বুধবার, ২৯ এপ্রিল ২০১৫
প্রথম পাতা » » দুর্বল বিএনপির সামনে শক্ত ইস্যু
দুর্বল বিএনপির সামনে শক্ত ইস্যু
পক্ষকাল ডেস্কঃ রানা হানিফ, দ্য রিপোর্ট : দশম জাতীয় সংসদে ভোটারবিহীন নির্বাচন এবং সর্বশেষ ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কেন্দ্র দখল, এজেন্টদের বের করে দেওয়া, জালভোট প্রদান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতমূলক আচরণসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এ সব নির্বাচনী অনিয়ম নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থার অধীনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আদায়ের আন্দোলনে দুর্বল বিএনপির সামনে শক্ত ইস্যু হিসেবে দেখা দিয়েছে। এমনটি মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তাদের মতে, আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়া এবং মাঠপর্যায় থেকে তা সফল করে উঠিয়ে আনার সাংগঠনিক সক্ষমতা বিএনপির কতটুকু আছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে বল প্রয়োগ করে আন্দোলন সফল করার চেষ্টা বিএনপিকে ধীরে ধীরে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলছে বলেও মনে করেন তারা।
রাজনীতিকদের হাতে নেতৃত্ব না থাকা এবং নেতৃত্বদানে অক্ষমতার কারণে ৫ জানুয়ারি দশম ও তিন সিটি নির্বাচনের অনিয়মকে পুঁজি করে আন্দোলন সফল করতে পারছে না বিএনপি, এমনটিও মনে করেন তারা।
তবে বিএনপির দাবি, রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের পতন ঘটানো বিএনপির জন্য কঠিন কিছু না, যদি না তারা আইনকে বেআইনিভাবে প্রয়োগ না করে।
উল্লেখ্য, সামরিক সরকার এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অধীনে অংশগ্রহণ না করা এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি তোলে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। ঠিক ওই মুহূর্তে ১৯৯৪ সালে মাগুরার উপ-নির্বাচনে ব্যাপক ভোট কারচুপি ও অনিয়মের চিত্র উঠে আসে গণমাধ্যমে। আর তখন থেকে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টি সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা স্থাপন করে জাতীয় নির্বাচনের জন্য আন্দোলন শুরু করে। ওই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত। পরে এক প্রকার নিয়ম রক্ষার নির্বাচন বলে আখ্যা দিয়ে বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেয় বিএনপি। ক্ষণস্থায়ী ষষ্ঠ সংসদেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করে পদত্যাগ করে বিএনপি। ওই বছরের ১২ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের মেয়াদ শেষে ২০০১ সালে ১ অক্টোবর শেষবারের মতো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে বিএনপি জোটভুক্ত নির্বাচন করে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে। তবে বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় নির্বাচন কমিশন, ভোটার তালিকা প্রণয়নে অনিয়ম ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে বিচারপতি কে এম হাসানের নিরপেক্ষতা প্রশ্নে আন্দোলন শুরু করে আওয়ামী লীগ। অবশেষে ২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করলেও কে এম হাসান তত্ত্বাধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ওই সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজ উদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিজেই শপথ পড়েন। একই সঙ্গে ২০০৬ সালের ২২ জানুয়ারি নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের ভোটগ্রহণের তারিখ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। ওই নির্বাচনে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও সমমনা অন্যান্য দলকে নিয়ে গঠন করে মহাজোট। পরবর্তী সময়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে উচ্চ আদালতের রায় এলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া জাতীয় পার্টির সকল প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেয়। এর পর ভোটার তালিকায় এক কোটি ভুয়া ভোটার ও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন তুলে ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করে আওয়ামী লীগ। পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবনতির দিকে যেতে থাকলে এক-এগারোর সৃষ্টি হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান থেকে রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিন আহমেদের সরে যাওয়া এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ সরকারপ্রধান হিসেবে শপথ নিয়ে গঠন করেন সেনা সমর্থিত নির্বাচনকালীন সরকার। এর পর টানা দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য সমমনা দল নিয়ে আওয়ামী লীগ গঠন করে মহাজোট সরকার। ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন প্রবর্তন করে আওয়ামী লীগ। পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে স্থাপনের দাবিতে বিভিন্ন আল্টিমেটাম ও আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। তবে বিএনপির ওই আন্দোলন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরাতে ব্যর্থ হয়। অবশেষে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং ১৪৭ আসনে ‘ভোটারশূন্য’ নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।
অবশ্য ৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিহত করতে লাগাতর অবরোধ কর্মসূচি দিয়েও আওয়ামী লীগের ভিত নাড়াতে ব্যর্থ হয় বিএনপি- এমনটি মনে করেন সবাই। অবশেষে বিএনপি চেয়ারপারসনের ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি ব্যর্থ হওয়ার মধ্য দিয়ে দলের কর্মসূচিতে শীর্ষ নেতাদের মাঠে না থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হয় বলেও মনে করা হয়।
পরবর্তী সময়ে এই সরকারের আমলে উপজেলা নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়ম ইস্যু কাজে লাগাতে না পারায় সর্বশেষ ২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অনিয়মের মতো শক্ত ইস্যুকে পুঁজি করে আন্দোলন করতে বিএনপির সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হওয়া তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নানা অনিয়ম-অভিযোগকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তী সময়ে আন্দোলন সফল করতে বিএনপির সক্ষমতার প্রশ্ন তুলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আজ (২৮ এপ্রিল) অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন কেমন হয়েছে এটা কোনো প্রশ্ন না। কারণ কী হয়েছে বা কী হতে পারে এমন ধারণা আগে থেকেই সবার মধ্যে ছিল। কিন্তু আমরা আশা করেছিলাম সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। সেটা আমরা না দেখে বরং লক্ষ্য করলাম দেশ আরও গভীর সঙ্কটের দিকে ধাবিত হল। এর পরও এই নির্বাচনের অনিয়মকে পুঁজি করে বিএনপি আন্দোলনে সফল হবে কি-না এমন ভবিষ্যদ্বাণী করা অসম্ভব। তবে তাদের বিগত দিনের আন্দোলন দেখে মনে হয়েছে, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ দল তাদের জনসমর্থন সম্পর্কে অবগত না। তারা তাদের সাংগঠনিক সক্ষমতা নিয়ে বিশ্লেষণ করে না।’
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় আন্দোলন-সংগ্রাম থাকবে। তবে তা অবশ্যই গণতান্ত্রিক পন্থায় হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা দেখেছি, বিএনপি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের ঘোষণা দিলেও তা অনেকটা বল প্রয়োগ করে সফল করার চেষ্টা চালিয়েছে। এতে বিএনপি ক্রমশ জনবিচ্ছিন্নতার দিকে ধাবিত হয়েছে। বিএনপির এমন কর্মকাণ্ডে স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয়, দলটিতে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নেতার অভাব রয়েছে। কীভাবে রাজনৈতিক ইস্যুতে আন্দোলন-সংগ্রাম করে রাজনৈতিকভাবে সফল হওয়া যায় এমন চিন্তা-ভাবনার নেতা বিএনপিতে নেই।’
তিনি বলেন, ‘অন্যদিকে সরকারও বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করছে বলে মনে হচ্ছে না। এক্ষেত্রে পেশীশক্তিকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। ফলাফল পেশীশক্তিতে যে যত সবল সেই সফলতা পাচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করা বিএনপির দুই দিনের ব্যাপার। যদি আওয়ামী লীগ বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেটা না করে আইন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বেআইনিভাবে ব্যবহার করে বিএনপিকে মোকাবেলা করছে। এক্ষেত্রে যুদ্ধটা আর রাজনৈতিক থাকে না। আওয়ামী লীগ মোরালি ডাউন একটি দল। তারা বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে ভয় পায়।’
নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘বিএনপি সরকার পতনে গণতান্ত্রিক আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করে। সভা-সমাবেশ ও হরতালের মতো কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা না করে পুলিশি শক্তি দিয়ে মোকাবেলা করছে। এক্ষেত্রে অস্ত্রের শক্তির কাছে আমরা দুর্বল। আগে পুলিশের হাতে লাঠি থাকলেও এখন থাকে অস্ত্র। আর বিরোধী দলের আন্দোলনে নেতাকর্মীদের ওপর গুলি চালাতে পুলিশের এতটুকু হাত কাঁপে না।’
তিনি বলেন, ‘২৮ এপ্রিলের সিটি নির্বাচনে আমরা অংশগ্রহণ করে এবং নির্বাচনের দিন ভোট বর্জনের মাধ্যমে প্রমাণ করেছি আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। তাই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেওয়াটা বিএনপির ভুল ছিল না। আমরা জনগণকে দেখিয়েছি, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে কতটা ন্যাকেড হতে পারে। তারা ক্ষমতায় থাকতে আইন পরিবর্তন, সংবিধান সংশোধনসহ প্রশাসনকে নোংরাভাবে ব্যবহার করতে পারে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও তা প্রমাণিত হয়েছে। আমরা আশা করি, এই নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপির সাময়িক কিছু ক্ষতি হলেও পরবর্তী সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপিতে জনসম্পৃক্ততা বাড়বে।’
নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমি মনে করি না আন্দোলন সফল করতে বিএনপিতে সাংগঠনিক দুর্বলতা আছে। আমাদের যথেষ্ট শক্তি রয়েছে। সময় হলে ঠিকই বিএনপি আন্দোলনে সফল হবে।’
এ ব্যাপারে বিএনপির সাবেক যুগ্ম-মহাসচিব ও বহিষ্কৃত নেতা মো. আশরাফ হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘বিএনপির রাজনীতি এখন গুটিকয়েক ব্যবসায়ী ও সাবেক আমলার হাতে চলে গেছে। বিএনপির কমিটি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তৃণমূল থেকে উঠে আসা নেতার সংখ্যা নেই বললেই চলে। যাও কয়েকজন আছেন তারাও ব্যবসায়ী, আমলা নেতাদের জন্য নিজেদের মতপ্রকাশ করতে পারছেন না। তাদের দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে অনেক দূরে রাখা হয়েছে। পদে থাকলেও অনেকেই তাদের বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করতে পারছেন না।’
আশরাফ হোসেন বলেন, ‘তিন সিটি নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগের চেয়ে বড় অভিযোগ, বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে। এখন তারা কতটুকু সবল সেটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। প্রশ্ন রয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীরা কতটুকু সাংগঠনিক। তারা যদি সাংগঠনিক হতো তাহলে দলের প্রধানের গাড়িবহরে দিনদুপুরে এভাবে হামলা হতে পারে না।’