বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২০
প্রথম পাতা » অপরাধ | ব্রেকিং নিউজ | শিক্ষা ও ক্যারিয়ার » চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির এক বছর: ভুক্তভোগী পরিবারগুলো পায়নি কোনও সহযোগিতা
চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির এক বছর: ভুক্তভোগী পরিবারগুলো পায়নি কোনও সহযোগিতা
‘ভেতরে সব পুইড়া মরল। শুধু দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেখলাম। কিছুই করতে পারলাম না।’
পুরান ঢাকার চকবাজারের চুরিহাট্টার ভয়ঙ্কর আগুন ট্রাজেডি নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী নেসার হোসেন এভাবেই মনের অনুভূতি ব্যক্ত করেন।
নেসার হোসেন আরো বলেন, ‘সকালে শুধু তাদের বীভৎস লাশগুলো দেখলাম। ভবনটির চার এবং পাঁচতলায় মানুষ বসবাস করত। আগুন থেকে বাঁচতে অনেককে উপর থ্যাইকা লাফইয়া পড়ে। আমার ৬০ বছর জীবনে এমন আগুন কখনো দেখিনি।’
এটি এক বছর আগের ঘটনা। ২০১৯ সালের এই দিনে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুরিহাট্টার ভয়ঙ্কর আগুন ট্রাজেডিতে ৭২ জন মারা যান।
জীবন্ত মানুষ পুড়ে নিথর দেহ কিংবা বিস্ফোরণে দেহ উড়ে গিয়ে রাস্তায় পড়েছিল হাত-পা। ভবন ও যানবাহন পুড়ে হয়েছিল কঙ্কাল সার।
বাতাসের সঙ্গে উড়ছিল ভয়ঙ্কর আগুনের লেলিহান শিখা। পুরো চুরিহাট্টা পরিণত হয় ধ্বংসস্তুপে।
সেদিনের ঘটনার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে অহেদ ম্যানশন ভবনে আগুন লাগে। প্রথম থেকে তৃতীয়তলা পর্যন্ত ছিল বিভিন্ন মার্কেট এবং গোডাউন। সেখানে কেমিক্যাল ছিল। ক্ষণে ক্ষণে সেগুলোর বিস্ফোরণ ঘটে। আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
ধোঁয়ার কুণ্ডুলিতে পুরো চকবাজার এলাকায় ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। ভবনটির আশপাশের ভবনের বাসিন্দারা সেখান থেকে নিরাপদ স্থানে যেতে ছোটাছুটি করতে থাকেন। ভবনের আগুন পড়ে ছড়িয়ে আশপাশের ভবনেও। এ সময় যারা ভবনের ভেতর এবং চুরিহাট্টার রাস্তায় কিংবা দোকান, হোটেলে ছিলেন তারা আগুনে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। সেখানেই তাদের মৃত্যু হয়।
আগা সাদেক লেনের বাসিন্দা মোশাররফ মিয়া বলছিলেন, ‘পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া যানবাহনের লোহালক্কড়, ভেঙে পড়া দেয়াল আর বিভিন্ন ধরনের আবর্জনার স্তুপে পরিণত হয়। লাশ পচা ও কেমিক্যালের মারাত্মক গন্ধে বাস অযোগ্য হয়ে পড়ে।’
স্থানীয়রাদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, দমকল বাহিনীর ৩৭টি ইউনিটের নিরলস চেষ্টার পর রাত সাড়ে ৩টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। সকাল বেলা শুরু হয় উদ্ধার অভিযান। রাস্তা বা দোকান. হোটেল বা ভবনের কক্ষ থেকে একে একে বের হয়ে আসতে থাকে পোড়া লাশ। বিভৎস পুড়ে চেনার উপায় নেই। অনেক মাংস পুড়ে কঙ্কাল হয়ে যায়। অনেকেই নিখোঁজ ছিলেন। যাদের খোঁজে স্বজনেরা ভিড় করছিলেন। তাদের আহাজারিতে চুরিহাট্টার বাতাস ভারি হয়ে উঠে। এখনও সেদিনের ভয়াবহ স্মৃতি অনেককে তাড়া করে।
ঢামেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, চুরিহাট্টায় নিহত ৬৭টি লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। ৪৫টি মরদেহ প্রাথমিকভাবেই শনাক্ত এবং তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২২টি মরদেহের মধ্যে ডিএনএ নমুনার মাধ্যমে ১৯টি শনাক্ত করা হয়। মর্গে ৬৮টি মরদেহ ভর্তি ব্যাগ পাঠায় চকবাজার থানা পুলিশ। সেখানে একটি ব্যাগে মরদেহের হাত ছিল শুধু। স্বজনরা চেহারা, জামাকাপড়, একটির বুকের পুরাতন অপারেশনের সেলাই দেখে শনাক্ত করতে পেরেছিল। ২২টি মরদেহ পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়ায় সেগুলোর নমুনা সংগ্রহ করে ডিএনএ ল্যাবে পাঠানো হয়। পরবর্তীকালে সেখান থেকে ১৯টি মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়।
এদিকে তখন বলা হয় ভবনের নিচে মাইক্রোবাস ও পিকআপের মধ্যে সংঘর্ষের পর সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ওই ভবনে আগুনের সূত্রপাত। অবশ্য পরে আগুনের কারণ বের করতে মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন এবং সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি তদন্ত করলেও এক বছরেও কারো তদন্ত শেষ হয়নি। আগুনের সূত্রপাতও জানা যায়নি।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস সিভিল অ্যান্ড ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, ‘২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ আগুনে ঘটনাকেও হার মানিয়েছে চুরিহাট্টা। পার্শ্ববর্তী পাঁচ ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়লেও পরে তা নিয়ন্ত্রণে আনায় হতাহতের সংখ্যা অনেক কম হয়েছে। প্রচুর পরিমাণে দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুনে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।’