শনিবার, ৩০ জুলাই ২০১৬
প্রথম পাতা » ব্রেকিং নিউজ | রাজনীতি » বিনোদন কেন্দ্রে রুপান্তর হবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার
বিনোদন কেন্দ্রে রুপান্তর হবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার
পক্ষকাল ডেস্কঃ চারশ’ বছরের প্রাচীন শহর ঢাকা। ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এই মহানগরী। ঐতিহাসিক এই শহরের বুকে ঠাঁই হয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার। পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের তেমনি এক স্থাপনা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। এটি শুধু কারাগার নয়, এর সঙ্গে জড়িত বাংলাভাষা ও স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস।
এখানে বন্দি থেকেছেন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ দেশের অনেক শ্রেষ্ঠ সন্তান। সর্বশেষ একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের দণ্ড কার্যকর করে বাংলাদেশের মানুষকে দায়মুক্তিও দিয়েছে এই কারাগার। জাতীয় প্রয়োজনে ২শ’ বছর পর এটি স্থানান্তর করা হলো কেরানীগঞ্জে। আর রাষ্ট্র এ কারাগারকে মূল্যায়ন করছে মহাকাব্য হিসাবে। স্থাপনাটিকে আরও গৌরবান্বিত করতে ইতিমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ইতিহাস থেকে জানা যায়, পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে ১৭৮৮ সালে তৈরি হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। প্রথমে এটি ক্রিমিনাল ওয়ার্ড নামে পরিচিত ছিল। তখন এর ধারণ ক্ষমতা ছিল ৫শ’। নানা কারণে কেন্দ্রীয় কারাগার আজ ইতিহাসের অংশ।
১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকের ঠাঁই হয় এ কারাগারে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন ছাড়াও রাজনৈতিক, সেনা শাসকবিরোধী আন্দোলন, ছয় দফা, আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় অনেককেই এ কারাগারে রাখা হয়। তবে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অনেক কারারক্ষী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তৎকালীন রাজবন্দিদের তথ্য আদান-প্রদান করে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখেন। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাঙালি কারারক্ষী ও কর্মকর্তারা যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধ শুরু হলে, কয়েদীখানা খুলে দেয় কারারক্ষীরা। এ কারণে পাকিস্তানিরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ সব কারাগারে হামলা চালিয়ে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। কুড়িগ্রামের চার কারারক্ষীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের কারারক্ষীদের হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর খুলে দেওয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার।
স্বাধীনতার পর দেশের কারাগুলোর সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারও সংস্কার করা হয়। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করায় কারাগারের উন্নয়ন থমকে যায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাত্র ৮০ দিনের মাথায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালানো হয় এ কারাগারে। সে সময় অস্ত্রধারী বিপদগামী সেনাদের প্রতিহত করেন তৎকালীন ডিআইজি প্রিজন গাজী আব্দুল আউয়ালসহ সাধারণ কারারক্ষীরা। কিন্তু তারপরও তাদের বাঁচাতে পারেননি। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে ডিআইজি প্রিজন বাদী হয়ে একটি হত্যামামলা দায়ের করেন। যার সূত্র ধরে অনেকের সাজা কার্যকর হয়েছে এই কারাগারে।
এই কারাগার তার বুকে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি ও মাদক ব্যবসায়ীসহ সকল অপরাধীকে আশ্রয় দিয়ে ঢাকাকে রেখেছে নিরাপদ। তাই ঢাকাবাসী এই কারাগারের প্রতি ঋণী।
১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধীদের বিচার শেষে দণ্ড কার্যকর হয়েছে এই কারাগারে। ২০১৩ সালে প্রথম ফাঁসি হয় জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার, ২০১৪ সালে কামারুজ্জামানের, ২০১৫ সালে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ও বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর এবং ২০১৬ সালে অপর জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ২২৮ বছরের ইতিহাসের অনেক ঘটনার সাক্ষী এই কারাগার।
কারা সূত্রে জানা যায়, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনামলে অপরাধীদের রাখার জন্য তৎকালীন পূর্ব বাংলায় কোনও কারাগার ছিল না। ঢাকায় ছোট্ট একটি ওয়ার্ডে রাখা হতো বন্দিদের। যা ১৯০২ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ কারাগার হিসাবে রূপ পায়। আড়াই হাজার ধারণ ক্ষমতা থাকলেও সর্বশেষ এখানে থেকেছে আট হাজার বন্দি। ঢাকা শহরের দ্রুত অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে এই কারাগারের পাশেই গড়ে উঠে সব উচুতলা ভবন। এতে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। তাই সময়ের প্রয়োজনে এই কারাগারকে মানুষকে বন্দি রাখার দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বর্তমান ঠিকানা দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরে। শুক্রবার ভোর থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারের সাড়ে ছয়হাজার বন্দিকে স্থানান্তর করা হয়। তবে নাজিমউদ্দিন রোডের ঐতিহাসিক কারাগার গুড়িয়ে দেওয়া হবে না।
কারা মহাপরিদর্শক ব্রি. জে. সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন জানান, এখানে দু’টি জাদুঘর রয়েছে। এর একটি ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর,’ অপরটি ‘জাতীয় চার নেতার জাদুঘর’। এছাড়া, কারাগারের ভেতরের হাসপাতাল ভবনসহ আরও দু’একটি স্থাপনা থাকবে আদি রূপে। বাকি জায়গায় গড়ে উঠবে খোলা পার্ক, কৃত্রিম লেক, সুইমিং পুল, বহুতল গাড়ি পার্কিং, সিনেমা হলসহ মাল্টিকমপ্লেক্স। দেশের শ্রেষ্ঠ স্থপতিদের নকশায় এগুলো গড়ে তোলা হবে।