আইডিআরএ’র প্রজ্ঞাপনে অস্বস্তিতে বিমা খাত
এজেন্ট লাইসেন্সে প্রশিক্ষণ
পক্ষকাল প্রতিবেদক
বিমা আইনের তোয়াক্কা না করেই বিমা কোম্পানির এজেন্ট লাইসেন্সের জন্য ৭২ ঘণ্টার প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ(আইডিআরএ)। আগামী ১ জানুয়ারি থেকে কোম্পানিগুলোকে এ নির্দেশনা কার্যকর করতে হবে।
আইডিআরএ বলছে, বিমা আইন ২০১০ এর ১২৪(৪) ধারা ও জাতীয় বিমা নীতি -২০১৪’র ১.৪.২ অনুচ্ছেদ অনুসারে এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অথচ বিমা আইন ২০১০ এর ১২৪(৪) ধারায় বলা হয়েছে, বিমা এজেন্ট নিয়োগের বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে(আইডিআরএ)প্রবিধান তৈরি করতে হবে। এই প্রবিধানের মাধ্যমেই বিমা এজেন্টদের যোগ্যতা, এজেন্টের মেয়াদকাল, নবায়ন ফিসহ অন্যান্য শর্ত নির্ধারণ করতে হবে।
আইনে এজেন্ট হওয়ার যোগ্যতার বিষয়ে প্রবিধান তৈরির এমন বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা না করেই এজেন্টদের প্রশিক্ষণ বাধ্যমুলক করেছে আইডআরএ। এমনকি কোন ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থাৎ কোম্পানির নিজস্ব প্রশিক্ষণ একাডেমি না কি বাহিরের কোন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিতে হবে তাও ঠিক করা হয়নি। যারা প্রশিক্ষণ দিবেন তাদের যোগ্যতা কি হবে সে বিষয়েও কোন নীতিমালা করা হয়নি।
ফলে হঠাৎ করেই এজেন্টদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে আইডিআরএ’র এমন নির্দেশনাই অস্বস্তিতে পড়েছে বিমা খাত। এতে বিমা খাতে এক ধরনের অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে। এমনকি এজেন্টদের প্রশিক্ষিত করে তোলার মতো একটি ভালো উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারে বলেও কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এদিকে অভিযোগ উঠেছে, একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ একাডেমিকে বিশেষ সুবিধা দিতেই এজেন্টদের জন্য প্রবিধান মালা তৈরি না করেই তাড়াহুড়ো করে ৭২ ঘণ্টার প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করেছে আইডিআরএ। প্রজ্ঞাপন জরির দুই দিন আগে ‘একাডেমি অব লার্নিং’ নামের বিশেষ এই প্রশিক্ষণ একাডেমিটির উদ্বোধন করেন খোদ আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ।
সন্ধানী লাইফের ব্যবস্থাপনা পরিচারক (এমডি) ও বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন’র (বিআইএ) সহ-সভাপতি আহসানুল ইসলাম টিটু বাংলানিউজকে বলেন, আইনে কারা এজেন্ট হতে পারবে তার একটি নীতিমালা করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের কোন নীতিমালা না করেই এজেন্টদের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
টিটু বলেন, শোনা যাচ্ছে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারির আগে একটি প্রশিক্ষণ একাডেমি উদ্বোধন করা হয়েছে। এই প্রশিক্ষণ একাডেমিকে সুবিধা দিতেই এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও আভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। আগামী ১৮ ডিসেম্বর বিআইএ’র বার্ষিক সাধারণ সভা(এজিএম) অনুষ্ঠিত হবে। এরপর প্রজ্ঞাপনের বিষয়টি নিয়ে বিআইএ’র পক্ষ থেকে সকল কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করা হবে। আলোচনার ভিত্তিতে বিআইএ থেকে এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
প্রবিধান না করে প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করাই বিমা আইন ২০১০ লঙ্ঘন হচ্ছে কি না জানতে চাইলে আইডিআরএ’র সদস্য সুলতান উল আবেদিন মোল্লা বাংলানিউজকে বলেন, প্রবিধান নেই তাই বলে কি কার্যক্রম থেমে থাকবে? আইনে অনুযায়ী প্রবিধান তৈরির কার্যক্রম চলছে। প্রবিধানে সকল বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এজেন্টদের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করার কারণে বিমা খাতে দক্ষ জনবল সৃষ্টি হবে।
মেঘনা ইন্স্যুরেন্স’র উপদেষ্ট নুরুল হক বাংলানিউজকে বলেন, এজেন্টদের প্রশিক্ষণ ভালো উদ্যোগ। তবে আইনে যা বলা আছে তা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই তা করা উচিত। আইনের শর্ত বাস্তবায়ন না করে কিছু করা হলে তাতে বিমা খাতে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
এজেন্টদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে আইডিআরএ’র প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এজেন্টদের পাশাপাশি ৭২ ঘণ্টার এ প্রশিক্ষণ ফিনান্সিয়্যাল অ্যাসোসিয়েটদেরকেও নিতে হবে। বর্তমানে যারা এজেন্ট ও ফিনান্সিয়্যাল অ্যাসোসিয়েট হিসেবে কাজ করছে তাদেরকেও প্রশিক্ষণ নিতে হবে। আর প্রশিক্ষণ নিতে হবে কর্তৃপক্ষের স্বীকৃত প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান থেকে।
প্রগতি লাইফের এমডি জালালুল আজিম বাংলানিউজকে বলেন, এজেন্টদের প্রশিক্ষণ একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু প্রবিধান তৈরি না করেই এ ধরনের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করার কারণে এ উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারে। তাড়াছা আইনে প্রবিধান তৈরির কথা বলা হলেও তা না করে প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করে প্রজ্ঞাপন জরি করাও আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
তিনি বলেন, বাইরের দেশে কোম্পানিতেই এজেন্টদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। আবার কিছু ক্ষেত্রে বাইরে থেকেও এজেন্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু আইডিআরএ’র জারি করা প্রজ্ঞাপনে কোন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিতে হবে তার কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি দেশের ভিতরে এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান আছে কি না তাও জানানো হয়নি। ফলে আইডিআরএ’র এ নির্দেশনাই বিমা খাতে এক ধরনের অস্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি হবে।
এদিকে আইডিআরএ সূত্রে জানা গেছে, এজেন্ট ও ফিনান্সিয়্যাল অ্যাসোসিয়েটদের প্রশিক্ষণ একাডেমি হিসেবে একমাত্র ‘একাডেমি অব লার্নিং’ এই প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দিয়েছে আইডিআরএ। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন সাবেক বাণিজ্য সচিব আলমগীর ফারুক চৌধুরী।
জানতে চাইলে আইডিআরএ’র সদস্য কুদ্দুস খান বাংলানিউজকে বলেন, শুধু একাডেমি অব লার্নিং একমাত্র এজেন্ট প্রশিক্ষণ একাডেমি হবে না। কেউ এজেন্টদের প্রশিক্ষণ একাডেমির জন্য আইডিআরএ’র কাছে আবেদন করলে অনুমোদন দেওয়া হবে। তবে তাদেরকে অবশ্যই দেশের সর্বত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো সামর্থ থাকতে হবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় প্রশিক্ষণ একাডেমির শাখা থাকতে হবে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একাডেমি অব লার্নিং নামের এই প্রতিষ্ঠানটির ঢাকার বাহিরে বর্তমানে নিজস্ব কোন প্রশিক্ষণ একাডেমি নেই।
অথচ এজেন্ট পরিচয় দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক হাসান ও হিসাব বিভাগের কর্মকর্তা মোকাম্মেল হোসেনের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, তাদের ২০০টি প্রশিক্ষণ একাডেমি আছে এবং ২০০ জন অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক আছেন। যাদের প্রত্যেকের বিমা পেশার ওপর ১০ থেকে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
প্রজ্ঞাপন জারির এক সপ্তাহের মধ্যে আপনারা কিভাবে ২০০টি প্রশিক্ষণ একাডেমি এবং ২০০ জন প্রশিক্ষক নিয়োগ করলেন জানতে চাইলে হাসান বলেন, প্রজ্ঞাপন কয়েকদিন আগে জারি করা হলেও আমরা এটি নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে কাজ করছি।
আপনারা কি আগেই জানতেন এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হবে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ঠিক তা না। তবে আমরা ৭ থেকে ৮ মাস ধরে প্রশিক্ষণ একাডেমি নিয়ে কাজ করছি।
ঢাকার বাইরে কি ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে জানতে চাইলে হাসান বলেন, আমাদের ঢাকাস্থ কার্যলয়ের মাধ্যমে ফোন দিয়ে অথবা সরাসরি অফিসে এসে নিবন্ধন করতে হবে। এরপর কতোজন প্রশিক্ষণ নেবেন তার উপর ভিত্তিতে করে নির্ধারণ করা হবে কোথায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
তাহলে কি ঢাকার বাইরে আপনাদের নিজস্ব কোন প্রশিক্ষক একাডেমি নেই এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, বিভিন্ন একাডেমির সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছে। কিন্তু প্রশিক্ষণ দেওয়ার সঙ্গে খরচের একটি বিষয় জড়িত। তাই কতোজন প্রশিক্ষণ নেবেন তার উপর ভিত্তি করেই প্রশিক্ষণের স্থান নির্ধারণ করা হবে।