শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪
প্রথম পাতা » » উন্নয়নের অন্তরায় দুর্নীতি: আব্দুল হাই রঞ্জু
উন্নয়নের অন্তরায় দুর্নীতি: আব্দুল হাই রঞ্জু
দেশে উন্নয়নের বড় অন্তরায় হলো দুর্নীতি। অকপটে যা সকলেই স্বীকারও করেন। সম্প্রতি, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, দুর্নীতি বন্ধ করা যে কত কঠিন, তা দায়িত্ব নিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এক সময় দেশের অর্থমন্ত্রীও বলেছিলেন, সরকারের উচ্চপর্যায়ে কিছু কিছু দুর্নীতি হচ্ছে। যথাযথই বলেছেন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বড় বড় দুর্নীতির পাশাপাশি দেশের সর্বত্রই দুর্নীতি বাড়ছে বৈ কমছে না। এখন আর দুর্নীতির বাস্তবচিত্র দেখতে বিশেষ কোন জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজন পড়ে না। খালি চোখেই মানুষের দুর্নীতির বাস্তব চিত্র দেখতে দেখতে অনেকটা গা সয়ে যাওয়ার অবস্থা। মানুষের চোখের সামনেই চলছে দুর্নীতির মহাউৎসব! মুলত যারাই রক্ষক তারাই ভক্ষক হয়েই দুর্নীতি করছে। আগে দুর্নীতি হলে কেউ অভিযোগ করলে কম বেশি প্রতিকার হতো। এখন আর অভিযোগ করেও কাজ হয় না। কারন একটাই, প্রতিকারের জায়গাটি যারা দখলে রেখেছেন, তারাই প্রত্যক্ষ পরোক্ষ ভাবে দুর্নীতির আষ্টেপিষ্টে জড়িত। মানুষের যাওয়ার জায়গাটুকু পর্যন্ত এখন আর নাই। বরং কেউ দুর্নীতির প্রতিকার চাইতে গেলে উল্টো মহা শক্তিধর(?) দুর্নীতি বাজদের রোষানলে পড়তে হয়। মহাজোটের শেষ সময়ে এসে গত ১০ নভেম্বর জাতিয় সংসদে দুদকের ক্ষমতা খর্ব করে জাতীয় সংসদে দুর্নীতি দমন কমিশন বিল-২০১৩ পাস করা হয়েছে। যা বিভিন্ন পত্রিকায় নানা ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সংশোধিত আইন অনুযায়ী সরকারের কোন মন্ত্রী এমপি বা সরকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে এবং মামলায় আদালতে চার্জশিট দিতে হলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে পুর্বানুমোদন নিতে হবে। এ প্রসঙ্গেঁ দুদক চেয়ারম্যান এম বদিউজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, সরকার জাতীয় সংসদে যে বিলটি পাস করেছে যা সংবিধানের ২৭ ধারা ও দুদক আইনের ২৪ ধারার সংঙ্গে সাংঘর্সিক। এই আইনের ফলে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির মাত্রা আরো বাড়বে (সুত্র: দৈনিক যুগান্তর ১২ই নভেম্বর’১৩ইং)। আমি মনে করি দুদকের আইন সংশোধন শুধু সংবিধানের ২৪ ধারার সংগেই সাংঘর্সিক নয় বরং মহাজোটের নির্বাচনী ইশতেহারেরও পরিপন্থি। চারদলীয় জোট সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে মহাজোট দুর্নীতি বন্ধের অঙ্গিকার করেই নির্বাচিত হয়েছে। মহাজোট সরকারের আমলে দুর্নীতিতো কমেনি, উল্টো দুর্নীতির মাত্রা অনেক বেড়েছে। সংগত কারনেই দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-এমপি, আমলার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলা করার সর্বময় ক্ষমতা খর্ব করা হলো। অবশ্য, আমাদের দেশে সরকারের আর্শিবাদ পুষ্ট স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো কাগজ কলমে স্বাধীন হলেও কার্য্যত যে স্বাধীন নয়, তা সকলেই জানেন। তবুও দুর্নীতি দমন ব্যুরোকে বিলুপ্ত করে ২০০৪ সালে ২১ নভেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনের পর স্বাধীন(?) প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ শুরু করে। যেখানে দুর্নীতি বন্ধে দুদককে শক্তিশালী করা অবশ্যক, সেখানে সরকার উল্টো দুদকের আইন সংশোধন করে প্রতিষ্ঠানটিকে ‘ঠুঠো জগন্নাথ’ বানিয়ে রাখলো। এমন কি এখন থেকে দুদকের রজু করা কোন মিথ্যা মামলায় সংশ্লিষ্ঠদের বিরুদ্ধে ৫ বছরের শাস্তির বিধান এবং পুলিশকে দিয়ে দুদকের কর্মকর্তাদের অপরাধের তদন্ত করার বিধান আইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, দুর্নীতি দমন কমিশন কার্য্যত নিস্ক্রিয় হয়ে যাবে।
জাতীয় সংসদ হচ্ছে আইনের সুতিকাগার। আমাদের দেশের জাতীয় সংসদ সদস্যগন শুধু আইনই পাস করেন না, বরং সাংসদগন স্ব স্ব এলাকার উন্নয়ন কর্মকান্ড থেকে শুরু করে প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সর্বময় ক্ষমতাধর একমাত্র নির্বাচিত প্রতিনিধি। স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোতেও নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা অপরিসীম। ফলে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হিসাবে গড়ে উঠতে পারে না। উল্টো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অবস্থা অনেকটা ‘ঠুঠো জগন্নাথের’ মতই। মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা ও সুযোগের কারনে মন্ত্রী-এমপিদের সংঙ্গে আমলারাও দুর্নীতিতে যুক্ত। মুলত নিজেদের রক্ষা করতেই দুদক আইনের সংশোধন বিল পাস করা হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। ভোগবাদী এই সমাজব্যবস্থায় জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নির্বাচিত হচ্ছে, লুটেরা কালো টাকার মালিকরাই। যারা অর্থবিত্তে, প্রভাব প্রতিপত্তিতে বলিয়ান, সহশায় তারাই নির্বাচিত হচ্ছেন। সৎ দেশপ্রেমিকরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করা ছেড়েই দিয়েছেন। দুর্নীতিবাজ লুটেরারাতো নির্বাচিত হয় আরো অর্থবিত্তের জন্যই। এখন স্বকল্যানের রাজনীতি জনকল্যানের রাজনীতিকে গ্রাস করেছে। হয়েছে রাজনীতির বানিজ্যিকরন। ফলে, লুটেরা ধনিকগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় থেকে জনগনের সম্পদ দখল করে গড়ে তুলছে টাকার পাহাড়। জনগনের ভাগ্য বদলের কথা বলে জনগনের ভোটে ক্ষমতাসীন হয়ে জনগনের অর্থ, সম্পদ, লুটে নিচ্ছে।
গত ২৮ অক্টোবর’১৩ এক দৈনিকে ‘ড্যাপ উপকমিটির সর্ববৃহৎ দুর্নীতি’ শিরোনামে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ‘ডিটেল এরিয়া প্লান’ বা ড্যাপ রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার উপকমিটির সহায়তায় জাল জালিয়াতির মাধ্যমে বসুন্ধরা হাউজিংয়ের ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি লিমিটেড ৪৩০২ একর সরকারি খাস জমি হাতিয়ে নিয়েছে। সেখানে ৮০০ একর খাস জমির উপর খাল, নালা, নদী বিদ্যমান এবং ২১৬ একর ভাওয়াল এষ্টেটের জমি রয়েছে। বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী ৪৩০২ একর জমির মূল্য প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। পরিবেশ ও নগর বিশেষজ্ঞদের মতে, পুর্বাচল রাস্তার দু’পাশে দুটি খাল খনন করা না হলে ঢাকার মধ্যাঞ্চল বন্যার পানিতে ডুবে যাবে। বসুন্ধরা আবাসিক প্রকল্পের পূর্বদিকে বালু নদী পর্যন্ত সব জমিই নিচু জলাধার। এসব জলাধারকে ভরাট করা হলে, বাড্ডা, কুড়িল, বারিধারা, মেরুল, আনন্দনগর, ভাটারা, শাহাজাদপুর সহ বিস্তীর্ন এলাকা তলিয়ে যাবে। এ জন্যই পূর্বাচল তিনশ’ফুট রাস্তার দক্ষিন ও উত্তরে একশ’ফুট করে দুটি পানি নিষ্কাশন খাল ড্যাপ সমীক্ষা ও নকশায় অর্ন্তভুক্ত করা আছে। কিন্তু এ ভাবে ড্যাপকে উপেক্ষা করলে ঢাকার চরম সর্বনাশ হবে বলে মনে করেন, নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড: মুজিবুর রহমান, নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম, পরিবেশবিদ এ্যাড, রিজওয়ানা হাসান ও পরিবেশ আন্দোলনের ডা: আব্দুল মতিন। ভুক্তভোগীদের মতে, ড্যাপের আওতাভুক্ত ও ড্যাপের সব শর্ত লংঘন করে এ ভাবে সরকারি খাস জমি হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা স্বাভাবিক ভাবে ঘটেনি। তাদের মতে, পর্দার আড়ালে অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকার অবৈধ লেনদেনের সহিত কয়েকজন মন্ত্রি, প্রতিমন্ত্রি, সচিব ও সংশ্লিষ্ট পদস্থ কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে (সুত্র : দৈনিক যুগান্তর ’১৩)। ভোক্তভোগীরা এ বিষয়ে তদন্তের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোরালো আবেদনও জানিয়েছেন। দেশের প্রাণকেন্দ্র রাজধানী ঢাকার জনস্বার্থ ক্ষুন্ন করে ৪৩০২ একর জনগনের সম্পতি বিশেষ গোষ্ঠীর অনুকুলে ছেড়ে দেয়ার ঘটনা নজির বিহীন। এ ধরনের জনস্বার্থ বিরোধী বড় মাপের দুর্নীতি রোধে সরকার প্রধানের হস্তক্ষেপ শুধু ভোক্তভোগিদের নয় বরং এ দাবী সমগ্র দেশবাসীর। এই সব দুর্নীতিবাজরা শেয়ারবাজারে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে লক্ষ্য লক্ষ্য বিনিয়োগকারীকে পথে বসিয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডিপুটি গর্ভনর ইব্রাহিম খালেদ সুনির্দিষ্ট ভাবে দুর্নীতিবাজদের তালিকা দিয়ে শাস্তির সুপারিশ করেও কোন কাজ হয়নি। উল্টো তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাঁকে হেনস্তা পর্যন্ত করা হয়েছে। এটা হওয়াই স্বাভাবিক। যারা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে থেকে দুর্নীতি করে, তাদেরতো বহাল তবিয়তে থাকারই কথা! ফলে, এদেশে হলমার্ক, বিসমিল্লাহর মতো নামকাওয়াস্তে প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি করার সুযোগ পায়। অথচ দেশের বিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী ক’দিন আগেও বললেন, হলমার্ক বিসমিল্লাহ্র লুষ্ঠিত টাকা তেমন কিছু নয়। হয়ত তাই, যে দেশের ক্ষুদ্র মাঝারি ব্যবসায়ীরা নুন্যতম পুঁজির অভাবে ব্যবসা চালাতে পারেন না, সেদেশে দু’টি প্রতিষ্ঠান প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি করে হাতিয়ে নিলেও মন্ত্রিবাহাদুরদের কাছে যা অতি সামান্যই! সম্প্রতি, তিনি রাষ্ট্রায়াত্ব চারটি ব্যাংকের উচু তলার বড় বড় শিল্প পতিদের কোটি কোটি টাকা ঋণ মওকুফ করে দিয়েছেন। অথচ এ দেশের কৃষককে সামান্য কৃষি ঋণের দায়ে কোঁমরে রশি দিয়ে টেনে হেঁচড়ে নেয়া হচ্ছে আদালতে। এই হচ্ছে বাস্তবতা।
স্বাধীনতা অর্জনের ৪২ বছর, সময়ের অংকে কোন ভাবেই কম নয়। দীর্ঘ এই সময়ে দেশের বৃহৎ একজনগোষ্ঠীর ভাগ্যের বদল না হলেও গুটিকতক দুর্নীতিবাজ লুটেরাদের ভাগ্যের বদল হয়েছে। একমাত্র সীমাহিন দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার কারনে দেশের অর্থনীতিতে কাংখিত সমৃদ্ধ আসেনি। আজও উন্নয়ন সহযোগী দাতা সংস্থা কিম্বা দাতা রাষ্ট্রের ঋণ সহায়তানির্ভর অর্থনীতির উপর নির্ভরশীলতা কমেনি। দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব না হলে সমৃদ্ধ জাতি গঠন কোন ভাবেই সম্ভব হবে না। আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ। দুভার্গ্য এ দেশে যারা দুর্নীতিবাজ তারাই আবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোড় গলায় কথা বলে। দেশে দুর্নীতি রোধে দুর্নীতি দমন কমিশনকে কোন সরকারই শক্তিশালী করে নাই। ফলে, দুদকের বিদায়ী চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেছিলেন, দুদক হচ্ছে ‘নখদন্তর্হীন বাঘ’। সম্প্রতি জাতিয় সংসদে দুদক সংবিধান বিল-১৩ পাস করে দুদকের ক্ষমতা খর্ব করে হাত পা পর্যন্ত কেটে ফেলা হলো। ফলে, দেশে এখন দুর্নীতির মাত্রা আরো বেড়ে যাবে, সাধারন মানুষের দুর্নীতি মুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।
লেখক: কলামিষ্ট