পুলিশ বাহিনীর ২শ’ ২২ বছর
খ.শফিউল আলম দুলাল, পাবনা: ডিসেম্বর মাস বাঙ্গালী জাতীর জন্য আর্শিবাদ স্বরুপ। আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে অগনিত প্রান বিসর্জনের মাধ্যমে এ মাসেই পেয়েছিলাম আমরা একটি পৃথক পতাকা । বিশ্বের ইতিহাসে এ মাসে হয়তো আরো কোন বড় অথবা স্মরনীয় ঘটনা রয়েছে যাহা আমাদের মস্তিকের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে। স্মৃতির পাতা খুলে দেখতে পেলাম বিশ্বের আইন শৃংখলা রক্ষার জন্য যাবা আজ নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে, তাদের প্রথম পদচারনা শুরু হয়েছিল এ মাসেই। আমি পুলিশ বাহিনীর কথাই বলতে চাচ্ছি। ডিস্মেরের সতের তারিখ ছিল পুলিশ বাহিনী প্রতিষ্ঠা দিবস।
২শত ২০ বছর আগে ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দের ওই দিনে প্রথম পুলিশ বাহিনী গঠন করা হয়। তবে এ সব দিবস কোনদিন পুলিশ বাহিনী পালন করে না। বোধ করি ওই পেষার সাথে জড়িত সিংহভাগ কর্মকর্ত-কর্মচারীরা জানে না তাদের কর্মের পদটি কবে এবং কোনদিন থেকে প্রবর্তিত হয়েছিল। দিন-কাল-ক্ষন-যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষ যখন ধীরে ধীরে অন্যায় অপকর্মের দিকে জড়িয়ে পড়তে থাকে, তখন সাধারন প্রহরী দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। হানা-হানী, কাটা-কাটি, খুন খারাবি বেড়ে যেতে থাকলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তখন একটি শক্তিশালী বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা গ্রহন করে। সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়নই আজকে বিশ্বের পুলিশ বাহিনী।
ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তদানিন্তন ভারতবর্ষে রাজত্ব করতো। ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ডিসেম্বর প্রথম পুলিশি ব্যবস্থা চালু করে । সে সময় সকল গুরুত্বপুর্ণ এলাকাতে বড় দারোগা, ছোট দারোগা এবং দশজন সিপাহী মোতায়েন করে। এর ৬৯ বছর পর ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে বৃটিশ সরকার পুলিশী এ্যাক্ট গঠন করে পুলিশী পোষাক,বেতন কাঠামো, চাকরীর শর্ত নির্ধারণ করে। সে সাথে তাদের চিহ্নিত করার জন্য যুক্ত করা হয় মাথায় লাল পাগড়ী। পুলিশ প্রশাসন ষাতে আইন শৃংখলা এলাকা ভিত্তিক রক্ষা করতে পারে সে জন্য ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে হেস্টিংস বৃহত্তম বাংলাদেশকে চৌদ্দটি পুলিশী জেলায় বিভক্ত করে। এ বছর ১৯ এপ্রিল গর্ভনর জেনারেল কাউন্সিল নিয়োগ দেওয়া হয়। এর সাত বছর পর ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে ফৌজদার ও থানাদার পদ বিলুপ্ত করে ক্ষমতা দেওয়া হয় সিভিল কোর্টের জজকে।
বার বছর পর ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিশ ফৌজদারী ও পুলিশ প্রশাসন গঠন করে মোগলদের সৃষ্ট নায়েবই নাজিম পদটিকে বিলুপ্ত করেনূূূূূূূ। ওই সালেই লর্ড কর্নওয়ালিশ গঠন করেন জল পুলিশ। তিনি বড় লম্বা ও ছিপ নৌকা রেআইনি এবং দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে ঘোষনা করেন। অবশ্য পশ্চিম বঙ্গে কোন জল পুলিশ ছিল না। এরপর ১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দে অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে মনোনয়ন প্রথা বাতিল করে প্রতিযোগীতামুলক পরীক্ষ পদ্ধতি প্রথা প্রবর্তন করেন। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ তৎকালীন বৃটিশ শাসকদের মনে আতঙ্কের ঝড় বয়েছিল। যার ফলে ১৮৬১ সালে গঠিত হয় পুলিশী আইন। এ আইনটি এমনভাবে করা হয়েছিল যার মুল উদ্দেশ্য ছিল দমন নিপীড়ন। এ আইনগুলো বর্তমানে চালু থাকলেও তার প্রয়োগ নেই। ১৯০২ সালে প্রথম গঠিত পুলিশ কমিশনের সুপারিশে ডেপুটি পুলিশ সুপারের পদ সৃষ্টি করা হয়। সে সময় লর্ডকার্জন প্রথম পুলিশ কমিশন গঠন করেন। ১৯২৫ সালে লমসডন কমিটি পাঞ্জাবে গঠিত হলে পূলিশী ব্যবস্থা সামান্য পরিবর্তন করা হয়। ১৭৯৩ সালের সৃষ্ট সেই জল পুলিশই আজকের নৌ বাহিনীর দ্বয়িত্ব পালন করে আসছে।
মোগল শাসন আমলে ১৬৭৩ সাল থেকে ১৭৭৩ সাল পর্যন্ত সরকার মাহমুদাবাদ-৫ বলতে বুঝাতো , বেলকুচি, পাবনা,সলঙ্গাহাট, সুজানগড়, লাহিড়ী ও পোতাজিয়া থানা। এগুলি ছিল মুর্শিদকুলির থানা বা চাকলা। ১৭৭৩ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্য্যন্ত আঞ্চলিক ভাবে পাবনা ১৪ টি থানা নিয়ে গঠিত ছিল। যদিও ১৭৭৩ সাল থেকে ১৮২৮ সালের মাঝ পর্যন্ত পাবনা ছিল রাজশাহীর অন্তর্গত একটি মহকুমা। পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর ১৯৪৯ সালে গঠিত হয় সরকারী পুলিশ কমিশন। এ সময় গভর্ণর বর্নিও পদত্যাগ করলে রিপোর্ট প্রদান থমকে গেলে পুলিশ কমিশনের নীতি মালা প্রনয়নের বিলম্ব ঘটে। ফলে পুলিশ বিভাগের সদস্যদের মনে ক্ষোভ সঞ্চিত হতে থাকে। ১৯৫৩ সালে সাহাবউদ্দিন কমিটির পেশকৃত রিপোর্টটি ছয় বছর আটকে থাকে। শেষ পর্যন্ত্য ১৯৫৯ সালে গঠিত হয় পুলিশ কমিটি। এ কমিটি নতুন করে সুপারিশ মালা তৈরী করে।সুপারিশমালা তৈরীর দশ কছর পর মেজর জেনারেল মিঠা খানের নেতৃত্বে গঠিত হয় পুলিশ কমিশন।
মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে লোক নিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর ক্ষমতা বাড়ানো হয়। ১৯৭৫ সালে বাড়ানো হয় থানা। ১৯৭৮ ও ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশে পুলিশ কমিশন পঠন করা হয়। ১৯৮৮ সালে তা আবার পুন: গঠিত হয়। পরের বছরে পুলিশ কমিশনের নীতি মালা সম্পূর্ণ ভাবে সরকারের মনোনীত না হওয়ায় তা পরিবর্তন করে নতুন একটি নীতিমালা প্রণীত হয়। ১৯৮৮ সালে ভূতপূর্ব জল পুলিশ বর্তমানের নৌ পুলিশকে আর্মড পুলিশ বিভাগের ব্যাটালিয়নের সাথে একীভূত করা হয়। তার সদর দপ্তর স্থাপিত করা হয় বরিশালে। এ সাল থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশ বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয় মহিলা। এক সময় পুলিশের হাতে এমন ক্ষমতা ছিল যে, ম্যাজিষ্ট্রেটদেরও জব্দ হতে হতো। জেলা তত্ত্বাবধায়ক পুলিশের গোয়েন্দাদের কথায় ম্যাজিষ্ট্রেটদেরকেও গ্রেফতার করতো। ১৯০২ সালে লর্ডকার্জন প্রথম পুলিশ কমিশন গঠন করার পর পুলিশ বাহিনীকে আরো উন্নত করতে ১৯২৫ সালে লমসডেন গঠিত হয়। কিন্তু পুলিশের কাঠামো সামান্য পরিবর্তন ছাড়া তেমন কোন কাজ হয়নি। তখন থানার ওসিদের ডাকা হতো বড়বাবু বলে। বড়বাবুর ছিল তখন দোর্দন্ড প্রতাপ। সকলেই তাকে সমীহ করতো । তার চলাচলের জন্য থানায় পালন করা হতো ঘোড়া। এই ঘোড়াকে খাবারের জন্য বৃটিশ সরকার মাসিক ষাট টাকা বরাদ্দ দিত।
এ টাকার খাবার ঘোড়া খেতে পারতো না। যা বাচতো তা বড় বাবুর পকেটে যেত। এছাড়াও বড় বাবু বলে কথা, সে জন্য এলাকার প্রজারা নিজ অর্থে অথবা নিজ জমির কাঁচা ফসল কেটে থানায় ঘোড়াকে খাবার দিয়ে যেত। কিন্তু সে আমল এখন নেই। যার সমাপ্তি ঘটেছে পঞ্চান্ন বছর আগেই। এখনো অনেক থানায় ওসিকে বড়বাবু বলেই ডাকা হয়। এখন ঘোড়ার চল নেই, নেই সে সময়ও। তাই সময়ের বিবর্তে তদন্ত বা পেষাগত কাজে সেই বড়বাবু এখন মোটর সাইকেল, জীপ অথবা পিকআপ ভ্যানে চলাচল করতে হয়। বর্তমানে তদন্ত কাজে ঘোড়ার প্রচলন বিলুপ্ত হলেও অতীত ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য পুলিশ বাহিনীতে ঢাকার রাজার বাগ ও রাজশাহীর সারদা পুলিশ ট্রেনিং ক্যাম্পে এখনো ঘোড়া পালন করা হয়। যাহা পুলিশ সপ্তাহ পালন কালে বর্নাঢ্য র্যালীতে দেখা যায়। যা অতীত ঐতিহ্যকেই স্মরন করিয়ে দেয়। অতীতের তুলনায় বর্তমানে পুলিশ বাহিনীর কর্ম পরিধি ও দ্বয়িত্ব বহুগুনে বৃদ্ধি পেলেও সে তুলনায় তাদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পায়নি। অবশ্য এ জন্য গোটা পুলিশ বাহিনী ও সরকারই দায়ী।
পুলিশ বাহিনী গঠনের পর বৃটিশ সাশন আমল থেকে উপনিবেশিক ভাবে তাদের পরিচালিত করা হচ্ছে। তাদেরকে ব্যাবহার করা হতো প্রজা ও শাষকগোষ্টির বিরোধীতাদের দমিয়ে রাখার জন্য। দীর্ঘ দুই সহস্রাব্দীর অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও তাদের সংস্কারের কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পাক শাসন আমলে তাদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য তারা পুলিশকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। বহুবার তাদের সংস্কারের আশ্বাস দিলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর আমরা আশা করেছিলাম এ বাহিনীকে সংস্কার করে উপনিবেশিক সাশন থেকে বের করে আনা হবে। কিন্তু দিন-মাস-বছর এমনকি যুগ অতিবাহিত হয়েছে পুলিশের সংস্কারের কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। স্বাধীনের পর আমাদের দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতার বেশ কয়েক বার রদবদল হয়েছে। ক্ষমতায় আসার আগে দেশ ও জাতীর উন্নয়নসহ অনেক প্রতিশ্র“তি ই আমরা পেয়েছি। ক্ষমতাসীন হলে তার পূর্ণ বাস্তবায়ন আমরা কমই দেখতে পেয়েছি। পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজানোর প্রতিশ্র“তি আমরা শুনেছি, দেখিনি। দেখতে পাব কিনা জানিনা। তবে আমাদের প্রত্যাশা, যত দ্রুত সম্ভব উপনিবেশিক শিকল থেকে পুলিশ বাহিনীকে মূক্ত করে সংস্কার করা হবে।
১৭৯২ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যে উদ্দেশ্য নিয়ে পুলিশ বাহিনী গঠন করেছিল, সে উদ্দেশ্য থেকে ধীরে ধীরে পুলিশ বিচ্যুত হয়েছে। অবৈধ উপার্জনের গন্ধ লেগে গেছে তাদের পোষাকে। নিরপেক্ষতা হারিয়ে আজ তারা পথচ্যুত। পুলিশ বাহিনী গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল জন কল্যাণের । তাই তাদের নামকরন করা হয়েছিল ”পুলিশ”অর্থাৎ বিনয়ী, অনুগত, আইনজ্ঞ, বুদ্ধিমত্তা, সাহসী ও শিক্ষিত। নামের যথার্থতা তারা বজায় রাখতে না পারায় আজ তাদের অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত। নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে এনে জাতীর কাছে তাদেরকেই প্রমান করতে হবে আমরা প্রকৃত পক্ষে জনকল্যাণের ”পুলিশ”।