
শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫
প্রথম পাতা » ব্রেকিং নিউজ » খুন-রগকাটা-অগ্নিসংযোগ-ধ্বংসযজ্ঞের আরেক নাম জামায়াত-শিবির
খুন-রগকাটা-অগ্নিসংযোগ-ধ্বংসযজ্ঞের আরেক নাম জামায়াত-শিবির
অনলাইন নিউজ ডেস্ক : জামায়াত-শিবির! নাম শুনলেই বাঙালির মানসপটে ভেসে ওঠে মহান একাত্তরে পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের তাণ্ডবলীলা। যুদ্ধাপরাধই এই সংগঠনের একমাত্র অপরাধ নয়। স্বাধীন দেশে সন্ত্রাসবাদের রাজনীতির কায়েম করেছে জন্মের পর মোট চারবার নিষিদ্ধ হওয়া এই দলটি। খুন-রগকাটা-অগ্নিসংযোগ-ধ্বংসযজ্ঞের আরেক নাম জামায়াত-শিবির। মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক রাজনীতিরও ধারক বাহক এই সন্ত্রাসী সংগঠন। অবশেষে স্বাধীন বাংলাদেশে দ্বিতীয় বারের মতো নিষিদ্ধ হলো জামায়াত-শিবির। ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮(১) ধারা অনুযায়ী নিষিদ্ধ করা হয়েছে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারানো জামায়াত ইসলামীকে। ওই আইন অনুযায়ী, জামায়াত এবং এর সকল অঙ্গ সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী সত্তা’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে ২০২৪ সালের ১ আগষ্ট বৃহস্পতিবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী এই সন্ত্রাসী দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলো বাংলাদেশে। যদি নিষিদ্ধ জামায়াত-শিবিরের কেউ কোনো কর্মকাণ্ড করে, তাহলে তা সন্ত্রাসী আচরণ গণ্য করে আইন অনুযায়ী বিচার করবে সরকার।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির রাজনৈতিক দলগুলোর মতে, শুধু নিষিদ্ধই নয়, দলটির সশস্ত্র নেতাকর্মীদের চিহ্নিত করে এদের নিষ্ক্রিয় করতে হবে। নতুবা সমাজে ঘাপটি মেরে আবারো ছোবল মারার সুযোগ খুঁজবে। জামায়াতের অর্থ জোগানদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো, বিদেশি সংযোগগুলোকেও চিহ্নিত করে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে। নিষিদ্ধের পর পর্যায়ক্রমে এই বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা জরুরি। নিষিদ্ধ ঘোষণার পর জামায়াত-শিবির আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে ধ্বংসের চেষ্টা করবে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, এদের মোকাবিলা করতে হবে ‘জঙ্গি সংগঠন’ হিসেবে। বাংলার মাটিতে জঙ্গিদের ঠাঁই হবে না। আমাদের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। আমি দেশবাসীর সহযোগিতা চাই।
জামায়াতে ইসলামী ও তার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির নিষিদ্ধ । সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধের পর এই দলের কাউকে আদালত ছাড়া অপরাধী হিসেবে সরকার শাস্তি দিতে পারে কিনা- নিষিদ্ধ করার পরও তাকে সাজা দেয়া যাবে না- এমনটি নয়।জামায়াত-শিবির এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে দল, জামায়াত আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে পারে ।
নিষিদ্ধের আদেশ যেভাবে এলো : স্বাধীনতাবিরোধী এই দলকে ১৯৭২ সালে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহারের’ কারণে। আর এবার দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে জন নিরাপত্তার জন্য হুমকি বিবেচনা করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম এ প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেছেন। পরে প্রজ্ঞাপনটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এর আগে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আইনি মতামত দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠায় আইন মন্ত্রণালয়। কোটা আন্দোলনের আড়ালে দেশব্যাপী সংঘাত-সহিংসতায় সম্পৃক্ত থাকার অপরাধে জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে একমত হন ১৪ দলীয় জোটের নেতারা। ২৯ জুলাই গণভবনে অনুষ্ঠিত ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন শেখ হাসিনা। পরদিন মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) আনিসুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। আইন মন্ত্রণালয় আইনগত মতামত দেয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করবে।
প্রজ্ঞাপনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় জামায়াত ও শিবিরকে যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে দায়ী করা এবং নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিলে আপিল বিভাগের রায়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারের নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (পূর্বনাম জামায়াত-ই-ইসলামী/ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং এর অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে (পূর্বনাম ইসলামী ছাত্রসংঘ) ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। পাশাপাশি হাইকোর্ট এক রিট মামলার রায়ে রাজনৈতিক দল হিসাবে নির্বাচন কমিশনে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগও তা বহাল রেখেছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ আছে, সাম্প্রতিক সংগঠিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জামায়াত ও শিবির সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল। সরকার বিশ্বাস করে, জামায়াত-শিবিরসহ এদের সব অঙ্গ সংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত। এজন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮(১) ধারা এবং তফসিল-২ অনুযায়ী, জামায়াত ইসলামী ও ছাত্রশিবিরসহ এর অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর হবে বলেও প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে। এ আইনে কোনো অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।
কোটা আন্দোলনে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব : সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যে পর্যায়ে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে এর জন্য সরকার জামায়াত-শিবিরকেই দায়ী করছে। এ সহিংসতায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক হতাহত হন। দেশজুড়ে সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ২৬৬ জন। সরকারের বক্তব্য, শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা ছদ্মবেশে প্রবেশ করে সহিংসতা উসকে দেয়। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয় রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম বিটিভি, বনানীর সেতু ভবন, মহাখালীর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন, মেট্রোরেল স্টেশনসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায়।
জামায়াতের একাত্তরনামা : একাত্তরে ঘৃণ্য রাজনৈতিক দলের নাম জামায়াত-শিবির। একাত্তরের মৃত্যু উপত্যকা বাংলাদেশের বিভীষিকা ছিল পাকিস্তানি সেনাদের দোসর জামায়াত-শিবির। গ্রামের পর গ্রামে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দেয়া, হত্যা, নারীদের খানসেনাদের হাতে তুলে দিয়ে কলঙ্কিত করেছে বাংলা মাকে। বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নে পাকিস্তানিদের দোসর এই জামায়াত-শিবির। একাত্তরের গণহত্যায় জামায়াতের ঘৃণ্য অপরাধের তথ্য উঠে এসেছে যুদ্ধাপরাধীরে বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণেও। গোলাম আযম, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আব্দুল কাদের মোল্লা ও এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও মাওলানা আব্দুস সোবহানের মামলার রায়েও একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি উঠে আসে।
‘ক্রিমিনাল’ সংগঠন জামায়াত : প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনবার নিষিদ্ধ হয়েছে জামায়াত ইসলামী। ব্রিটিশ ভারতে ১৯৪১ সালে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান আমলে দুইবার এই দল নিষিদ্ধ হয়। প্রথমবার ১৯৫৯ সালে, দ্বিতীয়বার ১৯৬৪ সালে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান সংবিধান পরিবর্তন করায় আবারো বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পায় জামায়াত।
তরিকত ফেডারেশনের নেতা রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ কয়েকজনের রিট আবেদনে হাইকোর্ট ২০১৩ সালে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ঘোষণা করেন। একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল, দেশের কোনো সংস্থার শীর্ষ পদে স্বাধীনতাবিরোধীদের থাকা উচিত নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও জিয়াউর রহমানের সরকার আবার জামায়াতকে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ করে দেয়। একাত্তরে ন্যক্কারজনক ভূমিকার পরও খালেদা জিয়ার চার দলীয় জোট সরকারের সময়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেয়াকে লাখো শহীদের প্রতি ‘চপেটাঘাত’ হিসেবে বর্ণনা করা হয় যুদ্ধাপরাধের এক মামলার রায়ে।
মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতের আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে এ মত দেন বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতাবিরোধী চেতনা ও সা¤প্রদায়িক অনুভূতির মানসিকতায় বেড়ে উঠছে, যা দেশের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয়। রায়ে বলা হয়, একটি গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়তে সরকারের নির্বাহী বিভাগ, সরকারি বেসরকারি সংগঠনসহ সামাজিক ও রাজনৈতিক দলের কর্ণধার হিসেবে এ ধরনের স্বাধীনতা বিরোধীরা থাকা উচিত নয়। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদে স্বাধীনতাবিরোধীরা যাতে না আসতে পারে, সেজন্য সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।
২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত লিভ টু আপিল আপিল করলে ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রাখে। ফলে দলটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার অধিকার হারায়। তবে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না।
চার দশকের দাবি পূরণ : যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবি দীর্ঘদিনের। স্বাধীনতার পর জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরে সেনাশাসক জিয়াউর রহমান তাদের রাজনৈতিক অধিকার ফেরত দেন। এরপর নব্বই দশকে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলন থেকে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি ওঠে। প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে একাত্তরের স্বাধীনতা বিরোধী ও ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জোরালো ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়ার পর ওই দাবি শক্তিশালী হয়। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় তা আরো জোরালো হয়। গত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সময়ে একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াত নিষিদ্ধের পক্ষে মত দিয়েছেন। কিন্তু দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি অপূর্ণই ছিল এতদিন।
তবে দেরিতে হলেও জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করায় স্বাগত জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার লড়াইকে এগিয়ে নেয়ার দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা, লেখক, গবেষক শাহরিয়ার কবির বলেন, এটি পুরো জাতির বিজয়। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সব শক্তি দীর্ঘদিন ধরে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে এসেছেন। নির্মূল কমিটির এক সভায় প্রধানমন্ত্রী (তখন বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন) শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বুকের রক্ত দিয়ে হলেও যুদ্ধাপরাধীর বিচার করবো। জামায়াত নিষিদ্ধ করব। তিনি তার কথা রেখেছেন। এজন্য শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা জানাই। শাহরিয়ার কবির বলেন, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ রাষ্ট্রকে নিরাপদ রাখার জন্য, দক্ষিণ এশিয়াকে নিরাপদ রাখার জন্য। এখন এরা আইনের চোখে অপরাধী। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মাধ্যমেই সন্ত্রাসী এই সংগঠনের অর্থের উৎসগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে। মৌলবাদের অর্থনীতি নির্মূল করা জরুরি।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসির মামুন বলেন, দেরিতে হলেও সরকার যে এই কাজটি করেছে সেটিকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে গত ২০ বছরে তারা যে আর্থিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে, সেটাকে সরকার কীভাবে মোকাবিলা করবে, এটি দেখার বিষয়। এছাড়া একটা অভিঘাত হবে দেশে এবং দেশের বাইরে। এই অভিঘাত সামলানোর জন্য সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। এটি একা আওয়ামী লীগ পারবে না। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে অবশ্যই সমমনা রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি এবং তরুণ সমাজকে সঙ্গে নিতে হবে। নিজের দলেও অনুপ্রবেশকারী জামায়াত-শিবির থেকে মুক্ত করতে হবে। এটি শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ করতে পারবেন না।
আইনগতভাবেই জামায়াত-শিবিরকে মোকাবিলা : নতুন কোনো ষড়যন্ত্রে হলে নিষিদ্ধ সংগঠন জামায়াত-শিবিরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবেই আইনগতভাবে মোকাবিলা করবে সরকার। জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়ার পর তাদের সদস্যদের কী হবে, তারা ফৌজদারি আইনে অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে কিনা, এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, এই দলের অধীন তারা রাজনীতি করতে পারবেন না। তারা যদি বাংলাদেশের কোনো আইনে অপরাধ করে থাকে, অবশ্যই তাদের বিচার হবে। কিন্তু এটা যদি বলেন, গণহারে জামায়াতের যারা নতুন কর্মী, যারা ১৯৭১ সালের পর জন্ম নিয়েছেন, তাদের বিচার করা হবে না, এমন গণহারে বিচার করা হবে না।
জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ কেনজামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ কেন
আমরা জানি সংবিধানের সঙ্গে গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। এ ছাড়া একাত্তরে ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করে দেশের কোনো সংস্থার শীর্ষ পদে স্বাধীনতাবিরোধীদের থাকা উচিত নয় বলে মত জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতের আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে এই মত দিয়েছিলেন বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল। গোলাম আযমের আগে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আব্দুল কাদের মোল্লা ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানের মামলার রায়েও একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি উঠে আসে।
ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, ‘সাধারণ জ্ঞান ও দালিলিক প্রমাণাদি থেকে এটা স্পষ্ট যে, জামায়াত ও এর অধীনস্থ সংগঠনের প্রায় সবাই সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছে। গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী একটি ক্রিমিনাল দল হিসবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাজ করেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়।’
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতার সময় গোলাম আযমের ‘গুরু’ আবুল আলা মওদুদী তার বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় সেই ধরনের ভূমিকাই ছিল গোলাম আযমের। জামায়াত দুই সময়েই সাধারণ মানুষের মন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল মন্তব্য করে ট্রাইব্যুনাল দলটির দূরদৃষ্টির অভাবের পেছনে উগ্র মৌলবাদী চেতনাকেই চিহ্নিত করেছে।
স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও স্বাধীনতাবিরোধী কিছু মানুষ জামায়াতের হাল ধরে আছেন। যার ফলে জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতাবিরোধী চেতনা ও সাম্প্রদায়িক অনুভূতির মানসিকতায় বেড়ে উঠছে, যা দেশের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, ট্রাইব্যুনাল কী বলেছিল, ‘একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীরা শহীদদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে কিংবা অনুশোচনা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছেন বলে কোনো প্রমাণ জাতির সামনে নেই।’ সেই রায়ে আরও বলা হয়েছিল, ‘একটি গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়তে সরকারের নির্বাহী বিভাগ, সরকারি-বেসরকারি সংগঠনসহ সামাজিক ও রাজনৈতিক দলের কর্ণধার হিসেবে এ ধরনের স্বাধীনতাবিরোধীরা থাকা উচিত নয়। এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদে স্বাধীনতাবিরোধীরা যাতে না আসতে পারে, সে জন্য সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন ১১ দফাসহ বিভিন্ন দাবির বিরোধিতা করে জামায়াত। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ নামে বিভিন্ন দল গঠন করে জামায়াত ও এর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ। তারা সারা দেশে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের মতো যুদ্ধাপরাধ ঘটায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত ঘোষিত ছয়টি রায়েই বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি, হত্যাকাণ্ডে সায় ও সহযোগিতা দেয়ার দায়ে জামায়াতে ইসলামীর তখনকার আমির গোলাম আযমকে টানা ৯০ বছর অথবা আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। অতএব, আমরা বলতে চাই, জামায়াতে ইসলামী আগাগোড়াই একটি অবৈধ সংগঠন- সেই একাত্তর সাল থেকেই। একে যে বৈধতা দেয়া হয়েছে, সেটা প্রথমবারও ছিল অবৈধ, দ্বিতীয়বারও তাই।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় দেয়ার পর থেকে দেশজুড়ে অনেক দিন জামায়াতের সহিংসতা চলেছে। তারা আমাদের যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নানা ধরনের নাশকতা চালিয়েছে। আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে ও জনমনে আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা চালিয়েছে। পুলিশ সদস্যদের পর্যন্ত হত্যা করেছে। সে ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে জামায়াতে ইসলামীর মতো যুদ্ধাপরাধ সংঘটনকারী একটি দল এভাবে রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর অধিকার রাখে না।
বিশ্ব ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব, যেসব সংগঠন গণহত্যা পরিচালনা করেছিল, সেগুলো যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গণ্য হয়েছে। আর প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধী কোনো সংগঠন এমনিতেই অবৈধ হয়ে যায়। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জার্মানিতে নাজি পার্টিকে এবং বর্ণবাদী কাজকর্মের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ক্লু-ক্লাক্স-ক্লান নামের একটি পার্টিকে অনন্তকালের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশেও সন্ত্রাসী কাজকর্ম পরিচালনার জন্য চিরতরে নিষিদ্ধ হয়েছে হিজবুত তাহরির ও হরকাতুল জিহাদের মতো সংগঠন। জামায়াতে ইসলামী কোনো রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। যদি আল-কায়েদা বা তালেবানের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনকে বিশ্বজুড়ে নিষিদ্ধ করা হয়, তবে জামায়াত কেন নয়?
সর্বশেষ আমরা মনে করি, ২০১৩ সালে ফেব্রুয়ারিতে বাঙালির যে গণজাগরণ হয়েছিল কসাই কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে, সেই গণজাগরণের ৬ দফার একটি ছিল যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন জামায়াতকে দ্রুত নিষিদ্ধ করতে হবে। যেটি স্বাধীনতার পক্ষের সব মানুষের গণদাবিতে পরিণত হয়েছিল। অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ আমরা আরও বেশি শক্তিশালী ও স্বনির্ভর। সময় এসেছে স্বাধীনতাবিরোধীদের সমূলে উৎপাটন করার। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশে কোনো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রাজনীতি করার অধিকার পেতে পারে না। কোনো যুদ্ধাপরাধী সংগঠনের নেতা-কর্মী বাংলাদেশে কেউ রাজনীতি করুক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী তরুণ প্রজন্ম তা চায় না।
যে কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন যদি কোনো কাজ করে সেটি দেশের আইনেই দমন করা হবে। অন্যান্য গোপন সংগঠন বা জঙ্গি সংগঠনগুলো যেভাবে মোকাবিলা করা হয়েছে, সেভাবেই জামায়াত-শিবিরকে মোকাবিলা করা হবে।
জামায়াত মদিনার নয় মওদুদীর ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়: আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেমের আমীর আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী পূর্বসূরী আলেম মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ.) এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, জামায়াতে ইসলাম সকল ভ্রান্ত ফেরকা সমূহের মধ্যে নিকৃষ্ট দল।
এমনকি তারা কাদিয়ানী সম্প্রদায় থেকেও নিকৃষ্ট। কেননা জামায়াতে ইসলামের দ্বারা ইসলামের যে ক্ষতি হয়েছে, কাদিয়ানীদের দ্বারাও সে ক্ষতি হয়নি। আমরা জামায়াতে ইসলামকে ইসলামী দল মনে করি না। জামায়াতে ইসলাম মদিনার ইসলাম চায়না, তারা মওদুদীর ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়। হেফাজতে ইসলাম ফেনী জেলা শাখার উদ্যোগে ফেনী মিজান ময়দানে সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী এসব কথা বলেন।