আ’লীগ-জাসদ টানাপোড়েন
ডেস্ক ঃ
জাসদকে নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে জোটভুক্ত নেতাদের মধ্যে শুরু হয়েছে টানাপোড়েন।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। দলটির এক অংশের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সরকারের তথ্যমন্ত্রী। ১৪ দলীয় জোটের মুখ্য শরিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যে জাসদের স্বাধীনতা পরবর্তী কালের পুরো কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলায় জোটেই ‘উদ্বেগ’ তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ও নেতাদের দাবি, দেশে এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি যে পুরনো বিষয় সামনে এনে বিতর্ক তৈরি করতে হবে। সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার রাজনীতি না থাকলে, শক্ত কোনো বিরোধীদল না থাকলে এমনটা হতে পারে। আবার কেউ বলছেন নীতির বাইরে গিয়ে রাজনীতি করলে এমনটা হতে পারে।
জাসদ নিয়ে মহাজোটের সাম্প্রতিক বিতর্ক সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক মন্ত্রী ড. মিজানুর রহমান শেলী দ্য রিপোর্ট টুয়োন্টির ফোর ডটকমকে বলেন, ‘কোনো এক রাজনৈতিক দল যখন প্রবল শক্তিধর হয়ে উঠে তখন এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘এমন কী হল? হঠাৎ করে জাসদের পুরনো কথা বার্তা ঘেঁটে সামনে বের করা, তাদের জোটের মধ্যে টানাপোড়েন, অন্তর্দ্বন্দ্ব, বিভাজন দেখা দিয়েছে- কিনা এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এটা ভাবনার বিষয়।
সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার রাজনীতি না থাকলে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের এমন ঘোষণা উদ্বেগের কারণ। যেহেতু তিনি (ইনু) মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছে। আজকের প্রেক্ষাপটে এটা খুব চাঞ্চল্যকর ঘটনা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘এটা হলো অবসম্ভাবী পরিণতি। নীতি বিবর্জিত রাজনীতি করলে এমনটা হবে এটাই স্বাভাবিক।’
তিনি বলেন, ‘৭৫ সালে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল জাসদ। তারপরও তাদের নিয়ে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করছে। তারা (জাসাদ) এমন ভাষায় কথা বলেন, যার জবাব নেই। রাজনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না।’
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘জাসদই হঠকারী পট পরিবর্তনের প্রেক্ষিত সৃষ্টি হয়েছিল। সন্ত্রাস ও হত্যার রাজনীতি সেই সময় (৭২ থেকে ৭৫) উভয়পক্ষের (আওয়ামী লীগ-জাসাদ) হাত দিয়েই শুরু হয়েছে। সুতরাং এই এখন পরস্পর বিরোধী যে অবস্থান এটাই হওয়া স্বাভাবিক পরিণতি বলেই মনে হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন আওয়ামী লীগের মধ্যে মতবিরোধ চলছে। দলের বড় একটি অংশ এভাবে রাজনীতি করতে চায়। হয়তো ইনু সাহেবরা তার উল্টোটা করতে চাচ্ছে এবং কথা বার্তাও বলছেন উল্টা ভাবেই। উনারা (ইনু) তো শেষ করে ফেলার রাজনীতি করেন। গণতান্ত্রিক সহনশীলতার রাজনীতির মধ্যে তারা নেই। গণতন্ত্রের মূল ভাষা তারা বিশ্বাস করেন না। একই কারণেই হয়তো এখন এমনটা শুরু হয়েছে।’
জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) সভাপতি শফিউল আলম প্রধান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট করে মতামত দেওয়া কঠিন। মনে রাখতে হবে ক্ষমতার প্রয়োজনে আদর্শিক অবস্থান থেকে রাজনীতি না করে জোড়াতালি দিয়ে সাময়িকভাবে ক্ষমতা ধরে রাখা যায়। একটি নির্দিষ্ট সময় পরে এটা বুমেরাং হয়।’
শফিউল আলম প্রধান বলেন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের কোনো চাপ আছে কি না এটা সরকার ভাল বলতে পারবে। পট পরির্বতনের কোনো ধারা তৈরি হচ্ছে কিনা? যদি হয়ে থাকে এটাও খারাপ।’
সোমবার (১৩) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনে (টিএসসি) ছাত্রলীগের এক সভায় জাসদ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারক-বাহকেরা এক’শ ভাগ ভণ্ড বলে মন্তব্য করেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
তিনি বলেন, জাসদ থেকে মন্ত্রী করায় আওয়ামী লীগকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
জাসদকে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিবেশ সৃষ্টিকারী আখ্যায়িত করে আশরাফ বলেন, ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদীরা ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন একটি সফল মুক্তিযুদ্ধকে সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে বিতর্কিত করতে নানা অপচেষ্টা চালিয়েছে। এরা যদি বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিবেশ সৃষ্টি না করত তাহলে বাংলাদেশ আজ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি ভিন্ন বাংলাদেশ দেখত। সব সময় লক্ষ্য রাখবেন হঠকারীদের কখনই প্রশ্রয় দেবেন না। তারা বড় বড় কথা বললেও তাদের সাহস কম। এই বৈজ্ঞানিক বিপ্লবীরা শতভাগ ভণ্ড।’
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের এই বক্তব্যের এক দিন পরই মঙ্গবার(১৪ জুন) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক সভায় তাকে ‘থামাতে’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেছেন জাসদ নেতারা। তারা বলেছেন, এ ধরনের কাদাছোড়াছুড়ি ১৪-দলীয় জোটের ঐক্য বিনষ্ট করবে।
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুকে হত্যার হুমকির প্রতিবাদে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যখন আমরা ঐক্যবদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কাজ যখন শেষ করার কাজ করছি। প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে তথ্যমন্ত্রী যখন অক্নান্ত পরিশ্রম করছেন, তখন এই ধরনের কাদা-ছোড়াছুড়ি আমাদের ঐক্য বিনষ্ট করবে। মুক্তিযুদ্ধের শক্তিকে দুর্বল করবে। বরং আসুন জঙ্গি মোকাবিলা ও নাগরিকের নিরাপদ জীবনের জন্য, গুপ্তহত্যা বন্ধ করতে ১৪ দলকে আরও শক্তিশালী করি।’
সমাবেশে জাসদের নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন সৈয়দ আশরাফের উদ্দেশে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে বলছি - আপনি থামান, আপনার এই মন্ত্রীকে থামান। এই সংকটে তিনি যে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিচ্ছেন, যে অনৈক্যের সৃষ্টি করছেন, অবিলম্বে তার মুখ বন্ধ করুন। আর সৈয়দ আশরাফকে বলব আপনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দিকে মনোযোগ দিন। আপনি কীভাবে মন্ত্রিত্ব চালান আমরা জানি, দেশবাসী জানে। আমরা তা বলতে পারি। কারণ আমরা মহাজোটের অংশ। জনপ্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় সেখানে মনোযোগ দিন।’
শেখ হাসিনার উদ্দেশে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘পরিষ্কারভাবে আপনাদের বলে দিতে হবে, ঐক্য চান কি চান না। ১৪ দলের ঐক্য থাকবে কি থাকবে না? একদিকে আমাদের সভাপতি ও ১৪ দলের অন্যতম নেতার নামে বিষোদ্গার করবেন, আর অন্যদিকে জঙ্গি ঠেকাবেন এটা হতে পারে না। আমরা মহাজোট সরকারে আছি, ১৪ দলে আছি। কিন্তু আমাদের নিজস্ব অবস্থান আছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আছে, সংবিধান আছে, জাতির জনক আছেন আমাদের সামনে। সেই বিবেচনা করেই চলি। আর ভুল করবেন না।’
ইনুতে ক্ষুব্ধ জাপা
এদিকে মঙ্গলবার (১৪ জুন) জাতীয় সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে ফ্লোর নিয়ে জাতীয় পার্টির নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ জাতীয় সংসদে জাসদ ও এর সভাপতি তথ্যমন্ত্রী ইনুর সমালোচনা করেন।
জাসদের গণবাহিনীর কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরে বিরোধী দলের এই সংসদ সদস্যও পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্র তৈরির জন্য জাসদকে দায়ী করেছেন।
ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীতো নীলকণ্ঠ। বিষ খেয়ে হজম করতে পারেন। উনি সমস্ত বিষ খেয়ে হজম করে… জাসদ আজ সংসদে আছে। আমার মনে হয়, ভবিষ্যতে… এখন যারা গুপ্তহত্যা করছে তাদেরকেও উনি সংসদে নিয়ে আসবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ছাত্রলীগ করতাম। একসাথে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, এক বিছানা থেকে উঠে এসে উনি আমাদের উদ্দেশ্যে অস্ত্র ধরেছেন। গুণে গুণে আমাদের ২০ লক্ষ লোককে হত্যা করল। সেদিন যদি গণবাহিনী গঠন করে বেছে বেছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের এভাবে হত্যা না করত, তাহলে দেশে দুর্দিন হতো না। বঙ্গবন্ধুর মতো এতবড় জাতীয় নেতাকে আমরা হারাতাম না। সেজন্য জাতি আজ পর্যন্ত ভুগছে।’
সৈয়দ আশরাফের ওই বক্তব্যের প্রসঙ্গে টেনে ফিরোজ রশীদ সংসদে বলেন, ‘আমাদের মাননীয় মন্ত্রী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ যথার্থ বলেছেন। এই ইনু সাহেবরা জাসদ করে… সংসদে ঢুকে এসব করছে।’
শেখ সেলিম-হানিফের মন্তব্য
এর আগে গত বছর ২৩ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধীরা কখনও বঙ্গবন্ধুর ওপর আঘাত হানতে পারত না, যদি না এই গণবাহিনী, জাসদ বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করে বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতি করে, মানুষ হত্যা করে, এমপি মেরে পরিবেশ সৃষ্টি না করত। সুতরাং বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল রহস্য বের করতে হবে, কারা কারা জড়িত ছিল।’
এছাড়া আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্র তৈরির জন্য জাসদকে দায়ী করে গত বছর বক্তব্য দেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে এমপি হওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মন্ত্রী জাসদ সভাপতি ইনু।
স্বাধীনতার আগে থেকেই আওয়ামী লীগের মধ্যে থাকা সমাজতন্ত্রপন্থী নেতাদের নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর আত্মপ্রকাশ করে জাসদ। প্রতিষ্ঠার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনের আমলে শক্ত প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিল জাসদ। ৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য জাসদ ও গণবাহিনী দায়ী এমন অভিযোগ আছে।
জাসদের পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হয়ে থাকে - যখন সংসদীয় রাজনীতির সুযোগ অনুপস্থিত হয়, তখন প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েই ১৯৭৫ সালে জাসদ গণবাহিনী গঠন করে এবং সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক অবস্থান নেয়। কখনো গোপনে ষড়যন্ত্র করেনি।