ফেঁসে যাচ্ছেন সালাহউদ্দিন
জুয়েল বড়ুয়া : বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় আকস্মিকভাবে গায়েব হয়ে যাওয়ার কারণ ক্রমশ উন্মোচিত হলেই স্পষ্ট হবে কাহিনীর অন্তর্গত শিকড়-বাকড়ের রহস্য। সালাউদ্দিন গায়েব হওয়ার আগের তিন মাসও ছিলেন গোপন আস্তানায়। রহস্য উপন্যাসের মতো তিনি গোপনে গোপনে ক্রিয়াকর্ম চালাতেন। শুধু তাই নয় ফৌজদারি মামলা এড়াতে এই গোপনবাসকালে তিনি বিবৃতিতে নিদের্শ পাঠাতেন দলীয় চেয়ারপার্সনের পক্ষে অবরোধ-হরতাল অব্যাহত রেখে দেশজুড়ে নাশকতা চালিয়ে পেট্রোলবোমায় মানুষ হত্যার জন্য।লক্ষ্য ক্ষমতাসীন সরকারকে উৎখাত করে দেশকে পাকিস্তানী স্টাইলে পরিচালনার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদেও রক্ষাও তত্ত্বাবধায়ক যুগে দায়ের করা দুর্নীতির মামলা হতে রেহাই পাওয়া। তিন উদ্দিনের শাসনকালেও সালাহউদ্দিন পলাতক ছিলেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়। তখন সম্ভবত দেশের বাইওে অবস্থান করছিলেন।
সেদিক থেকে দেখলে বোঝা যায়, পালিয়ে থাকা বা গায়েব হয়ে যাওয়ার প্রবণতা তার পুরনো। ছাত্র জীবনে তিনি তারেক- কোকোর গৃহশিক্ষক ছিলেন একটা সময়ে, যখন ওরা বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করতেন। সে সুবাধে পারিবারিক ঘনিষ্ঠতায় তিনি প্রধানমন্ত্রী খালেদার ১৯৯১-৯৬ কালে এপিএস পদ পেয়ে যান। আর তখন তিনি ক্ষমাতায় ছড়ি ঘোরাতেন এবং স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন। রাজনৈতিক দাপটের স্বাদ তাকে পাগল করে তুলে। পরবর্তীকালে জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে খ্যাত নিহ এলাকা নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকার গঠন করলে তিনি হয়ে যান যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী। তখন থেকেই তার দাপট তুঙ্গে ওঠে। তিন উদ্দিন যুগে অপর উদ্দিন সালাহউদ্দিন দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে অন্তর্ধানে চলে যান। ফলে নির্বাচনে অংশ নিতে না পেওে তার আসনে তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদ অংশ নিয়ে জয়লাভ করেন। আওয়ামীজোট ক্ষমতায় এলে তিনি আবির্ভূত হন। বিএনপির যুগ্ন সম্পাদক হিসেবে তিনি ছিলেন তারেকের প্রিয়ভাজন। একই সঙ্গে বেদম জিয়ারও।
২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পূর্বে বিএনপি-জামায়াত জোট প্রশাসনকে যে তিন স্তওে সাজিয়েছিল, তার রূপকল্প প্রণেুার অন্যতম ছিলেন সালাহউদ্দিনও। এই দলবাজদের ওপর ভরসা করেই বেগম জিয়া গত ৫ জানুয়ারি রাজপথে বেরিয়ে প্রেসক্লাবে আশ্রয় নিয়ে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। কতিপয় আমলাও বেগম জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছিল সে সময়। যদিও পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর অবরোধ নামক নাশকতা প্রকল্প চালু করা হয়। এই নাশকতার সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকায় সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে কয়েকটি ফৌজদারী মামলাও দায়ের করে পুলিশ। কিন্তু দৃশ্যপটে তাকে পাওয়া না গেলেও অপ্সাতস্থান হতে তিনি বোমাবাজির নিদের্শ পাঠাতেন। অবশ্য সম্প্রতি তার স্ত্রী দাবি করছেন, তার স্বামীর নামে বিবৃতি পাঠানো হতো। প্রচার রয়েছে, তার স্বামীর নামে বিবৃতি দিয়ে মানুষ হত্যা বন্ধ করার জন্য এই অপহরণের কাহিনী সাজানো হয়েছিল।
১০ মার্চ সালাহউদ্দিন গয়েব হয়ে যান বলে তার স্ত্রী ২৪ ঘন্টা পর জানান, যার মধ্যে রহস্যেও ভোমরাটি রয়ে যায়। স্মরণ করতে পারি, শেষ বিবৃতি প্রদানের কয়েক ঘন্টার মধ্যে গায়েব হয়ে যান যখন, তষনও দেশজুড়ে পেট্রোলবোমা হামলায় ৪ জনের মৃত্যু ঘটে। বার্ন ইউনিটে আরও ৬ জন অগ্নিদগ্ধ ভর্তি হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতাসীন সরকারকে যে কোন মূল্যে উৎখাতের জন্য যাত্রীবাহী বাস, সরকারী স্থাপনা পোড়ানোর কাজ ব্যাপক করে তোলে। শিশু, অন্ত:সত্ত্বা নারী, স্কুল-কলেজ ছাত্র-ছাত্রী, শ্রমিক, বাসচালক হেল্পারসহ নিরীহ মানুষের নৃশংস মৃত্যুও মিছিল চলছিল। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সালাহউদ্দিনের টিকিটিও খুঁজে পাচ্ছিল না। অথচ তার বিরুদ্ধে তখনও মামলা ও গেস্খফতারি পরোয়ানা ছিল। গোপন আস্তানা হতে সালাহউদ্দিন অপহরণ হলেন বলে ঘঁনার একদিন পর তার স্ত্রী দাবি করেন।
উত্তরার যে বাড়িতে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন, সে বাড়ির মালিক ব্যাংকার ২৪ ঘন্টা পর বেগম সালাহউদ্দিনকে জানিয়েছেন, র্যাবের লোকজন তাকে মাঝরাতে তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু র্যাবসহ অন্য সংস্থাগুলো তা অস্বীকার করে। নাশকতার জন্য ফৌজদারি মামলায় গেস্খফতারি পরোয়ানা নিয়ে অপ্সাতস্থান হতে বিবৃতি পাঠাতে পাঠাতে একদিন কিভাবে গায়েব হয়ে গেলেন-তার অন্তর্গত বিষয় জানার অধিকার জনগণের রয়েছে।
স্পষ্ট যে, জঙ্গীদেও মতো আচার-আচরণে তার দক্ষতা রয়েছে এবং এমন জীবন যাপনে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছেন, বার্তা পাঠানোর প্রক্রিয়া তারই নিদর্শন। উদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক যুগে আরও অনেকের সঙ্গে সালাহউদ্দিনকেও সন্ত্রাস ও দুর্নীতির গডফাদার এর তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। সেই সময় যে পলাতক জীবন বেছে নেন, সেই অভ্যাসটা তাকে ছেড়ে যায়নি। তখন দেশের বাইওে অবস্থানকালে তার সঙ্গে দুবাইয়ের একটা সংযোগ যে গড়ে উঠেছিল, তা অব্যাহত রয়েছে বঔেন সিমটি দুবাইয়ের। দুবাই কানেকশন মানেই মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহীমের সঙ্গে তারেক ও একদা গোয়েন্দা সংস্থা প্রধান রেজ্জাকুল হায়দারের কয়েক দফা বৈঠক ও বাংলাদেশে নাশকতার মাধ্যমে আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ হাসিনাকে হত্যার ও ভারতের সাত রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদীদেও অস্ত্র সরবরাহ পরিকল্পনার প্রচারকেই মনে করায়।
তারেক ঘনিষ্ঠ হিসেবে সেই সংযোগ পরস্পরায় সালাহউদ্দিন রক্ষা করে আসছেন কিনা, তদন্ত হলে তা স্পষ্ট হবে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেভেনস সিস্টার রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোকে লালন-পালন ও সশস্ত্র পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছিল। বিএনপি সরকার এই সংগঠনগুলোকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঘাঁটি গাড়া ও আশ্রয় দেয়। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকুল ও স্থলভাগকে এই সংগঠনগুলোর অস্ত্র পরিবহনের রুট হিসেবে ব্যবহার করতে দেয়া হয়। তারেক ও মন্ত্রী বাবর সরাসরি তত্ত্বাবধায়ন করতেন। অসমের উলফার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট সীমান্তে এদেশী গোয়েন্দাদেও সহায়তায় গড়ে তোলা হয়েছিল। দশ ট্রাক অস্ত্রেও যে চালানটি ধরা পড়েছে, তার নেপথ্যে কুশীলবরা আদলতে বিচারের সম্মুখীন।
১৯৮৯ সালে উলফা প্রথম বাংলাদেশে ঘাঁটি গাড়ে। এরপর খালেদা শাসনযুগে এদেশের ভূখন্ড ব্যবহার করে ভারতবিরোধী তৎপরতা চালানোর সুযোগ করে দেয় বিএনপি। তারা সমরাস্ত্র ও বিস্ফোরকের চালান বাংলাদেশের ওপর দিয়ে অবাধে পাচারের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। উলফার শীর্ষ নেতারা ঢাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য চালু করে। উলফাসহ সাত রাজ্যেও অন্য বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও এ সময়ে বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতা পেতে থাকে আইএসআই-এর পরামর্শে। সালাহউদ্দিন সে সময় প্রধানমন্ত্রী খালেদার এপিএস।
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ভূখন্ড ব্যবহারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেন। উলফাসহ অন্যরা তখন ভুটান নেপালসহ ভারতের অন্য রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিল। ২০০১ সালে পুনরায় ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামায়াত জোট ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদেও পক্ষে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতে থাকে। তাদেও নেতারা সংসদে দাঁড়িয়ে ভারতের সাত রাজ্যকে স্বাধীন হিসেবে দেখারও ঘোষণা দেয়। সে সময় উলফার জন্য অস্ত্র সরবরাহ করা হতো কক্সবাজার- টেকনাফ উপকূল হয়ে কর্ণফুলী নদীঘাটেও খালাস হতো। সালাহউদ্দিন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তারেকের নিদের্শে এসব দেখা শোনা করতেন কিনা, তা এখন স্পষ্ট হবে। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী কোন গোষ্ঠির সঙ্গে সালাহউদ্দিনের সম্পর্ক রয়েছে কিনাম বিষয়টি খতিয়ে দেখছে দেশের গোয়েন্দারা। দুই দেশের অস্থিতিশীল কোন গোষ্ঠির সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছে কিনা তা তদন্ত করছে।
ভারত সরকারের উচিত সালাহউদ্দিনের সঙ্গে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদেও বৈঠকের প্রমাণ পাওয়া গেলে ফেঁসে যাবেন সালাহউদ্দিনসহ বিএনপি নেতারা। সালাহউদ্দিনের আত্মপ্রকাশে বিএনপি সন্তুষ্ট হতে পারেনি। কারণ নাশকতাসহ সরকার উৎখাতের সব ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়বে এখন।
সর্বনাশের যে খেলায় বিএনপি নেমেছে, সেই খেলা তার সর্বনাশকেই ত্বরান্বিত করবে। সব গোমর ফাঁস হয়ে যাবে যদি সালাউদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদে নিয়ে আসা হয়। তবে ফেঁসে যাচ্ছে বিএনপি। সর্বনাশ হতে চলেছে খালেদা-তারেক রাজনীতি।