অভিজিৎ হত্যা: সিসি ক্যামেরায় ৫ জন চিহ্নিত
পক্ষকাল প্রতিবেদকঃসিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায় হত্যকাণ্ডে সন্দেহভাজনদের চিহ্নিত করেছেন র্যাবের গোয়েন্দারা।
সূত্র জানিয়েছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বইমেলার ৭০টি সিসিটিভির মধ্যে তিনটি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে পাঁচ সন্দেহভাজনের বিষয়ে অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছেন গোয়েন্দারা। তিনটি ক্যামেরার ১৫ মিনিটের ফুটেজে দেখা যায়, অভিজিৎ ও বন্যা বিভিন্ন স্টলের সামনে দিয়ে হাঁটছেন। এসময় পাঁচ ব্যক্তি তাদের কাছাকাছি থেকে অনুসরণ করছেন। তাদের পরনে ছিলো টি-শার্ট জিন্স প্যান্ট, শার্ট নরমাল প্যান্ট। সন্দেহভাজনদের পরিচয় নিশ্চিত করতে ফুটেজের ছবিগুলো জুম করে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
অভিজিৎ হত্যা মামলায় আটক উগ্র জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী ব্লগার শফিউর রহমান ফারাবী অভিজিৎ-এর খুনিদের পরিচয় জানে বলে জানিয়েছে র্যাব। এছাড়া তার নিজের ফেইসবুক আইডিতে নানা উস্কানিমূলক স্ট্যাটাস রয়েছে। যেখানে বলা হয়, ‘সব কয়টা নাস্তিককে কুপিয়ে ফালা ফালা করে দেওয়া প্রয়োজন। …অভিজিতের বাপরে আগে মারতে হবে। ওকে যদি পাই… জাহান্নামে পাঠিয়ে আমি ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে চাই।’ ফেইসবুকে সহযোগীদের এমন উস্কানিমূলক মন্তব্যের পর ফারাবী তাদের উদ্দেশে গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি মন্তব্য করেন, ‘অভিজিৎ রায় আমেরিকা থাকে। তাই তাকে এখন হত্যা করা সম্ভব না। তবে সে যখন দেশে আসবে তখন তাকে হত্যা করা হবে।’ সোমবার ভোরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে গ্রেফতারের পর র্যাব কর্মকর্তারা তার কাছ থেকে এসব তথ্য জানতে পারেন।
র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে ফারাবী ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল কিনা সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জানা যাবে। তাছাড়া এ হত্যাকাণ্ডটি তাদের সুপরিকল্পিত। ফলে হত্যাকাণ্ডের পরপরই খুনিরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ফারাবীও ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
মুফতি মাহমুদ বলেন, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে ফারাবী নিবীরভাবে জড়িত। এতে কোনও সন্দেহ নেই। এক ফেসবুক ফ্রেন্ডকে অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী ও কন্যাসহ একটি ছবি পোস্ট করে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে ফারাবী লিখেন, ‘এটাই হলো অভিজিৎ রায়, তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা ও তার মেয়ের ছবি। এরা সবাই আমেরিকার লুসিয়ানা প্রদেশের নিউ অরলিনস সিটিতে থাকে।’ অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর পরই ফারাবীকে তার এক ফেসবুক ফ্রেন্ড অভিজিতের রক্তাক্ত ছবি পাঠিয়ে বলে যে, ‘ছবি পাইছেন কি?’ উত্তরে ফারাবী ছবি পেয়েছে বলে জানায়। এরপর ওই ফেসবুক ফ্রেন্ড ফারাবীর অনুভূতি জানতে চাইলে সে বলে যে, ‘আমি গ্রেফতার হবো কাল পরশুর মাঝে’। তাছাড়া ফারাবীকে গ্রেফতার করায় অভিজিৎ কিলিং মিশনে সরাসরি জড়িতদের চিহ্নিত করা সহজ হবে।
র্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, বাংলা বই বিক্রির ওয়েবসাইট ‘রকমারি ডটকম’ থেকে অভিজিৎ রায়ের বই সরাতে হুমকি দিয়েছিলেন ফারাবী। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ আন্দোলনের কর্মী ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার খুন হন। যে ইমাম রাজীবের জানাজা পড়িয়েছেন তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেন ফারাবী। এরপর তাকে ২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেইট থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ফেইসবুক ব্যবহার করে ইমামকে হত্যার হুমকি দেওয়ায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে জুন মাসে ঢাকার একটি আদালত তার বিরুদ্ধে অভিযোগও গঠন করেন। পরে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে ২০১৩ সালের ২১ অাগস্ট কারাগার থেকে মুক্তি পান ফারাবী। মুক্তি পেয়েই ‘নাস্তিকদের’ হত্যাকাণ্ড সমর্থন করে তিনি ফেইসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, ‘আমার দৃষ্টিতে নাস্তিকরা হচ্ছে পোকামাকড় আর পোকামাকড়দের মরে যাওয়াই ভাল।’
গ্রেফতারের পর ফারাবী র্যাবকে জানান, গত তিন-চার বছর ব্লগার হিসেবে তিনি বিভিন্ন ব্লগে ইসলামিক চিন্তা-চেতনা নিয়ে লেখা-লেখি করে আসছিলেন। এরইমধ্যে তার মতাদর্শের বিপরীতে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের বিভিন্ন ব্লগের বিরোধিতা করতে থাকেন ফারাবী। এভাবেই তার সঙ্গে থাবা বাবা (ব্লগার রাজীব), আসিফ মহিউদ্দিন, অভিজিৎ রায়, তসলিমা নাসরিন, দাড়ি-পাল্লা ধমাধম, দিগম্বর-পয়গম্বর, সানতুনু মহাপাত্র, অগ্নিবীন, আল্লামা শয়তান (মশিউর রহমান), সানতুনু আদিম, প্যানগান দেবতা এবং হিন্দু যোদ্ধা নামক ব্লগারদের সঙ্গে তার ধর্ম নিয়ে মত-পার্থক্য সৃষ্টি হয়। এতে বিভিন্ন সময় তারা ফেসবুকসহ বিভিন্ন ব্লগে মন্তব্যের তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। ফেসবুকের মাধ্যমেই অভিজিৎ রায়ের বিষয়ে জানতে পারেন ফারাবী। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ফারাবীর নাম নতুন করে আলোচনায় আসে।অভিজিৎ রায়কে হত্যার দু’ঘণ্টার মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে খুনের দায় স্বীকার করে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা সেভেন’ নামের একটি জঙ্গি সংগঠন। এরপর অভিজিতের ফেসবুক পর্যালোচনা করে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, শাফিউর রহমান ফারাবী (২৯) নামের এক যুবক তাকে বিভিন্ন সময় প্রাণ নাশের হুমকি দিয়ে আসছিল। অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায়ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানান, গত দেড় বছর ধরে ফেসবুকে অভিজিৎকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল ফারাবী। ২৬ ফেব্রুয়ারি হত্যাকাণ্ডের পরদিন শাহবাগ থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করে অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায়ও জঙ্গিদের সন্দেহের কথা বলেন। তখন তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমার ছেলেকে হত্যার জন্য উগ্র জঙ্গিবাদীরাই দায়ী। তাদের মদদ দিয়েছে জামায়াত-শিবির।’
অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে গ্রেফতারের পর ফারাবী র্যাবকে জানান, ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৮টার সময় বাসায় বসে কম্পিউটারে ফেইসবুক চ্যাট করছিলেন। রাত সাড়ে ১০টার সময় ফেইসবুক বন্ধু সিহাব, রানা চৌধুরী, মেজবাহ কমেন্টস করে টিভি দেখতে বলে। তখনই তিনি প্রথম জানতে পারেন অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের কথা।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উগ্র জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী ব্লগার ফারাবীই মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের প্রধান সন্দেহভাজন। খুনিদের বিষয়ে তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে বলে তিনি মনে করেন।
কে এই ফারাবী ?
মো. শফিউর রহমান ফারাবীর (২৯) বাবার নাম মৃত ফেরদৌসুর রহমান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর থানার বড়ভিলা কুমারশীল মোড় কালাইশ্রী পাড়ায় তার বাড়ি। ১৯৯৬ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার রেলওয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেন।২০০১ সালে কেন্দুয়া জয়হরি স্কাই সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০০৫ সালে রাজধানীর নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। মাঝে দু’বছর মানসিক সমস্যায় পড়ালেখা বন্ধ ছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৫-২০০৬ সেশনে পদার্থ বিজ্ঞানে ভর্তি হন। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪র্থ বর্ষে অধ্যায়ন করছেন তিনি। ২০১০ সালে নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীরে যোগ দেন। ওই বছর একটি হাঙ্গামার ঘটনায় গ্রেফতার হয়ে একমাস জেল খেটে জামিনে মুক্তি পান। দ্বিতীয় দফায় ২০১৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হয়ে আবার আগস্টে মুক্তি পান।