গে ‘আরামের’ সময় কাটান। এই বাংলাদেশি ‘বেগম’দের আরাম-আয়েশ দেখলে মোগল বেগমরাও হিংসায় জ্বলতেন। তাঁদের অ্যাপার্টমেন্টগুলো বিলাসসামগ্রীতে ভরা। তাঁদের সন্তানেরা সে দেশের ভালো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে। ‘বেগম’দের একমাত্র কাজ হলো ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করা আর ‘আরাম’ করা। সারা কানাডায় এ রকম অনেকগুলো ‘বেগম পাড়া’ আছে।” সিরাজুল ইসলাম এই গল্পটি বলেছিলেন বৃটেনের ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায়।
গ্রেটার টরন্টোতে বেগম পাড়া আসলে বেশ কয়েকটি আছে। তবে বাঙ্গালীদের কাছে সবচেয়ে আলোচিত বেগম পাড়াটির অবস্থান টরন্টোর ডাউনটাউনের রিচমন্ড হিলে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, রিচমন্ড হিলের এই বেগম পাড়ার অধিবাসীরা যে সকল বাড়িতে থাকেন সেগুলো অনেক দামী। বর্তমান বাজার মূল্যে সেগুলোর কোনটাই দেড় থেকে দুই মিলিয়ন ডলারের কম নয়। বা আরো বেশী হতে পারে। কিন্তু আলিশান এইসকল বাড়িতে লোকসংখ্যা তিন থেকে চারজন। অর্থাৎ বেগম সাহেবা ও তার দুই থেকে তিনজন সন্তান। কোন কোন বেগম আবার বাড়িতে আয়াও (বাড়ির কাজের লোক) রাখেন। কানাডায় নিজ বাড়িতে আয়া রাখা আর বাংলাদেশে নিজ বাড়িতে কাজের বুয়া রাখা এক জিনিষ নয়। আকাশ পাতাল তফাৎ। এখানে আয়াদের বেতন বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের সমান প্রায়।
বেগম পাড়ার বেগমদের সন্তানদের প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা গাড়ি আছে। আর এই সকল গাড়িও অত্যন্ত দামী ব্র্যান্ডের। মার্সিডিস বা বিএমডব্লিও অথবা অন্যকোন দামী ব্র্যান্ডের গাড়ি। বেগম সাহেবা ও সন্তানদের এ দেশে রেখে যাওয়ার সময় ক্যাশ টাকায় এইসকল দামী গাড়ি কিনে দিয়ে যান বাংলাদেশী সাহেবগন।
বাংলাদেশে যারা কালো টাকার মালিক তাদের পরিচয় গোপন কিছু নয়। বাংলাদেশে প্রায় সব ব্যবসা ও পেশায় কিছু কিছু দুর্নীতিবাজ লোক আছেন যারা নানান অবৈধ উপায়ে মানুষ ঠকিয়ে রাতারাতি সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছেন। ফটকা শেয়ার ব্যবসায়ী, কিছু অসাধু গার্মেন্টস ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ কিছু এমপি ও মন্ত্রী এরা সবাই আছেন এই তালিকায়। আরো আছেন অসাধু কিছু এনজিওর মালিক, কাস্টম কর্মকর্তা, পুলিশ, ভূমি দস্যু এবং বড়মাপের চোরাকারবারী।
অবৈধ পথে আয় করা অনেক কাল টাকার মালিকেরা দেশের বাইরে বিপুল পরিমানের অর্থ পাচার করে থাকেন। বিডিপ্রতিদিন.কম এর এক খবরে বলা হয়, “বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ৪৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। কর ফাঁকি, সরকারি সুযোগ-সুবিধার অপব্যবহার এবং সস্তা শ্রমের সুবাদে অসৎ ব্যবসায়ীরা যে মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলছে তার এক বড় অংশই পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ হলো ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২০ কোটি টাকারও বেশি। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়ে থাকে। ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়- আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান ইত্যাদি উন্নত ধনী দেশসহ ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশও বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ভোগ করছে।”
ঐ রিপোর্টে আরো বলা হয়, “পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্টরা এ ধরনের পাচারের সঙ্গে বেশি জড়িত। সরকারের কাছ থেকে ছলচাতুরীর মাধ্যমে নেওয়া বিভিন্ন সুবিধার অপব্যহারকারী পোশাকশিল্প মালিকরা অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে এগিয়ে। গত তিন বছরে পোশাক উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই শ্রমিকদের প্রকৃত বেতন বাড়ার বদলে কমেছে। চাপ প্রয়োগ করে সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা আদায় এবং শ্রমিকদের ঠকিয়ে যে অর্থ পোশাক শিল্পমালিকদের একাংশ আয় করছেন, কানাডার একটি পত্রিকার মতে সে টাকায় টরেন্টোতে গড়ে তোলা হয়েছে, বেগম পাড়া।”
রিপোর্টে অবশ্য বলা হয়নি কানাডার কোন পত্রিকা এই খবরটি প্রকাশ করেছে। তবে কালো টাকার মালিকদের জন্য কানাডা যে একটি স্বর্গরাজ্যে পরিনত হয়েছে সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। গত কয়েক বছরে ভেঙ্গুভার ও টরন্টোর বাড়ির দাম যে ভাবে অবিশ্বাস্য রকমে বৃদ্ধি পেয়েছে সেটাই তার একটি প্রমাণ। ভেঙ্গুভারে এমনো দেখা গেছে দুই বা তিন মিলিয়ন ডলারের বিলাসবহুল বাড়ির মালিক একজন ইমিগ্রেন্ট রেস্টুরেন্ট কর্মী বা সেলুন কর্মী। একজন স্বল্প আয়ের রেস্টুরেন্ট কর্মী বা অন্য যে কোন পেশার কর্মীর পক্ষে দুই বা তিন মিলিয়ন ডলারের বাড়ি ক্রয় করা কোন ভাবেই সম্ভব নয়। তিন চার পুরুষ ধরে অর্থ সঞ্চয় করলেও এটি সম্ভব নয়। তাহলে বাড়ির প্রকৃত মালিক কে? সহজ ক্যালকুলেশন – ঐ কালো টাকার মালিকেরা, যার মধ্যে সংখ্যায় কম হলেও কিছু সংখ্যক বাংলাদেশীও আছেন।
কানাডা এমন একটি দেশ যেখানে বিদেশী কাল টাকার মালিকেরা বেনামীতে কোম্পানী খুলতে পারেন এবং তাদের নিজ নিজ দেশের সরকারের অনুসন্ধানী চোখকে ফাঁকি দিতে পারেন। গ্লোব এন্ড মেইল পত্রিকায় প্রকাশিত পিটার ডেন এবং এলিসা নাহিরনির এক যৌথ প্রবন্ধে এ কথা বলা হয়। তারা আরো লিখেন, “অনেকের হয়তো ধারণা যে, এই জাতীয় দুই নম্বরী কাজ দুর্নীতিগ্রস্থ দেশগুলোতেই ঘটে থাকে। কিন্তু না, এটি ভুল ধারনা। ২০১৫ সালে ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনাল কানাডার বেনিফিশিয়াল ওনারশীপ ট্রান্সপারেন্সীর উপর তাদের যে রিপোর্ট প্রকাশ করে তাতেও দেখা যায় এখানে ঘাপলা রয়েছে এবং রাশিয়া, মেক্সিকো বা সৌদী আরবের কাতারেই কানাডার অবস্থান এ ক্ষেত্রে। আর এর ফলে সাধারণ কানাডিয়ানদের উপর অধিকমাত্রায় করের বোঝা বৃদ্ধি পাচ্ছে যারা নিজেরা কর ফাঁকি দেন না বা সে চেষ্টাও করেন না। কানাডার রিয়েল এস্টেট মার্কেটেও এর বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কয়েকটি সিটিতে সাধারণ কানাডিয়ানদের নাগালের বাইরে চলে গেছে বাড়ির দাম। বিদেশী কাল টাকার নিরাপদ বিনিয়োগ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে কানাডার রিয়েল এস্টেট মার্কেট।”
উল্লেখ্য যে, এই প্রবন্ধের একজন লেখক পিটার ডেন ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনাল কানাডা শাখার বর্তমান প্রেসিডেন্ট।
কানাডার আইনে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকানার বিষয়টি গোপন রাখার সুযোগ থাকায় এখানে বিদেশী কালো টাকার মালিকদের জন্য খুবই সুবিধা হয়েছে। আর এ কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে কালো টাকা কানাডায় প্রবেশ করছে। আর এর সুযোগ নিচ্ছেন বাংলাদেশী কিছু কালো টাকার মালিকেরাও।
টরন্টোতে বাড়ির দাম বৃদ্ধির পিছনে এই বাংলাদেশীদের কিছুটা অবদান রয়েছে বৈকি। শুধুই কি বাড়ি? এদের কেউ কেউ টরন্টোতে প্লাজা (ছোট আকারের মার্কেট) কিনছেন বলেও শুনা যায়। এসব প্লাজার বর্তমান বাজার মূল্য কম করে হলেও ১৫ থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার বা তারো বেশী। এটি নির্ভর করে প্লাজার আয়তন ও ভবনের সংখ্যার উপর।
রিচমন্ড এলাকায় বেগম পাড়া গড়ে উঠার পিছনে যে কারণগুলো রয়েছে তার মধ্যে এই কালো টাকা একটি ইস্যু। বাংলাদেশী সাহেবরা অবৈধ পথে বিপুল পরিমানের টাকা আয় করে সেগুলো বৈধ উপায়ে ব্যাংকে রাখার সুযোগ পান না অথবা বৈধভাবে বিনিয়োগ করারও সুযোগ পান না। মাঝে মধ্যে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাংলাদেশ সরকার দেয় বটে বাজেট ঘোষণার সময়। কিন্তু এই সাহেবদের হাতে এত বেশী কালো টাকা থাকে যে তা অনেকের ধারণারও বাইরে। আর এগুলো সাদা করতে গেলে ভয়াবহ সব দুর্নীতির তথ্য ফাঁস হয়ে যেতে পারে। সেই ভয়েও অনেকে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নেন না। বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে বেছে নেন অবৈধভাবে বিদেশে অর্থপাচারের। আয়ও করেন অবৈধ পথে, বিদেশে পাচারও করেন অবৈধ পথে। আবার কানাডায় এসে কানাডার প্রচলিত আইনের বিভিন্ন ফাঁকফোকর খুঁজে নিয়ে সেই অর্থ এমনভাবে বিনিয়োগ করেন যেন কেউ তার অপকীর্তির ইতিহাস খুঁজে না পায়।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও এর পিছনে কাজ করে। বাংলাদেশে যারা অবৈধ উপায়ে শত সহস্র কোটি টাকা আয় করেন তারা কোন না কোন রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকেন। কারণ, ‘সাত খুন মাপের’ একটি সুযোগ পাওয়া যায় ওতে করে। পুলিশ, গোয়েন্দা, প্রশাসন এগুলোর ঝক্কি ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকা যায়। অবশ্য এর জন্য অবৈধ উপায়ে আয় করা অর্থ থেকে একটা মোটা অংকের কমিশন দিতে হয় তাদেরকে। এই মোটা অংকের কমিশন তাদের গায়ে লাগে না। কারণ কোন ডিলে এক কোটি টাকা আয় হলে দুই চার লাখ টাকা কমিশন দিলেও ক্ষতি নেই। এটিকে কৈ এর তেলে কৈ ভাজার মতই দেখেন তারা।
কিন্তু সমস্যা হয় যখন রাজনীতির পট পরিবর্তন হয়। যারা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের সমস্যাটা হয় বেশী। কারণ প্রতিপক্ষ তখন তাদের প্রতিশোধ নিতে ব্যস্ত হয়ে উঠে। আর তখনই
সদ্য ক্ষমতা হারানো ব্যক্তিরা দেশ ছেড়ে সাময়িকভাবে চলে আসেন বিদেশে এবং সেই সাথে অবৈধ উপায়ে আয় করা টাকাপয়সাও চলে আসে নানান অবৈধ উপায়ে। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে এমন পরিস্থিতিই দেখা গেছে। হুন্ডী ব্যবসায়ীগণও তখন বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাদের সেবা প্রদান করার জন্য।
অন্য যে কারণগুলো আছে তা হলো, ছেলে-মেয়েদের উন্নত ও উচ্চ শিক্ষা এবং নিশ্চিত ও নিরাপদ ভবিষ্যত। অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্যনকারীরা দেশের বাইরে নিজের জন্য একটি নিরাপদ বাসস্থান এর ব্যবস্থা করে রাখেন যাতে দেশে বিপদ হলে এখানে এসে আশ্রয় নেয়া যায়। পাশাপাশি ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যত।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা যায়। বিষয়টি হলো, ফিয়ার অব স্পাউজাল ইনফাইডিলিটি। অর্থাৎ একে অপরকে সন্দেহ করা। বেগম থাকেন সাত সমুদ্র এপারে আর সাহেব থাকেন সাত সমুদ্র ওপারে। মাঝখানে অর্ধেক পৃথীবির দূরত্ব। এই দূরত্ব কি অন্যকোন দূরত্বও তৈরী করে? শরীরের দূরত্ব, মনের দূরত্ব, ভালবাসার দূরত্ব? এই দূরত্ব থেকে কি ক্রমে তৈরী হতে পারে সংশয়, সন্দেহ আর অবিশ্বাস?
টরন্টো স্টার পত্রিকায় বেগম পাড়া বিষয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল গত ২০১১ সালে। সেই প্রতিবেদনেও এই ফিয়ার অব স্পাউজাল ইনফাইডিলিটি উপর ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল।
এই কথা সবাই জানেন যে, এই ফিয়ার অব স্পাউজাল ইনফাইডিলিটি থেকে যে অন্তর্দহন সৃষ্টি হয় তার পরিনতি কখনোই শুভ হয় না যদি এটি চলতেই থাকে।
বেগম পাড়া নিয়ে টরন্টোতে একটি ডকুমেন্টারীও তৈরী হয়েছে কয়েক বছর আগে হিন্দীতে। ডকুমেন্টারীটির নাম ‘বেগমপুরা : দি ওয়াইভস কলোনী’ (Begumpura: The Wives Colony)। টরন্টো স্টার এর প্রতিবেদন আর হিন্দীতে নির্মিত এই ডকুমেন্টারীতে যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে তা হলো প্রবাসে এই বেগম পাড়ার বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবন সংগ্রাম। তবে এই বেগম পাড়ার বাসিন্দারা অতি ধনীদের কেউ নন বা কালো টাকার মালিকও নন। এ এক ভিন্ন রকমের বেগম পাড়া। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের পেশাজীবীদের স্ত্রী এরা। এদের স্বামীরা থাকেন প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। কানাডায় আসার পর পেশাজীবী এই ইমিগ্রেন্টরা নিজ নিজ পেশায় চাকরী না পেয়ে আবার চলে যান মধ্যপ্রাচ্যে যেখানে তারা ভাল বেতনে ভাল পজিশনে চাকরী করতে পারছেন। কিন্তু সে জন্য তাদেরকে বিসর্জন দিতে হচ্ছে স্ত্রী ছেলে-মেয়ে এদের নৈকট্য আর স্নেহ ভালবাসা। বছরে দুই থেকে তিন বার মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকা এই স্বামীরা কানাডায় আসছেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য। এক দুই সপ্তাহ থেকে আবার চলে যেতে হচ্ছে তপ্ত মরুর তপ্ত জীবনে। এভাবে স্ত্রী ও সন্তানদের ছেড়ে বছরের পর বছর তাদেরকে কাটাতে হচ্ছে অদ্ভূত ও অস্বাভাবিক এক জীবন। অথচ কানাডায় বিভিন্ন ফিল্ডে রয়েছে দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রফেশনালদের অভাব।
বেগম পাড়া নিয়ে টরন্টো স্টারে যে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় গত ২৮ মে, ২০১১ সালে তার শিরোনাম ছিল, “‘কলোনী অব ওয়াইভস’ থ্রাইভস ইন মিসিসাগা” সেখানে একাধিক মহিলার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণিত হয়েছে যা হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যায়। এমনি এক মহিলা হলেন ইলমানা ফাসিহ্। বয়স তার ৪৪ এর মত হবে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই ইমিগ্রেন্ট মহিলা একজন গাইনকলোজিস্ট। একদিন মিসিসাগায় এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি হঠাৎ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। চারিদিকে এত লোক, এত আনন্দ এত হৈ-চৈ। অথচ তিনি এই আনন্দে ভাগ বসাতে পারছিলেন না। ক্ষণে ক্ষণে তিনি অনুভব করছিলেন চারদিকে এত আনন্দচ্ছোল মানুষের মাঝেও তিনি একেবারেই একা সুরহীন, তালহীন এবং বিমর্ষ।
ইলমানার স্বামী সাঈদ থাকেন সৌদী আরবের জেদ্দায়। বছরে বার দুই আসতে পারেন কানাডায় মাত্র কয়েকদিনের জন্য। দুই বছর ধরে আছেন তিনি সেখানে। আর ইলমানা দুই শিশু সন্তান নিয়ে থাকেন মিসিসাগায়। ইলমানা বলেন, আমি ও আমার স্বামী দুজনেই একাকী এবং হতাশ। আমাদের জন্য এই জীবন সত্যিই খুব কষ্টের।
ইলমানা মিসিসাগার বেগম পাড়ার একজন বাসিন্দা। তার মত এরকম আরো বহু মহিলা আছেন মিসিসাগায় যারা বেগম পাড়ার বাসিন্দা। বেগম পাড়া মিসিসাগায় একটি নয়। বেশ কয়েকটি রয়েছে। টরন্টো স্টারের হিসাব মত প্রায় হাফ ডজন। এই বেগম পাড়াগুলোতে কয়েক সহস্র মহিলা থাকেন তাদের শিশু সন্তানদের নিয়ে। আর তাদের স্বামীরা থাকেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। এদের বেশীরভাগই পাকিস্তানী।
কানাডায় প্রফেশনাল জব না পাওয়ার কারণেই এই ইমিগ্রেন্ট পরিবারগুলোতে নেমে অসে এই করুন অধ্যায়। এরা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে প্রথমে আসেন মধ্যপ্রাচ্যে। এদের মধ্যে আছেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ অন্যান্য পেশাজীবী। দীর্ঘদিন মধ্যপ্রাচ্যে থাকার পর ছেলে-মেয়েরা যখন একটু বড় হয়ে যায় তখন এক নতুন সমস্যা দেখা দেয় এদের জীবনে। মধ্যপ্রাচ্যে এদের ছেলে-মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ নেই। গ্রেড ১২ এর পর তাদেরকে হয় দেশে ফিরে যেতে হয় উচ্চ শিক্ষার জন্য অথবা অন্যকোন দেশে। বাবা-মা তখন ভরসা পান না ছেলে-মেয়েদেরকে একা নিজ দেশে বা অন্যকোন দেশে পাঠিয়ে দিতে। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে বিদেশী কর্মীদেরকে সাধারণত ইমিগ্রেন্ট স্ট্যাটাস বা নাগরিকত্ব দেয়া হয় না। আর দীর্ঘদিন বিদেশে কাটিয়ে দেশে ফিরে যাওয়াটাও হয়ে উঠে না নানাবিধ কারণে। এর মধ্যে আছে নিজ নিজ দেশে নিরাপত্তাহীনতা, অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশ, অনুন্নত জীবন মান ইত্যাদি। ফলে তখন সুযোগ খুঁজেন অন্যকোন দেশে যাওয়ার যেখানে নিজেদের এবং সন্তানদের ভবিষ্যত সুন্দর ও সুখী হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আর এরকম দেশের তালিকায় সবার উপরে রয়েছে কানাডা।
কিন্তু সেই স্বপ্নের দেশ কানাডাও দুঃস্বপ্নের দেশ হয়ে যায় যখন এই প্রফেশনাল ইমিগ্রেন্টরা তাদের নিজ নিজ পেশায় চাকরী খুঁজে না পান। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা এই ইমিগ্রেন্টরা সাধারণত একটু পরিনত বয়সেই আসেন এখানে। ফলে পেশাভিত্তিক চাকরী না পেলে তাদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে উঠে কানাডার জীবন। এই বয়সে তারা শারীরিকভাবে পরিশ্রম করতে হয় এমন কাজ করতে পারেন না। আর যদিও বা বাধ্য হয়ে করতে যান তখন দেখা যায় বেতন পাচ্ছেন সর্বনিন্ম হারে। এই সকল চাকরীতে নেই কোন বেনিফিট, নেই কোন ড্রাগ প্লান, শিফটিং ডিউটি হলে সে আরেক বাড়তি যন্ত্রণা, অন কলের জব হলে যন্ত্রণা আরো বৃদ্ধি পায়, তারপরেও আছে সকালে হায়ার তো বিকেলে ফায়ারের বেইজ্জতি।
মিসিসাগার বেগম পাড়াগুলো ছড়ানো ছিটানো। এগুলোর বেশীর ভাগেরই অবস্থান স্কয়ার ওয়ান মল এবং সেরিডিয়ান মলের নিকবর্তী সুউচ্চ ভবনগুলোতে। বেগম পাড়ার এই বেগমেরা সংসার চালানো জন্য নিয়মিত অর্থ পান মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত তাদের স্বামীদের কাছ থেকে। কেউ কেউ অবশ্য এখানে নিয়মিত বা অনিয়মিত কাজও করেন বাড়তি কিছু অর্থ আয়ের জন্য। টরন্টো স্টারের প্রতিবেদনে বলা হয়, এই বেগমদের সবাই প্রতিকুল অবস্থার সঙ্গে কঠিন লড়াই করছেন। একাকিত্ব, একা বাচ্চাদের লালন পালন করা, লং-ডিস্টেন্স ম্যারেজ, ফিয়ার অব স্পাউজাল ইনফাইডিলিটি (স্বামী বা স্ত্রী কর্তৃক বিশ্বাসঘাতকতা), নতুন কালচারের দেশ ও সামাজ এবং ফরেইন বুরোক্রেসী এই সবই তাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
মিসিসাগার এই বেগম পাড়ার বেগমদের প্রতিকুল জীবন যাপনের চিত্রটি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে ২০১০ সালে তৈরী করা ‘Begumpura: The Wives Colony’ নামের একটি ডকুমেন্টারীতে। ডকুমেন্টারীটি প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছেন রাসমী লাম্বা। এটি টরন্টোর অমনি ওয়ান টিভিতে প্রদর্শীত হয়েছে ইতিপূর্বে। (আগ্রহীরা http://www.omnitv.ca/on/southasian/videos/785808071001/ এই লিং এ গিয়ে ডকুমেন্টারীটি দেখতে পাবেন)।
রাসমী লাম্বা বলেন, এই ডকুমেন্টারীটি এক ধরণের থেরাপিও বলা যায়। কারণ, এটি যারা দেখবেন বিশেষ করে ঐ বেগম পাড়ার বাসিন্দারা, তারা তখন অনুধাবন করতে পারবেন যে তারা একা নন, তাদের মত সাফার করছে এমন আরো অনেক মহিলাই আছেন তাদের আশাপাশে। এই ডকুমেন্টারী থেকে তারা আরো জানতে পারবেন কি করে একা এই প্রবাস জীবনে বিভিন্ন ধরণের স্ট্রেস ও প্রেসার মোকাবেলা করতে হয়।
রাসমী লাম্বা যখন ডকুমেন্টারীটি তৈরী করেন (২০১০ সাল) তখন স্বামীও দুবাইতে কর্মরত ছিলেন।
মিসিসাগায় অবস্থিত ‘আওরত হেলথ সার্ভিসেস’ এর প্রধান নির্বাহী সামিনা তালাত টরন্টো স্টার এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন গ্রেটার টরন্টো এলাকার এই বেগম পাড়াগুলো বর্তমান যুগের বিশ্বায়ন এবং ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়ারই পরিনতি।
তিনি আরো বলেন, বেগম পাড়ার এই মহিলাগণ নিয়তই তাদের একাকিত্বের জন্য উদ্বেগ আর বিষন্নতায় ভুগেন। আর খুব কম লোকেই আসলে বুঝতে পারেন এর ব্যাপকতা কতখানি। এই ধরণের চাপ মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব বিস্তার করে। এরা এমন এক কালচার থেকে আসা যেখানে ব্যাংকিং বা কোন বিল পে করাটাও তারা জানতো না। কিন্তু এখানে এসে তাদেরকে বিস্তর চাপ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। আর বেগম পাড়ার মহিলাদের এই যে অবস্থা সেটা গোপন রাখার একটা প্রবণতা সর্বদাই লক্ষ্য করা যায়। ভাবখানা এই যে, কোন সমস্যই নেই তাদের। বেগমদের সমস্যা খুব কম লোকেই প্রকাশ করে।
মিসিসাগার এই বেগম পাড়াগুলো নতুন নয়। বেশ কয়েক বছর আগেই এগুলো গড়ে উঠেছে। নতুন যারা আসেন তারাও ঘুরে ফিরে ঐ বেগম পাড়াতেই গিয়ে উঠেন। স্বামীরা চলে যান মধ্যপ্রাচ্যে বা অন্য কোন দেশে। মিসিসাগার স্কয়ার ওয়ান বা শেরেডিয়ান মলের অভ্যন্তরে বা আশপাশের পার্ক এড়িয়াতে গেলে খুব সহজেই চোখে পড়ে এই বেগম পাড়ার বাসিন্দাদের। কেউ কেউ একা ঘুরছেন বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে, অন্যরা হয়তো দল বেধে ঘুরছেন। পার্কগুলোতেও সামার টাইমে দেখা যায় দল বেধে এরা ঘুরছেন বা বেঞ্চে বসে গালগল্পে মেতে উঠেছেন। কাছাকাছি হয়তো দেখা যাবে তাদের শিশুরা খেলায় মত্ত। এই বেগম মহলবাসীনীদের সবার একই চিন্তা, একই
ভাবনা এবং একই ধরণের সমস্যা। আর এই বিষয়গুলোই তাদেরকে সহজে পরষ্পরের প্রতি কাছে টেনে আনে। মলে বা পার্কে যখন একত্রিত হন তারা তখন ঘুরে ফিরে নিজেরদের কমন সমস্যাগুলোই আলোচনায় উঠে আসে।
এদেরই একজন মোনা আশরাফ। বয়স ৩৩ হবে। তিনি যে এপার্টমেন্টটিতে থাকেন সেখানে প্রায় অর্ধেক বাসিন্দাই তার মত। মোনার স্বামী একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। কানাডায় এসে ইঞ্জিনিয়ারিং এর জব পান নি। আত্মীয় বন্ধুরা পরামর্শ দিয়েছিলেন লাইসেন্স নিয়ে ক্যাব চালানোর জন্য। কিন্তু পরে মোনা ও তার স্বামী মিলে সিদ্ধান্ত নেন সে পথে তারা যাবে না। মোনার স্বামী ফিরে যান বাহরাইনে তার আগের চাকরীতে। মোনা থেকে যান এখানে সন্তানদের নিয়ে।
টরন্টো স্টারকে মোনা বলেন, পরিবার বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে আমাদের যে একাকিত্ব, আমাদের যে বেদনা এবং আমরা এখানে যে যন্ত্রণাকর অবস্থার মধ্যে অবস্থায় আছি তা একমাত্র ভুক্তভুগিরাই বলতে পারবেন।
মোনা নিজেও একজন উচ্চ শিক্ষিত মহিলা। পাকিস্তান থেকে সে পাবলিক হেলথ এর উপর মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে এসেছে।
সাবা খাতুন নামের আরেক মহিলা থাকেন সেরিডিয়ান মলের কাছে তার দুই ছেলে নিয়ে। সাবার বয়স ৩৬। তার দুই ছেলের বয়স ৮ এবং ৬। সাবার স্বামী কাজ করেন কাতারে। ছেলেদের চিন্তায় কিছুতেই আসে না তাদের বাবা কেন আরেক দেশে থাকেন। তারা মা’কে প্রায়ই প্রশ্ন করে এই বলে যে, “মা, তোমরা কি ডিভোর্স নিয়ে নিচ্ছ? সাবা বলেন, ছেলেরা খুব চিন্তা করে এ নিয়ে। তাদেরকে অনেকভাবে বুঝানো হচ্ছে যে, অর্থের প্রয়োজনেই তাদের বাবা অন্যদেশে চাকরী করছেন। হয়তো আরেকটি বয়স হলে তারা বিষয়টি বুঝতে সক্ষম হবে।
সাবা বলেন, অবুঝ ছেলেদেরকে বিষয়টি বুঝানো অত কঠিন নয় যতটা কঠিন এরকম প্রশ্ন যখন পরিবারের বাইরের অন্যকোন প্রাপ্তবয়স্করা করে বসেন। সাবা বলেন, আরো বিরক্ত লাগে যখন কেউ বলেন আমরা পাসপোর্টের জন্য এই দেশে এসেছি। পাসপোর্টটি পেলেই আমরা চলে যাব। এটি হয়তো কারো কারো বেলায় সত্যি। তবে আমাদের বেলায় নয়। আর এই বেগম পাড়ার সিংহভাগ মানুষের বেলায়ই এই ‘টেম্পরারী সেপারেশনের’ বিষয়টি জীবনের কঠিন সত্য।
বেগম পাড়ার এতো গেল একটা দিক যেখানে সাউথ এশিয়ান কিন্তু অবাঙ্গালীদের দুঃখ বেদনার ইতিকথা বর্ণিত হয়েছে। তবে মিসিসাগায় বা গ্রেটার টরন্টো এরিয়ার অন্য কোথাও বাঙ্গালীদের এমন আলাদা কোন বেগম পাড়া নেই যার সাথে স্কায়ার ওয়ান বা শেরিডিয়ান মলের আশপাশের বেগম পাড়ার বাহ্যিক মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। টরন্টোর ডাউন টাউনের রিচমন্ড এলাকায় বাঙ্গালীদের যে বেগম পাড়ার কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে সেটা অতি ধনীদের বেগম পাড়া। ওখানকার পরিবেশ পরিস্থিতি ভিন্ন।
পেশাজীবী বাঙ্গালীদের মধ্যে যারা স্কীল্ড ক্যাটাগরীতে কানাডা এসেছেন যেমন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষি বিজ্ঞানী বা এরকম অন্যান্য পেশার যারা কানাডায় এসেছেন তাদের শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগই পেশা ভিত্তিক চাকরী পাননি। কিন্তু চাকরী না পেলেও এদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যকই স্ত্রী পুত্র-কন্যাকে কানাডায় রেখে স্বদেশে বা অন্য কোন দেশে গেছেন চাকরী করতে। এদের অনেকই এসেছেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে। কিন্তু ঐ পাকিস্তানী বা ভারতীয়দের মত তারা কানাডায় চাকরী না পেয়ে মধ্য প্রাচ্যেও তেমনভাবে ফিরে যান নি।
বাঙ্গালী পুরুষরা সম্ভবত একটু বেশী মাত্রায় পরিবার প্রেমিক। পরিবারের গুরুত্বটা তাদের কাছে বেশী। স্ত্রীদের কাছে আরেকটু বেশী। ফলে সাময়িক বিচ্ছিন্নতাও তারা সহজে মেনে নিতে পারেন না।
তবে ব্যতিক্রম যে নেই তা বলা যাবে না। মিসিসাগার মত বাঙ্গালীদের ঐ রকম আলাদা বেগম পাড়া গড়ে না উঠলেও গ্রেটার টরন্টোতে ছাড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু পরিবার যেখানে স্বামী থাকেন অন্য দেশে আর স্ত্রী থাকেন এখানে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে। অবশ্য এদের সংখ্যা খুবই কম। কানাডায় প্রফেশনাল জব না পেয়ে এদের কেউ কেউ গেছন যুক্তরাষ্ট্রে, কেউ কেউ মধ্যপ্রাচ্যে আবার কেউ কেউ বাংলাদেশে। বাংলাদেশে যারা ফিরে গেছেন তারা প্রধানত সরকারী চাকুরে।
মোহাম্মদ হোসেন নামের এক বাঙ্গালী প্রফেশনাল কানাডায় এসেছিলেন স্ত্রী পুত্রদের নিয়ে। পেশায় তিনি ছিলেন ডাক্তার। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কানাডায় তিনি নিজ পেশায় প্রবেশ করতে পারেন নি। পরে স্ত্রী ও পুত্রদের এখানে রেখে তিনি চলে যান ত্রিনিদাদে। সেখানে বছর দুই ডাক্তারী পেশায় চাকরী করার পর তিনি চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। অস্ট্রেলিয়ায় ডাক্তারী পেশায় জব পেতে তার কোন সমস্যা হয়নি। একই ডিগ্রি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি কানাডায় যে জব পান নি, সেই জব তিনি অস্ট্রেলিয়ায় পেয়ে যান। অস্ট্রেলিয়ার চিকিৎসা সেবার মান কানাডার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। পরে স্ত্রী পুত্রদেরও সেখানে নিয়ে যান হোসন সাহেব।
সোহরাব হোসেন (ছদ্ম নাম) পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। কানাডায় আসার পর নিজ পেশায় কোন চাকরী পাননি। কিন্তু একই ডিগ্রি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি চাকরী পান ইঞ্জিনিয়ারিং লাইনে। জব পারমিট নিয়ে পরে তিনি সেখানেই চলে যান স্ত্রী ও সন্তানদের কানাডায় রেখে। প্রায় প্রতি মাসেই আসতেন কানাডায়। চাকরীটা ছিল ডেট্রয়টে। টরন্টো থেকে ৫/৬ ঘন্টার ড্রাইভ। কন্ট্রাক্ট শেষ হয়ে যাওয়ার পর অবশ্য তিনি কানাডায় ফিরে আসেন। তিনি বলেন, পরিবারে বাবার দীর্ঘ অনুপস্থিতি ছেলে-মেয়েদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই তিনি পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার চেষ্টা করেন নি।
মোহাম্মদ সিরাজ একজন মৃত্তিকা বিজ্ঞানী। তবে তিনি চাকরী করতেন জাতি সংঘে। কানাডা আসার পর এখানকার চাকরী পরিস্থিতি দেখে তার ভাল লাগেনি। ফলে স্ত্রী, পুত্র-কন্যাদের এখানে রেখে তিনি আবার চলে যান জাতি সংঘের চাকরীতে। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পরে তিনি আবার কানাডায় ফিরে আসেন। তবে রিটায়ার্ড করার পর।
কাশেম চৌধুরী (ছদ্ম নাম) একজন কৃষি বিজ্ঞানী। কানাডায় এসেছিলেন তিনি প্রায় ২৫ বছর আগে। আসার পর তিনিও প্রফেশনাল জব না পেয়ে পরিবার রেখে চলে যান দূরপ্রাচ্যের একটি দেশে। তারপর এই দেশ থেকে ঐ দেশ। মাঝে মধ্যে কানাডায় এসে চেষ্টা করেছেন থাকার জন্য। কিন্তু ভাগ্য তাকে আনুকূল্য প্রদর্শন করেনি কোনবারই। ফলে প্রতিবার চেষ্টার পরই তাকে চলে যেতে হয়েছে কানাডার বাইরে। এই ভাবে তিনি তার ২৫ বছরের প্রবাস জীবনের ২০ বছরই কাটিয়ে দিয়েছেন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে। তার রিটায়ারমেন্ট এর বয়সও ঘনিয়ে এসেছে। বর্তমানে জাতি সংঘের একটি প্রজেক্টে কাজ করছেন আফ্রিকার একটি দেশে। দুই থেকে তিন মাস পর পর কানাডায় আসেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য।
এভাবে কিছু কিছু বাঙ্গালী পেশাজীবী কানাডার বাইরে গেলেও তাদের সংখ্যা খুব কম। ফলে মিসিসাগা স্টাইলে বাঙ্গালীদের কোন বেগম পাড়া গড়ে উঠেনি গ্রেটার টরন্টোর কোথাও। অল্প যে কয়টি পরিবার আছে তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন গ্রেটার টরন্টোর বিভিন্ন এলাকায়। বিশ্বায়ন এবং ইমিগ্রেশন এর ভিক্টিম এই পরিবারসমূহের মর্মবেদনা কেবল ঐ পরিবারের সদস্যরাই বলতে পারবেন। প্রতিনিয়ত প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে তাদেরকে এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে এগুতে হয়। স্বামীর অনুপস্থিতিতে সাংসারিক যাবতীয় কাজ সামাল দিতে হয় স্ত্রীকে। বাচ্চাদের স্কুলে আনা নেয়া, বাজার কারা, বিল দেয়া ইত্যাদি সবই করতে হয়। ছেলে-মেয়েরা একটু বড় হলে তারা বাইরে কার সঙ্গে মেলামেশা করছে তার উপরও নজর রাখতে হয়, যদিও তা সবসময় সম্ভব হয়ে উঠে না। বাবার অনুপস্থিতে কখনো কখনো সন্তানেরা বিশেষ করে ছেলেরা একটু বেশীমাত্রায় স্বাধীন হয়ে উঠে যা মায়ের পক্ষে সামাল দেয়া কঠিন হয়ে উঠে। এর পর আছে স্ত্রীর নিজের একাকিত্ব। এই একাকিত্বের যন্ত্রণা অপর পারের স্বামীকেও পোহাতে হয়।
আগের দিনের রীতি ছিল অর্থ আয়ের জন্য শুধু স্বামীরা বিদেশে যেতেন স্ত্রীদের স্বদেশে রেখে। পরে স্বামী স্ত্রী উভয়েই বিদেশ যাত্রা (মধ্যপ্রাচ্য) শুরু হলো। পরে সেখান থেকে আরো উন্নত জীবনের উদ্দেশ্যে আবারো শুরু হলো বিদেশ যাত্রা (ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া বা কানাডা)। এখানেই শেষ নয়, এরপর আবারো বিদেশ যাত্রা। তবে এবার সেই আগের দিনের মত, শুধু স্বামীর বিদেশ যাত্রা (তৃতীয় বা চতুর্থ কোন দেশে)। এটা কি বিশ্বায়ন এবং ইমিগ্রেশনের কুফল না সুফল? এই প্রক্রিয়া থেকে এই যে নতুন এক ‘বিশ্ব যাযাবর প্রজন্ম’ তৈরী হচ্ছে তাদের শেষ গন্তব্য কোথায়? জীবনের স্থিতি আসবে কখন তাদের?
এই বিশ্বায়ন, ইমিগ্রেশন এবং টরন্টোর জব মার্কেট পরিস্থিতির বাইপ্রোডাক্ট হলো বেগম পাড়া। গ্রেটার টরন্টোতে দুই ধরণের বেগম পাড়ার অস্তিত্ব রয়েছে। একটি হলো অতি ধনীদের স্ত্রী পুত্র কন্যাদের জন্য। অন্যটি হলো পেশাজীবীদের স্ত্রী পুত্র কন্যাদের জন্য। অতি ধনীদের সৃষ্ট বেগম পাড়ায় মর্মবেদনা হয়তো আছে, কিন্তু অসন্তোষ নেই। অন্যদিকে পেশাজীবীদের বেগম পাড়ায় মর্মবেদনার সঙ্গে অসন্তোষ, কায়ক্লেশ, সংকটকাল এ সবই আছে। স্বামীদেরকে বিসর্জন দিতে হচ্ছে স্ত্রী ছেলে-মেয়ে এদের নৈকট্য আর স্নেহ ভালবাসা। পাশাপাশি এই নৈকট্য আর স্নেহ ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েরাও। এ এক অদ্ভূত ও অস্বাভাবিক জীবন। এ জীবন পরিবারের সকলের জন্যই কষ্টের জীবন, কঠিন জীবন। ‘লং-ডিস্টেন্স’ এর এই বিবাহিত জীবনে আবার মাঝে মধ্যে উকি ঝুকি মারে ইনফাইডিলিটি বা বিশ্বাসহীনতা। বিশ্বাসহীনতা এক ছাদের তলায় বাস করলেও হতে পারে। কিন্তু এক দেশ থেকে আরেক দেশের বিশাল দূরত্ব এই বিশ্বাসহীনতাকে যেন আরেকটু বেশী বলবান করে তুলে সময়ে সময়ে।
এভাবে সবকিছু মিলিয়ে এই ‘বিশ্ব যাযাবর প্রজন্মের’ মধ্যে যে স্ট্রেস ও প্রেসার সৃষ্টি হয় তা থেকে উদ্বেগ আর বিষন্নতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশী। যার পরিণতিতে কখনো কখনো এইসব পরিবারে নেমে আসতে পারে নানারকম বিপর্যয়।
কিন্তু এর জন্য দায়ী কে? পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা? সে ব্যবস্থার সহযোগী বিশ্বায়ন? নাকি কানাডার ইমিগ্রেশন পলিসি?
দায়ী কমবেশী সবাই। তবে প্রধান আসামী হিসাবে দাড় করানো যেতে পারে কানাডার এম্পøয়ারদের নাক উঁচু ভাবকে। ফরেইন ট্রেইন্ড এই সকল ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যন্য পেশাজীবীদেরকে কানাডার এম্পøয়ারগণ গুরুত্ব দেন না। তাদের ধারণা কানাডীয় পেশাজীবীদের তুলনায় এই সকল বিদেশী পেশাজীবীদের মান তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীর কিংবা তারো নিচে। এদের ‘কানাডিয়ান এক্সপরিয়েন্স’ নেই এই অজুহাত তুলে কর্মক্ষেত্র থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। বস্তুত কানাডার চাকরী বাজারে নতুন আসা ইমিগ্রেন্টদেরকে চূড়ান্তভাবে অপদস্থ ও অসম্মান করার এক বুলির নাম হলো ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’। লক্ষ লক্ষ পেশাজীবী ইমিগ্রেন্টদেরকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে চাকরীর বাজারে “কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স” নেই এই অজুহাত তুলে। এটি শুধু অপমান ও অপদস্থ করা নয়, নতুন আসা ইমিগ্রেন্টদের মানবাধিকারও লংঘন করা হচ্ছে। অন্টারিও হিউম্যান রাইটস কমিশনও ইতিপূর্বে এর নিন্দা জানিয়েছে এবং তাদের নতুন এক পলিসিতে এই অভিমত দিয়েছে যে এটি নিশ্চিতভাবেই ইমিগ্রেন্টদের মানবাধিকার লংঘন।
কর্ম ক্ষেত্রে “কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স” এর যে অজুহাত তোলা হয় তার পিছনে বর্ণবাদও কাজ করে বলে অনেকে মনে করেন। এই বর্ণবাদী আচরণ ও মানবাধিকার লংঘন থেকেই গ্রেটার টরন্টোতে একজাতীয় বেগম পাড়া সৃষ্টি হয়েছে। ইমিগ্রেন্টদের স্বার্থে এবং একই সাথে কানাডার বৃহত্তর স্বার্থে এই ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’ নামক অযাচিত, অশোভন, অলীক ও অপমানজনক বুলি যা একই সাথে বর্ণবাদ ও মানবাধিকার লংঘন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে তাকে এখনি দূরে ঠেলে দিতে হবে। নয়তো কানাডার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন পদে পদে বাধাগ্রস্ত হবে