দিনাজপুরে ভেজাল ওষুধে বাজার সয়লাব
মাহবুবুল হক খান, দিনাজপ্রর প্রতিনিধি: দিনাজপুরে ভেজাল ওষুধে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। ওষুধই মানুষের জীবন রক্ষা করলেও ভেজাল ওষুধ সেবন করে নানা মানুষ আরো জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে।
বাজারে ভেজাল ওষুধ বিক্রি করতে সহায়তা করছে একশ্রেনীর অর্থলোভী চিকিৎসক। মোটা অংকের কমিশনের লোভ দেখিয়ে রিপ্রেজেন্টিভরা চিকিৎসকদের ম্যানেজ করে ব্যবস্থাপত্রে নকল বা ভেজাল ওষুধের নাম লিখিয়ে নিচ্ছে বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। নাম না জানা ও ভূয়া ওষুধ কোম্পনীর রিপ্রেজেন্টিভের সাথে কথা বলতে চাইলে সাংবাদিক টের পেয়ে রিপ্রেজেন্টিভ পালিয়ে যায়। জেলার বিভিন্ন স্থানে সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে এসব তথ্য জানা গেছে।
সম্প্রতি ঢাকায় র্যাব অভিযান চালিয়ে ভেজাল ওষুধের কারখানা আবিস্কার ও ভেজাল অষুধ প্রস্তুতকারীদের গ্রেফতার করে। এই অভিযানের পর ভেজাল ওষুধ প্রস্তুতকারীরা এখন ভেজাল ওষুধ প্রস্তুত করে জেলা শহরে বাজারজাত করছে। আর তাদের সহায়তা করছে কিছু অর্থলোভী চিকিৎসক ও ওষুধ ব্যবসায়ীরা। এ সব ওষুধ সেবন করে রুগির আরোগ্য না হয়ে আরো জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
দিনাজপুর শহরের স্টেশন রোড ও চারুবাবুর মোড়ে কিছু ওষুধ ব্যবসায়ী এসব ভেজাল ওষুধ বিক্রি করছে প্রকাশ্যে। মেডিসিন ও নিউরোলজী বিশেষজ্ঞ ডা. মাহবুবুল আলম একজন রোগীর ব্যবস্থাপত্রে কোম্পানীর না নেই এমন ক্যাপসুল রলিস (পড়ঢ়. ৎড়ষরং) ওষুধটি লিখে দেন। ব্যবস্থাপত্র নিয়ে শহরের রেল স্টেশনের রয়েল মেডিসিন দোকানে যায়। সেখান থেকে ওই ওষুধটি ক্রয় করে ৪৮০ টাকায়। যার ভিতরে আছে ৩০টি ট্যাবলেট। রুগি ১২টি ট্যাবলেট খাওয়ার পর আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন।
পড়ে খোজ নিয়ে জানা যায়, যে ওষুধের কৌটা (৩০টি বড়ি) ক্রয় করেছিল তাতে শুধুমাত্র মূল্য ও ঢাকা বাংলাদেশ লেখা আছে। কৌটার গায়ে রেজিঃ নং ও কোন কোম্পানীর নাম লিখা নেই। এই ভেজাল ওষুধটি দেখে অন্যান্য চিকিৎসক ও বিক্রেতারা জানান এটি ভেজাল-নকল ওষুধ। ভেজাল ওষুধ সেবন করেছে শুনে ওই রুগি আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন।
এই ঘটনার পর গত ৩ মার্চ পুনরায় ডা. মাহবুবুল আলমকে দেখাতে গেলে তিনিও ওষুধের কৌটা দেখে নকল বলে উল্লেখ করেন এবং ওষুধ পরিবর্তন করে দেন। তিনি বলেন, রিপ্রেজেন্টিভ আমাকে ভুয়া রেজিষ্ট্রেশন ও কোম্পানীর নাম দেখিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমি কোম্পানীর সাথে কথা বলবো। একজন চিকিৎসক এ ধরনের নকল ওষুধ দিয়ে রুগি এবং রুগির পরিবারকে বিপদে ফেলেছেন। চিকিৎসক এ ধরনের কাজ অর্থের লোভেই করেছে বলে মন্তব্য করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ডা. মাহবুবুল আলমের মত আরো অনেকে ভেজাল ওষুধ রুগিদের ব্যবস্থাপত্রে লিখে তাথেন। তার প্রতিটি ব্যবস্তাপত্রে একটি ভেজাল অষুধ থাকবেই। বিনিময়ে ভেজাল ওষুধ কোম্পানীর নিকট থেকে পাবে মোটা অংকের কমিশন পান। এ ভাবেই কিছু অর্থলোভী চিকিৎসকের মাধ্যমে বাজারে ভেজাল ওষুধ অবাধে বিক্রি হচ্ছে। ইতোপূর্বে রয়েল মেডিসিন মার্ট এ মেয়াদোত্তীর্ণ ও নকল ওষুধ উদ্ধার এবং মালিককে আটক করা হয়েছিল। ভোক্তভোগিদের অভিযোগ এখানে মেডিসিন মার্টে নকল বা ভেজাল ওষুধ বিক্রি হয় বেশী।
এ ব্যাপারে স্টেশনরোডস্থ রয়েল মেডিসিন মার্ট এর মালিক আরাফাতের জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনটা ভেজাল ওষুধ তা আমরা কি করে জানবো। ডাক্তাররা ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছে আমরা সে অনুযায়ী ওষুধ বিক্রি করছি। ওষুধগুলো ভেজাল না সঠিক তা দেখে নেয়ার দায়িত্ব কার এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ভেজাল ওষুধ ব্যাপক হারে ডাক্তারার লিখছেন সেগুলো না রাখলে ওষুধই বিক্রি হবে না। গ্রাহকরা ভেজাল ওষুধ না পেয়ে অন্যত্র চলে যান। দোকান গ্রাহক শূন্য হয়ে পড়ে। ভেজাল ওষুধ বাজারে বিক্রির জন্য ডাক্তাররাই দায়ী।
ডাক্তারদের মোটা অংকের অর্থ দিয়ে ভেজাল ওষুধ প্রস্তুতকারীরা রিপ্রেজেন্টিভদের মাধ্যমে বাজারজাত করছে। ডাক্তাররা ভেজাল ওষুধ না লিখলে বাজারে ভেজাল ওষুধই থাকবে না। শুধু আমার দোকানে নয় অনেক দোকানেই ভেজাল ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। জেনে শুনে ভেজাল ওষুধ বিক্রি করছেন কেন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এসব ওষুধ বিক্রি না করলে খাবো কি? ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। তার ভাষায় ভেজাল ওষুধ বিক্রি নিয়মে পরিনত হয়েছে। ধরার কেউ নেই। এসময় রয়েল মেডিসিন মার্ট এর মালিক ডা. আরাফাত ভেজাল ওষুধের রিপ্রেজেন্টিভকে মোবাইলে কথা বলার জন্য বলেন। রিপ্রেজেন্টিভের সাথে মোবাইলে কথা বললে তিনি পরিচয় দিলে তাকে দোকানে আসতে বললে তিনি দোকানে আসছি বলে আর আসেননি। পরে তাকে আর খুজে পাওয় যায়নি। রলিস(পড়ঢ়. ৎড়ষরং) ওষুধটির তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে আত্বগোপন করেন এবং দিনাজপুর ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।
এ দিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুকএক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, মাহবুবুল আলমের মতো একজন অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যদি এ ধরনের ভেজাল ওষুধ রুগিকে দেয় তাহলে আর কার কাছে ভালো আশা করা যাবে? এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। যে সব ডাক্তার রুগি দেখার ভিজিট ৫০০ টাকা নেয় এবং মোটা অংকের সরকারী বেতন ভাতা পান তারাই যদি এ ধরনের ভেজালকে প্রশ্রয় দেন তাহলে ভেজাল ওষুধের বেড়াজাল থেকে সাধারন মানুষ রেহাই পাবে না। মানুষের জীবন রক্ষা করাই যেখানে ডাক্তারের মুল দায়িত্ব সেখানে ভেজাল ওষুধ দিয়ে রুগিকে আরো দুর্ভোগে ফেলানো হচ্ছে। অনেক গরীব পরিবার কষ্টে টাকা যোগার করে ডাক্তারের ভিজিট দেয় এবং বাঁচার জন্য ওষুধ সেবন করে। কিন্তু এত কষ্টে টাকা রোজগার করে সব কিছু করার পর রুগির অবস্থা যদি অবনতি হয় তাহলে মানবতা বলে আর কিছুই থাকে না। গরীব পরিবারগুলো ভেজাল ওষুধ সেবন করে অকালে মৃত্যু বরন করবে অথবা পঙ্গুত্ব জীবন-যাপন করবে?
শহরের ঢাকা মেডিকেল স্টোরের স্বত্তাধিকারী মোঃ মিনারুল ইসলামের কাছে ভেজাল ওষুধ বাজারজাতকরন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, কিছু অসৎ ব্যক্তি এবং কিছু অর্থলোভী ডাক্তারারের সহযোগিতায় নকল বা ভেজাল ওষুধ বাজারে বিক্রি করছে। মোটা অংকের টাকার লোভে কিছু ওষুধের দোকানদার প্রকাশ্যে এসব নকল বা ভেজাল ওষুধ বিক্রি করছে। ভেজাল ওষুধ বিক্রেতাদের কারনে প্রকৃত ও আসল ওষুধ ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারছে না। এছাড়া সৎ ওষুধ ব্যবসায়ীদের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে।
অপরদিকে ভেজাল ওষুধ সেবন করে গরীব ও সাধারণ মানুষ আরো জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মানুষ জীবন রক্ষার চেয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। অবৈধ মুনাফা লুঠছে নকল বা ভেজাল ওষুধ প্রস্তুতকারী ব্যক্তিরা এবং কিছু অসৎ চিকিৎসক। বিপদজনক হয়ে পড়ছে স্বাস্থ্য রক্ষা। এখন বড় বড় ডাক্তাররাও নকল বা ভেজাল ওষুধ ব্যবস্তাপত্রে লিখছেন। ফলে ভেজাল বা নকল ওষুধ প্রস্তুতকারীরা নিরাপদে থাকছে। নকল বা ভেজাল ওষুধ বিক্রেতা, প্রস্তুতকারী ও ব্যবস্থাপত্র লিখা ডাক্তারদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগের অনুরোধ জানান মোঃ মিনারুল ইসলাম।
দিনাজপুর শহরসহ জেলার সর্বত্র ভেজাল ওষুধে সয়লাব হয়ে গেছে। দেখার কেউ নেই। ভেজাল ওষুধ বা লাইসেন্সবিহীন ওষুধের দোকান তদারকির জন্য সরকারী কর্মকর্তা হিসাবে একজন ড্রাগ সুপারিনেটডেন্ট দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু তিনি নামে শুধু দায়িত্ব পালন করছেন। স্বাস্থ্য বিভাগও নিরব দর্শকের ভুমিকা পালন করছে। সবাই ছুটছে কমিশনের দিকে! ফলে ভেজাল ওষুধ এখন আসল ওষুধে পরিণত হয়েছে। অবাধে বিক্রি হচ্ছে ভেজাল ওষুধ।
সচেতন দিনাজপুরবাসি এবং প্রকৃত ওষুধ ব্যবসায়ীরা এসব ভেজাল ওষুধ প্রতিরোধে প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।