স্বীকৃতি মেলেনি নওগাঁর ৯ বীরাঙ্গনার
বিশেষ প্রতিনিধি: স্বাধীনতার ৪৫ বছর পেরিয়ে গেলেও নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের আতাইকুলা পালপাড়া গ্রামের ৯ জন বীরাঙ্গনা আজও অবহেলিত। সরকার ঘোষিত সকল সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত তারা। ১৯৭১ সালে দেশ ও মাতৃকার টানে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এইসব নারীরা বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও আজ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি।
নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার আতাইকুলা গ্রামের প্রয়াত বাণী রানী পাল, রেনু বালা, মায়া সূত্রধরসহ ৯ জন বীরাঙ্গনা। একাত্তরের সেই দুর্বিষহ যন্ত্রণা, সামাজিক বঞ্চনার পাশাপাশি অনেকটা দুঃখ-দুদর্শা অভাব অনটন আর অসুস্থতার মধ্যেই চলছে তাদের জীবন সংগ্রাম।
সরকার সারাদেশে বীরাঙ্গনাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও সেই তালিকায় নওগাঁর রাণীনগরে ৯ জন বীরাঙ্গনার নাম তালিকাভুক্ত হয়নি।
রাণীনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে নওগাঁর ছোট যমুনা নদীর তীরে আতাইকুলা পালপাড়া গ্রাম। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল পাকহানদার বাহিনীর স্থানীয় দোসর রাজাকার আলবদরদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় প্রকাশ্য দিবালোকে সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নারকীয় তাণ্ডব চালায়।
এ সময় পাকহানদার বাহিনীর গণহত্যা, লুটপাট ও নারী নির্যাতনের মতো ধ্বংস লীলা থেকে বিশেষ করে নারীরা স্বামী সন্তানদেরকে প্রাণে বাঁচানোর শেষ আকুতিটুকু করলেও পাকিস্তানিদের মন গলাতে পারেনি। উল্টো পাকসেনারা সুযোগ বুঝে নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে নওগাঁ জেলা শহরের উদ্দেশে চলে যায়। নির্যাতিত নারী ও স্বজনদের হৃদয় বিদারক আর্তনাদ ও কান্নায় আকাশ ভারী হয়ে ওঠে।
সরেজমিন ২২ মার্চ মঙ্গলবার বিকেলে আতাইকুলা গ্রামে গিয়ে খোঁজ নিতে প্রতিবেদক যখন কালীদাসী পালের বাড়িতে উপস্থিত তখন তিনি বাড়িতে ছিলেন না। প্রতিবেশি একজন তাকে খবর দেওয়ার পর পার্শ্বে চাতালে কাজ ফেলে রেখে বাড়িতে ছুটে আসেন। কিছুক্ষণের জন্য কথা হয় তার বাড়ির আঙিনায়।
১৯৭১ সালে এই গ্রামে পাকবাহিনীর নির্যাতনের আলাপকালে ৯ বীরাঙ্গনার মধ্যে কালীদাসী পাল (৭২) জানান, ওইদিন সকালে যখন আমাদের গ্রামে পাঞ্জাবি আসে তখন আমার স্বামীসহ বাড়ির দরজা লাগিয়ে আত্মগোপনের চেষ্টা করি। কিন্তু স্থানীয় রাজাকাদের সহযোগিতায় গেটের দরজা ভেঙে আমার স্বামীকে টেনে হিঁচড়ে পাঞ্জাবিরা রাইফেল দিয়ে মারতে মারতে যোগেন্দ্রনাথের বারান্দায় ফেলে রাখে। স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাইতে গিয়ে আমার কথা না শুনে চোখের সামনে আমার স্বামীসহ ৫২ জনকে হত্যা করে উল্টো আমার উপরও তারা নানান কায়দায় নির্যাতন চালায়।
সুষমা পাল (৬৯) জানান, ওইদিন সকাল ৯টার দিকে পাঞ্জাবিরা আমার স্বামী বাড়িতে কাজ করা অবস্থায় সুরেশ্বর পালের বাড়িতে ধরে নিয়ে লাইন করে রাখে। এইদিকে পাঞ্জাবিরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লুটপাট ভাঙচুড় ও অগ্নিসংযোগসহ নানা তাণ্ডব ও নির্যাতন চালায়। আমি ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে পাশের বাড়ির এক বড় মাটির ডাবরের ভিতর আশ্রয় নেই। বাচ্চার কান্না পাঞ্জাবিরা শুনতে পেয়ে আমাকে সেখান থেকে বের হওয়ার কথা বলে। তখন আমি পালিয়ে মাঠের মধ্যে দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী মেয়েদের সাথে খারাপ আচরণ করে।
সদ্যপ্রয়াত বাণী রানীর ছোট ভাই জয়ন্ত পাল জানান, একাত্তরের ঘটনার কথা বলতে গেলে মাথা নিচু হয়ে যায়। একাত্তরের ২৫ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে নদী পার হয়ে স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় পাকবাহিনী আমাদের পাড়ায় ঢুকে লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ শুরু করলে বাণী পালের চোখের সামনে তার বাবা শ্রীমন্ত পালকে ধরে মারপিট শুরু করে। সাথে সাথে বীরের মতো সেই সময়ের কিশোরী বাণী পাল পাঞ্জাবিদের রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে পাশের একটি কূপে ফেলে দিয়ে হাতাহাতি শুরু করলে পাক-হায়েনারা তার বাবাকে গুলি চালালে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। গুরুতর আহত অবস্থায় ভাগ্যক্রমে সে বাঁচলেও বাণী পাল তাদের নির্মম নিষ্ঠুর নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি।
তিনি আরও বলেন, দেশ স্বাধীনের ৪৫ বছর পরও আমাদের কেউ খোঁজ রাখে না। কান্নাজড়িত কণ্ঠে জয়ন্ত বলেন, লজ্জা ঘৃণায় আমার দিদি বিবাহ করেননি।
তবে অন্য ৬ জন বীরাঙ্গনা রেণু বালা, ক্ষান্ত বালা পাল, মায়া সূত্রধর, রাশমনী সূত্রধর, সন্ধ্যা পাল, সুষমা সূত্রধর ও তাদের স্বজনরা লজ্জা ঘৃণা, ক্ষোভে স্বজন হারানোর বেদনায় তারা মুখ খুলতে রাজি হয়নি।
আতাইকুলা গ্রামের শহীদ পরিবারের সদস্য গৌতম পাল জানান, স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথা এই গ্রামের শহীদ ও বীরাঙ্গনার পরিবারের সদস্যরা রাষ্ট্রীয় কোনো সুযোগ সুবিধা পায়নি। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তাদের নামও স্থান পায়নি। পরিতাপের বিষয়, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকার পরও এ দপ্তর সে দপ্তর ঘুরেও আমাদের কোনো একটা সুরাহা হলো না।
রাণীনগর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অ্যাডভোকেট ইসমাইল হোসেন জানান, ‘আতাইকুলার ৯ বীরাঙ্গনার জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. ইসরাফিল আলম এমপি এবং শক্তি ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ইতোমধ্যে ২টি করে গাভী প্রদান করা হয়েছে। তাছাড়া তারা যেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে পারে সে ব্যাপারে যথাযথ প্রক্রিয়ায় আবেদন করা হয়েছে। আমরা এখন গেজেটভুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছি।’
স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. ইসরাফিল আলম এমপি বলেন, ‘বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও জননেত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার ও বীরাঙ্গনাদের ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক। আতাইকুলা গ্রামের ৯ বীরাঙ্গনার ব্যাপারে নিয়ম মাফিক যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাতে তারা তালিকাভুক্ত হতে পারে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।