শুক্রবার, ২৫ মার্চ ২০১৬
প্রথম পাতা » ব্রেকিং নিউজ | রাজনীতি | সম্পাদক বলছি » বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের আগেই স্বাধীনতা চেয়েছিলেন : পাকিস্তানী নথিপত্র
বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের আগেই স্বাধীনতা চেয়েছিলেন : পাকিস্তানী নথিপত্র
পক্ষকাল ডেস্কঃ : বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগেই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী একজন সিনিয়র পাকিস্তানী জেনারেল সম্প্রতি তাদের গোয়েন্দা রিপোর্টের উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুর গোপন পরিকল্পনার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তার ইচ্ছার বিষয়টি এর আগে অন্যান্য অফিসার ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষকরাও উল্লেখ করেছেন।
২০১২ সালে প্রকাশিত ‘স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ শীর্ষক বইয়ে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন লিখেছেন, ‘তাদের (গোয়েন্দা সংস্থাগুলো) একজন শেখ মুজিবের জন্য একটি ফাঁদ পাতেন। একজন বিশ্বস্ত লোককে সঙ্গে নিয়ে ভ্রমন করার সময় শেখ মুজিবের একটি গাড়িতে একটি রেকর্ডিং যন্ত্র বসানো হয়েছিল।’
তিনি আরো লিখেছেন, পথিমধ্যে বিশ্বস্ত ব্যক্তি শেখ মুজিবের আলাপ শুরু করেন। শেখ মুজিব এ সময় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে তার মূল পরিকল্পনা প্রকাশ করেন।
২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর সেনা বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে লেঃ জেনারেল নিয়াজি দায়িত্ব গ্রহনের আগে ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া জান্তার অধীনে রাজা পূর্ব পাকিস্তানের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার এই বইটি হচ্ছে ‘রোড টু বাংলাদেশ’ সিরিজে ইউপিএল এর একটি সর্বশেষ প্রকাশনা।
বিখ্যাত মার্কিন শিক্ষাবিদ স্ট্যানলি ওলপার্ট ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে তার পড়াশুনার জন্য পরিচিত। তিনিও এই রেকর্ডটি পেয়েছিলেন। তিনি ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত ‘জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান হিজ লাইফ এন্ড টাইম’ শীর্ষক বইয়ে গোপন পাকিস্তানি রেকর্ডিংয়ের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে নির্বাচনী সমাবেশে যাওয়ার পথে গাড়িতে সফরসঙ্গী পাকিস্তানী সাংবাদিককে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা।’
বঙ্গবন্ধু আরো বলেছিলেন, ‘নির্বাচন শেষ হলেই আমি এলএফও (আইনী কাঠামো ব্যবস্থা) ভেঙ্গে ফেলবো। নির্বাচন শেষ হলে আমাকে কে চ্যালেঞ্জ করবে। পূর্ববর্তী পরিচয়ের কারণে বিশ্বস্ত ছিলেন বলে বঙ্গবন্ধু তাকে এসব কথা বলেছিলেন এবং তার কোন ধারণাই ছিল না যে, তার কথাগুলো গোপনে রেকর্ড করা হচ্ছে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনা বাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী মেজর সিদ্দিক সালিক আরো বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন কি পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু তার এই ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন।
তিনি ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে লিখেছেন, ‘তখন ছিল পাকিস্তানে দ্বিতীয় সামরিক শাসন জারির প্রথম বার্ষিকী। শেখ মুজিবুর রহমান একটি নির্বাচনী সমাবেশে বক্তৃতা দেয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের একটি শহরের দিকে যাচ্ছিলেন।’
তিনি আরো লিখেছেন, ‘তার গাড়ির পিছনের আসনে বসা ছিলেন নির্বাচনী সফরের খবর সংগ্রহে নিয়োজিত একজন অবাঙ্গালী সাংবাদিক। তিনি মুজিবকে কিছু সাম্প্রতিক বিষয়ে কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করেন এবং চুপিসারে তার ক্যাসেট টেপ রেকর্ডার চালু করে দেন।
সালিক বলেছেন, তিনি রেকর্ডেড কথাগুলো শুনেছেন এবং ‘এতে মুজিবের কণ্ঠ ছিল স্পষ্ট।’
সালিক লিখেছেন, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) বলছিলেন যে, ‘যে কোন ভাবেই আইয়ুব খান আমাকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠিয়ে দিয়েছে, যেখানে আমি যা চাই তাতে কেউ ‘না’ বলতে পারবে না। এমনকি ইয়াহিয়া খানও আমার দাবি প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না।
পাকিস্তানী অফিসার আরো বলেছেন, বাঙ্গালী লিডারের প্রকৃত ইচ্ছার বিষয়টি ইয়াহিয়া খানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর আরেকটি টেপ থেকেও প্রমাণিত হয়েছিল।
তিনি বলেছেন, টেপ রেকর্ডের বিষয় ছিল এলএফও, ভবিষ্যত সংবিধানের রূপরেখা সম্পর্কে ১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ ইয়াহিয়া তা জারি করেছিল। এতে ‘বিখ্যাত ছয় দফা’ বাস্তবায়নের জন্য মুজিবকে অবাধ ক্ষমতা দেয়ার বিষয়টি নাকচ করে দেয়া হয়েছিল। এদিকে, সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠককালে তার মন্তব্য আরেকবার রেকর্ড করা হয়েছিল।
সালিক লিখেছেন, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) তার সিনিয়র সহকর্মীদের সঙ্গে যখন এলএফও সম্পর্কে তার মতামত দিচ্ছিলেন, তখন তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি যে, এসব কথা ইয়াহিয়ার জন্য টেপ করা হচ্ছে।
ওলপার্ট একই টেপ রেকর্ডিংয়ের উল্লেখ করেছেন, যেখানে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আমার লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা।
সালিক লিখেছেন, ‘যখন এটি (টেপটি) ইয়াহিয়াকে শুনানো হয়, তখন তিনি বলেছিলেন, তিনি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে আমি তাকে দেখে নিব।’
এই রেকর্ডিংয়ের উল্লেখ করে সালিকের উর্ধ্বতন রাজা তার বইয়ে লিখেছেন, ইয়াহিয়া ‘সত্য শুনেছেন’ কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে কোন পদক্ষেপ নেননি। কারণ, ইয়াহিয়া খান তার নিজের অবস্থান সম্পর্কে অতিমাত্রায় আস্থাবান ছিলেন এবং মনে করেছিলেন যে, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হওয়ার কারণে তার ক্ষমতা অসীম যার ফলে তিনি তার সম্ভাব্য বিরোধীদের পরাভুত করতে পারবেন।
পাকিস্তানী আরো লিখেছেন, ‘পরবর্তী ঘটনাবলী প্রমাণ করেছে তিনি ভুল করেছিলেন।’
বঙ্গবন্ধুর ‘প্রকৃত ইচ্ছা’ সম্পর্কে পাকিস্তানের নথিপত্র সম্পর্কে মার্কিন নথিপত্রেও সমর্থন পাওয়া গেছে। তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার বিশ্বাস করেছিলেন যে, কেবল ‘কৌশলগত’ কারণেই তিনি (বঙ্গবন্ধু) তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করা থেকে বিরত ছিলেন।
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কাছে পাঠানো এক বার্তায় কিসিঞ্জার লিখেছেন, ‘তার (বঙ্গবন্ধু) গত রোববারের (১৯৭১ সালের ৭ মার্চ) ভাষণ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের ঝুঁকি না নিয়ে ক্রমান্বয়ে ক্ষমতা গ্রহনের মাধ্যমে তার লক্ষ্য (স্বাধীনতার জন্য) অর্জনের একটি প্রয়াস বলে মনে হচ্ছে যা পরবর্তীতে কার্যত একটি একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার রূপ লাভ করতে পারে।