জামায়াতে ইসলামী ক্রিমিনাল দল
এফ এম শাহীন : আমরা জানি সংবিধানের সঙ্গে গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। এ ছাড়া একাত্তরে ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করে দেশের কোনো সংস্থার শীর্ষ পদে স্বাধীনতাবিরোধীদের থাকা উচিত নয় বলে মত জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতের আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে এই মত দিয়েছিলেন বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল। গোলাম আযমের আগে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আব্দুল কাদের মোল্লা ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানের মামলার রায়েও একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি উঠে আসে।
ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, ‘সাধারণ জ্ঞান ও দালিলিক প্রমাণাদি থেকে এটা স্পষ্ট যে, জামায়াত ও এর অধীনস্থ সংগঠনের প্রায় সবাই সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছে। গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী একটি ক্রিমিনাল দল হিসবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাজ করেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়।’
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতার সময় গোলাম আযমের ‘গুরু’ আবুল আলা মওদুদী তার বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় সেই ধরনের ভূমিকাই ছিল গোলাম আযমের। জামায়াত দুই সময়েই সাধারণ মানুষের মন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল মন্তব্য করে ট্রাইব্যুনাল দলটির দূরদৃষ্টির অভাবের পেছনে উগ্র মৌলবাদী চেতনাকেই চিহ্নিত করেছে।
স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও স্বাধীনতাবিরোধী কিছু মানুষ জামায়াতের হাল ধরে আছেন। যার ফলে জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতাবিরোধী চেতনা ও সাম্প্রদায়িক অনুভূতির মানসিকতায় বেড়ে উঠছে, যা দেশের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, ট্রাইব্যুনাল কী বলেছিল, ‘একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীরা শহীদদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে কিংবা অনুশোচনা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছেন বলে কোনো প্রমাণ জাতির সামনে নেই।’ সেই রায়ে আরও বলা হয়েছিল, ‘একটি গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়তে সরকারের নির্বাহী বিভাগ, সরকারি-বেসরকারি সংগঠনসহ সামাজিক ও রাজনৈতিক দলের কর্ণধার হিসেবে এ ধরনের স্বাধীনতাবিরোধীরা থাকা উচিত নয়। এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদে স্বাধীনতাবিরোধীরা যাতে না আসতে পারে, সে জন্য সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন ১১ দফাসহ বিভিন্ন দাবির বিরোধিতা করে জামায়াত। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ নামে বিভিন্ন দল গঠন করে জামায়াত ও এর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ। তারা সারা দেশে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের মতো যুদ্ধাপরাধ ঘটায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত ঘোষিত ছয়টি রায়েই বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি, হত্যাকাণ্ডে সায় ও সহযোগিতা দেয়ার দায়ে জামায়াতে ইসলামীর তখনকার আমির গোলাম আযমকে টানা ৯০ বছর অথবা আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। অতএব, আমরা বলতে চাই, জামায়াতে ইসলামী আগাগোড়াই একটি অবৈধ সংগঠন- সেই একাত্তর সাল থেকেই। একে যে বৈধতা দেয়া হয়েছে, সেটা প্রথমবারও ছিল অবৈধ, দ্বিতীয়বারও তাই।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় দেয়ার পর থেকে দেশজুড়ে অনেক দিন জামায়াতের সহিংসতা চলেছে। তারা আমাদের যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নানা ধরনের নাশকতা চালিয়েছে। আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে ও জনমনে আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা চালিয়েছে। পুলিশ সদস্যদের পর্যন্ত হত্যা করেছে। সে ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে জামায়াতে ইসলামীর মতো যুদ্ধাপরাধ সংঘটনকারী একটি দল এভাবে রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর অধিকার রাখে না।
বিশ্ব ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব, যেসব সংগঠন গণহত্যা পরিচালনা করেছিল, সেগুলো যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গণ্য হয়েছে। আর প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধী কোনো সংগঠন এমনিতেই অবৈধ হয়ে যায়। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জার্মানিতে নাজি পার্টিকে এবং বর্ণবাদী কাজকর্মের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ক্লু-ক্লাক্স-ক্লান নামের একটি পার্টিকে অনন্তকালের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশেও সন্ত্রাসী কাজকর্ম পরিচালনার জন্য চিরতরে নিষিদ্ধ হয়েছে হিজবুত তাহরির ও হরকাতুল জিহাদের মতো সংগঠন। জামায়াতে ইসলামী কোনো রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। যদি আল-কায়েদা বা তালেবানের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনকে বিশ্বজুড়ে নিষিদ্ধ করা হয়, তবে জামায়াত কেন নয়?
সর্বশেষ আমরা মনে করি, ২০১৩ সালে ফেব্রুয়ারিতে বাঙালির যে গণজাগরণ হয়েছিল কসাই কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে, সেই গণজাগরণের ৬ দফার একটি ছিল যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন জামায়াতকে দ্রুত নিষিদ্ধ করতে হবে। যেটি স্বাধীনতার পক্ষের সব মানুষের গণদাবিতে পরিণত হয়েছিল। অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ আমরা আরও বেশি শক্তিশালী ও স্বনির্ভর। সময় এসেছে স্বাধীনতাবিরোধীদের সমূলে উৎপাটন করার। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশে কোনো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রাজনীতি করার অধিকার পেতে পারে না। কোনো যুদ্ধাপরাধী সংগঠনের নেতা-কর্মী বাংলাদেশে কেউ রাজনীতি করুক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী তরুণ প্রজন্ম তা চায় না।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, গৌরব ’৭১ ও প্রধান সম্পাদক, জাগরণ টিভি