সহিংসতার ভোটে ইসির স্বস্তি
ডেস্কঃ ব্যাপক সহিংসতা ও অনিয়মের অভিযোগের মধ্যেই দলীয়ভাবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সব ধাপ পেরোলো নির্বাচন কমিশন, যা নিয়ে ‘স্বস্তি’ও প্রকাশ করেছে তারা।
অবশ্য এই ‘স্বস্তি’র মধ্যে এক ধরনের প্রথাগত ‘সংস্কৃতি’ দেখছে ভোট পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ।
তারা বলছেন, সহিংসতা-অনিয়ম আর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার যে রেকর্ড হয়েছে তাতে এবারের ভোট গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।
গত ফেব্রুয়ারিতে এই ইউপি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর শতাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটে। তার মধ্যে পাঁচ ধাপের ভোটের দিন মারা যায় অন্তত ৩৫ জন; বাকিরা ভোটের আগে-পরের সহিংসতায়।
শনিবারও শেষ ধাপের ভোটের দিন মারা গেছেন আরও চার জন।
স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে জনপ্রিয় হিসেবে পরিচিত এই নির্বাচনে এবার সহিংসতা বেড়েছে; রেকর্ড হয়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সংখ্যায়।
এর আগে এরশাদের শাসনামলে চেয়ারম্যান পদে সর্বোচ্চ ১০০ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার এবং সহিংসতায় ৮০ জনের প্রাণহানির তথ্য পাওয়া গেছে।
‘আগের যে কোনো সময়ের’ তুলনায় ‘ভালো নির্বাচন’ আয়োজনের দাবি করে নির্বাচন কমিশন বলেছে, সহিংসতার জন্য তাদের ব্যর্থতা নয়, বরং মানুষের ‘মনস্তাত্ত্বিক’ কারণই দায়ী।
শেষ ধাপে এসে এবারের সহিংসতা নিয়ে ব্যাখ্যা তুলে ধরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেন, “আগের চেয়ে সামগ্রিকভাবে ভালো নির্বাচন করা গেছে। যেখানে জীবনের দাম সব থেকে কম, সেখানে এমন প্রাণহানি দুঃখজনক।”
সিইসি বলেন, “নির্বাচনের সহিংসতার বড় কারণ হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। আজকাল আমাদের মধ্যে যে অস্থিরতা, তা এখন সমাজের সর্বস্তরে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ছোট ছোট বাচ্চাদের আছড়িয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে সামান্য কারণে; মোবাইল ফোন চুরির জন্য মেরে ফেলা হচ্ছে।
“জীবনের দাম এখন সবচাইতে কম হয়ে গেছে। সব জিনিসেরই দাম বাড়ছে শুধু জীবন ছাড়া।”
সহিংসতা নিয়ে জানতে চাইলে কাজী রকিব বলেন, “যেকোনো মানুষের প্রাণহানি দুঃখজনক বিষয়; কমিশন শোকাহত। আমরা চাই না একটিও প্রাণহানি হোক; কিন্তু অন্যদিকে শত-সহস্র নিরীহ ভোটার, নির্বাচনী কর্মকর্তা, রাষ্ট্রীয় মালামাল সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা করা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। যেটুকু ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন আমরা নিয়েছি।”
গত ফেব্রুয়ারি থেকে চার মাস ধরে চলা ভোট অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে কেন ভালো করা গেল না- তার জবাবে উত্তর এল- ‘ভালোই হয়েছে’।
তিনি বলেন, “আমরা মনে করি আগের চাইতে ভালো নির্বাচন করা গেছে। শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে। সামগ্রিকভাবে বলছি আমরা ইমপ্রুভ করেছি।”
সহিংসতা রোধে সামাজিক আন্দোলন জোরালো হলে আগামীতে আরও ভালো নির্বাচন করা যাবে বলে আশা কাজী রকিবের।
“সহিংসতা রোধে আমাদের সামাজিক পারসেপশনটা পরিবর্তন আনতে হবে। মটিভেশন দরকার। তাহলে ভবিষ্যতে আইন শৃংখলাবাহিনীর সহায়তা ছাড়াই নির্বাচন করতে পারব।”
নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য ছিল খানিকটা ভিন্ন; তারা বলেছেন, ইসি তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বক্তব্য দিচ্ছে, বাস্তবতা ভিন্ন।
ভোট পর্যবেক্ষক সংস্থার মোর্চা ইলেকশন ওয়ারর্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) পরিচালক আব্দুল আলীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, কোথাও কোথাও শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে শেষধাপে; কিন্তু সহিংসতা ও অনিয়মও হয়েছে বেশি।
তিনি বলেন, “তুলনামূলকভাবে পঞ্চম ধাপ থেকে লোক কম মারা গেছে। কিন্তু ৮০-৯০ লোক আহত হয়েছে, অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন; অনিয়মও হয়েছে। সব মিলিয়ে এ ইউপি ভোটে যে সহিংসতা, অনিয়ম ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার রেকর্ড হয়েছে তা ইতিহাসে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।”
ইসির ‘স্বস্তি’ প্রকাশকে এক ধরনের ‘সংস্কৃতি’ হিসেবেই দেখছেন আলীম।
“কোন বিবেচনায় তারা ভালো ভোট হয়েছে বলছেন তা ইসি জানেন। তবে সব সময়ই বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া সুষ্ঠু ভোট হয়েছে বলে দাবি করে এসেছে- এটা আমাদের কালচার। শেষে এসে প্রমাণ হয়েছে- ইসি চাইলে আরও ভালো নির্বাচন করতে পারত।”
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ- জানিপপ চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ জানান, গণতন্ত্রের নামে এতো মানুষের প্রাণ সংহার ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার রেকর্ড হয়েছে এই ভোটে। ইসি তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বক্তব্য দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, তাদের অনেক কিছু করার ছিল।
“ছয় ধাপে ভোট করেও এতো সহিংসতা হয়েছে। এতে ধাপে ধাপে ভোটের কোনো সুফল প্রত্যক্ষ করি না। এখন সময় এসেছে নতুন করে ভাববার। ভোটের নামে প্রাণহানি না করে আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার আনার।”
বর্তমান ইসির মেয়াদ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত থাকায় সবশেষ বড় সাধারণ নির্বাচন শেষ করে ‘স্বস্তি’ বোধ করাই স্বাভাবিক বলে মানছেন তিনি।
জানিপপ চেয়ারম্যান বলেন, “সামনে দুটো সিটি নির্বাচন করবেন তারা। এখন ভালো ভোট হয়েছে দাবি করে সামনে পথ চলাই এখন কমিশনের ভাবনা হতে পারে।”