বুধবার, ৬ এপ্রিল ২০১৬
প্রথম পাতা » অর্থনীতি | জেলার খবর | ব্রেকিং নিউজ | রাজনীতি » বাঁশখালীর ঘটনায় আজ সকাল সন্ধ্যা হরতাল
বাঁশখালীর ঘটনায় আজ সকাল সন্ধ্যা হরতাল
পক্ষকাল ডেস্কঃ : বাঁশখালিতে যে রণক্ষেত্র হয়েছিল তার পিছনে ছিল বহিরাগত অস্ত্রধারীরা। তাদের উস্কানিতেই রক্তাক্ত হয়েছে চট্টগ্রামের উপকূলীয় জনপদ বাঁশখালী। গত সোমবার ১৪৪ ধারা ভাঙতে প্রথমে মিছিল থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে বহিরাগত অস্ত্রধারীরাই। বিভিন্ন দিক থেকে তাদের পরিকল্পিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। দাবি হিসেবে সামনে বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকলেও এর নেপথ্যে রয়েছে বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধন।
সরেজমিন এলাকায় গিয়ে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে। পুলিশকে লক্ষ্য করে কারা গুলি ছুড়েছে সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে আন্দোলনকারীরাও। পুলিশের এভাবে গুলি ছোড়া উচিত হয়েছে কি-না তা জানতে তদন্ত শুরু করেছে প্রশাসন। এদিকে নিহত ও হামলার ঘটনায় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করে বাঁশখালী থানায় পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে তিনজনকে। তবে খুনিদের গ্রেফতারের দাবিতে বাঁশখালীতে আজ বুধবার (৬ এপ্রিল) হরতাল ডেকেছে ছাত্র ঐক্য ফোরাম নামের একটি সংগঠন।
প্রসঙ্গত, ১৪৪ ধারা ভেঙে সমাবেশ করাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও এলাকাবাসীর ত্রিমুখী সংঘর্ষে সোমবার বাঁশখালী গণ্ডামারা ইউনিয়নে চারজন নিহত হন।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার (সাতকানিয়া সার্কেল) একেএম এমরান ভুঁইয়া বলেন, ‘দেশে তৈরি বন্দুকের গুলি দিয়েই পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি করা হয়।’ চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ডাকাতরা এ ধরনের দেশি অস্ত্র ব্যবহার করে বলে জানান তিনি। তবে ১৪৪ ধারা ভেঙে হওয়া সমাবেশে নেতৃত্ব দেওয়া বিএনপি নেতা লিয়াকত আলী অভিযোগ করেন, ‘জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণেই আন্দোলন হয়েছে। পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালানোতেই চারজন নিহত হন। মিছিল থেকে কাউকে গুলি করা হয়নি। এখানে অন্য কোনো রাজনীতিও নেই।’ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত এলাকাবাসী আন্দোলন চালিয়ে যাবে বলেও ঘোষণা দেন তিনি।
সরেজমিন বাঁশখালী গিয়ে জানা যায়, ১৬ মামলার আসামি লিয়াকত আলী আসন্ন নির্বাচনেও প্রার্থী হতে চান ইউনিয়নে। এলাকাবাসী বলছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে ধ্বংস হয়ে যাবে আশপাশের সব এলাকা_ এমন তথ্য শুনেই ১৪৪ ধারা ভাঙতে উৎসাহী হয় তারা। তাদের এ উৎসাহের সুযোগ নিতে আগে থেকে গ্রামে জড়ো করা হয় বহিরাগতদের। তাদের মধ্যে আনসার, আমিন, লিয়াকত, জসিম, মেম্বার কামাল, আজিজসহ বেশ কয়েকজন জলদস্যুও ছিলেন। পরিকল্পিতভাবে তারাই প্রথমে পুলিশের ওপর গুলি চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নেওয়ার উস্কানি দেয়। তাদের এ ফাঁদে পা দেয় পুলিশ প্রশাসনও। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না নিয়েই সমাবেশস্থলে ১৪৪ ধারা জারি করেছিল প্রশাসন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আঘাত এলে বিকল্প যে প্রস্তুতি নিয়ে রাখা দরকার সেটির পরিকল্পনা ছিল না পুলিশের। বাধা পেয়ে তাই নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশও।
বর্তমান চিত্র :গতকাল সকালে সংঘর্ষস্থল ও আশপাশের এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পরিস্থিতি এখনও থমথমে। মানুষের মধ্যে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। বাঁশখালীর জনগণের আলোচনায় বিষয়বস্তু গত সোমবারের ঘটনা। পুলিশের ভূমিকা এবং স্থানীয় দু’পক্ষের আন্দোলন নিয়ে পুরো জনপদেই চলছে নানা বিশ্লেষণ। পুলিশ সদস্যদের গণ্ডামারা, সরলসহ আশপাশের এলাকাগুলোয় নিয়মিত টহল দিতে দেখা গেছে। গ্রেফতার আতঙ্কে এসব গ্রাম এখন প্রায় পুরুষশূন্য। এলাকাবাসী জানায়, ১৪৪ ধারা ভেঙে মাঠে জমায়েত হতে সেদিন প্রচার চালানো হয়েছিল মাইকে। তাদের বলা হয়েছিল, সমাবেশ হলে আর বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে না বাঁশখালীতে। পুলিশও পিছু হটে মেনে নেবে তাদের দাবি। এভাবে ভুল বোঝানোর কারণেই ১৪৪ ধারা ভাঙতে উৎসাহী হয় এলাকাবাসীর একাংশ। তবে এলাকাবাসীর আরেক অংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পক্ষে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে এলাকায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে বলে ওই পক্ষ প্রচার চালায়। বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে এলাকাবাসী এভাবে দ্বিধাবিভক্ত থাকার সুযোগই নেয় বহিরাগতরা। এলাকাবাসীর সঙ্গে মিশে পুলিশের ওপর গুলি চালায় তারা। গতকালও স্থানীয় রহমানিয়া মাদ্রাসা মাঠে নিহতের ঘটনার বিচার দাবিতে বিক্ষোভ করেছে এলাকাবাসীর একাংশ। বিক্ষোভে যোগ দিতে গতকালও মাইকে প্রচার চালানো হয়।
নেপথ্যে জামায়াত-শিবির :বাঁশখালীতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত। এটিকেই কাজে লাগাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। এখানে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে আছে জামায়াতের উপজেলা আমির জহিরুল ইসলাম। ভাইস চেয়ারম্যান পদে থাকা বদরুল হকও জামায়াত নেতা। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদেও আছে জামায়াতের নারীনেত্রী সাফিয়া বেগম। তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিরা সবাই জামায়াতের হওয়ায় এখানে যে কোনো আন্দোলন করতে সুবিধা পায় বিএনপি-জামায়াত। সাঈদীর রায়ের পরও এই বাঁশখালীতে তাণ্ডব চালিয়েছিল জামায়াত-শিবিরের লোকজন। এবারও সহিংস ঘটনার নেতৃত্বে আছেন বিএনপির এক সাবেক জনপ্রতিনিধি।
এলাকাবাসী বলছে, বাঁশখালীর পরিস্থিতি অশান্ত করতে লিয়াকতের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক ইন্ধন। জামায়াত-বিএনপি অধ্যুষিত এ এলাকার জনপ্রতিনিধিরা প্রশ্রয় দিচ্ছে লিয়াকতকে। ইউপি চেয়ারম্যান আরিফ উল্লাহও জামায়াত সমর্থিত। উপরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে থাকলেও নেপথ্যে লিয়াকত আলীর পক্ষেই কাজ করেছেন আরিফ উল্লাহ_ এমনটিই ধারণা তাদের।
প্রসঙ্গত, বাঁশখালীতে চারজন নিহত হওয়ার পর গতকাল সন্ধ্যায় বাঁশখালী গেছেন বিএনপির চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। নিহতদের জানাজায় অংশ নেন তিনি। এ সময় তিনি বলেন, ‘নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোর জন্য পুলিশ দায়ী। যথাযথ তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
তিন মামলায় আসামি হাজারো গ্রামবাসী : চারজন নিহত হওয়ার ঘটনা এবং সরকারি কাজে বাধা ও হামলার অভিযোগে বাঁশখালী থানায় তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে নিহত চারজনের পরিবার দুটি হত্যা মামলা করেছে। প্রশাসন, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর ওপর হামলার অভিযোগে অন্য মামলাটি করেছে পুলিশ। বাঁশখালী থানার ওসি স্বপন কুমার মজুমদার বলেন, ‘পুলিশের মামলাটির বাদী থানার উপপরিদর্শক বাহার মিয়া। ৫৭ জনের নাম উল্লেখ করে এ মামলায় অজ্ঞাত তিন হাজার ২শ’ জনকে আসামি করা হয়েছে।’ সংঘর্ষে নিহত মর্তুজা আহমদ, তার মেয়ের জামাই মোহাম্মদ জাকের হোসেন এবং তার ভাই আনোয়ার আহমদ নিহতের ঘটনায় দুই সহোদরের ভাই মৌলভী বশির আহমদ একটি হত্যা মামলা করেছেন। এতে ছয়জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত এক হাজার ৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। অন্য হত্যা মামলাটি করেছেন আরেক নিহত জাকির আহমেদের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম। তার মামলায় ছয়জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাত ১ হাজার ৪০০ জনকে।
আজ হরতাল : গণ্ডামারায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত গ্রামবাসীর ওপর নির্বিচারে গুলি ও হতাহতের ঘটনার প্রতিবাদে আজ বুধবার বাঁশখালীতে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে ছাত্র ঐক্য ফোরাম। গতকাল চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ থেকে হরতালের ডাক দেন ফোরামের আহ্বায়ক শাহনেওয়াজ চৌধুরী। মানববন্ধনে তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাঁশখালী ছাত্র ঐক্য ফোরাম, বাঁশখালী স্বপ্নতরী সংঘ, গণসংহতি সমিতি চট্টগ্রামসহ বেশকিছু সংগঠনের নেতাকর্মীরা ব্যানার, ফেস্টুনসহ অংশ নেন। এদিকে বাঁশখালীতে পুলিশের গুলিতে নিহতের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে গতকাল বিবৃতি দিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। বিবৃতিতে এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানানো হয়।
এ ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ঢাকায় সমাবেশ করছে। সমাবেশ থেকে আগামী ৮ এপ্রিল সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
কে এই লিয়াকত আলী? : চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা কমিটির সদস্য লিয়াকত আলী। জোট সরকার ক্ষমতায় থাকলে তিনি গণ্ডামারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১১ সালেও ইউপি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু জামায়াতের প্রার্থী আরিফ উল্লাহর কাছে তিনি পরাজিত হন। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুল আলম মাস্টারের দাবি, আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতেই এলাকাবাসীকে বিভ্রান্ত করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছেন লিয়াকত। তার নির্দেশেই বহিরাগতরা এলাকাবাসীর সঙ্গে মিশে গুলি চালিয়েছে পুলিশের ওপর।
বাঁশখালী থানার ওসি স্বপন কুমার মজুমদার বলেন, ‘বিভিন্ন অপরাধে বাঁশখালী থানায় লিয়াকত আলীর বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা রয়েছে। এটি নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন লিয়াকত। তাই বহিরাগত এনে তিনি পুলিশের ওপর পরিকল্পিত হামলা করেছেন।’ তবে পুলিশের এ দাবি অস্বীকার করে লিয়াকত আলী বলেন, ‘জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতেই অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।’
এদিকে বাঁশখালীর ঘটনায় লিয়াকত আলীকে দায়ী করে গতকাল তার ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন করেছে স্থানীয় ছাত্রলীগ। উপজেলা কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত এ কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরানুল হক। তিনি বলেন, ‘এলাকার নিরীহ লোকজনকে উস্কানি দিয়ে রাস্তায় নামিয়েছে বিএনপির লিয়াকত। তার কারণেই খুন হয়েছে নিরীহ চারজন। তাই তার ফাঁসি দাবি করছি।’ প্রসঙ্গত, গণ্ডামারা ইউনিয়ন থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে হচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
বিচার চায় এলাকাবাসী :বাঁশখালীর সহিংসতায় যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায় এলাকাবাসী। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ফজলুল কাদের বলেন, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে এলাকাবাসী দ্বিধাবিভক্ত। এটিরই সুযোগ নিয়েছে গুটিকয়েক সুবিধাভোগী। বহিরাগত এনে তাই ঘোলাটে করা হয়েছে পরিস্থিতি। আমরা দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’ রাজমিস্ত্রি নূর আহমদ বলেন, ‘কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে আমাদের ফসলের মাঠ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে শুনেছি। তাই আমরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি।’ মনির হোসেন নামের এক কৃষক বলেন, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হলে আমরা ভিটেমাটি হারাব। এমন ধারণা থেকে আন্দোলনে এসেছি। আমরা এ ঘটনার বিচার চাই।’