‘মাস্টারমাইন্ড’ জিয়া ও তামিম, ধরিয়ে দিলে পুরস্কার
পক্ষকাল ডেস্কঃ ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টার পরিকল্পনাকারী বরখাস্ত মেজর সৈয়দ মো. জিয়াউল হক এবং বাংলাদেশে আইএস এর কথিত সমন্বয়ক কানাডীয় পাসপোর্টধারী বাংলাদেশি নাগরিক তামিম চৌধুরীকে সাম্প্রতিক জঙ্গি কর্মকাণ্ড ও হামলার হোতা হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করেছে পুলিশ।
পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক মঙ্গলবার পুলিশ সদর দপ্তরে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, “তদন্ত করতে গিয়ে আমরা যা পেয়েছি, এখানে মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী। নিউ জেএমবির নেতৃত্ব সে দিচ্ছে। এই তামিম চৌধুরীর পর যারা দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রধান তাদেরকেও আমরা চিহ্নিত করেছি। তাদেরকে আমরা গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি।”
“আরেকটা গ্রুপ আছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। সেখানে তদন্তে আমাদের ধারণা হয়েছে, তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া।”
পুলিশ তামিম ও জিয়াকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে জানিয়ে এ কাজে জনগণের সহযোগিতা চান পুলিশ প্রধান।
তিনি বলেন, “যদি দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার জন্য কেউ সহায়তা করেন কিংবা গ্রেপ্তার করে জানান, তাহলে প্রত্যেকের জন্য আমরা ২০ লাখ টাকা করে দেব। সংবাদদাতা ও তথ্যদাতার পরিচয় গোপন থাকবে।
ওই দুইজন এবং তাদের পরবর্তী নেতৃত্বকে গ্রেপ্তার করা গেলে দেশে ‘জঙ্গি তৎপরতা একেবারে কমিয়ে আনা’ যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক
২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি সেনাবাহিনী এক সংবাদ সম্মেলনে সরকার উৎখাতে ধর্মান্ধ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার একটি অভ্যুত্থান পরিকল্পনা নস্যাৎ করার খবর দেয়। তখনই প্রবাসী ব্যবসায়ী ইশরাক আহমেদ ও মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হকের নাম আসে, যারা ওই অভ্যুত্থান চেষ্টার মূল পরিকল্পনাকারী বলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়।
গত দুই বছরে বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, লেখক-প্রকাশক, বিদেশি নাগরিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু হত্যার প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি আবারও জিয়ার নাম আলোচনায় আসে।
আইএস ও আল কায়েদার পক্ষ থেকে এসব ঘটনার দায় স্বীকার করা হলেও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নাম বদলে আনসার আল-ইসলাম বাংলাদেশ হিসেবে এবং আরেক নিষিদ্ধ দল জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। আর সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া হয়তো আনসার আল ইসলামের সঙ্গে আছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলামকে উদ্ধৃত করে গত জুনে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, “আমাদের সন্দেহ, সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা তাদের একজন নেতা। তিনি আত্মগোপন করে আছেন, কিন্তু আমরা তার সক্ষমতা জানি। তিনি যদি এর মধ্যে জড়িয়ে থাকেন, তাহলে তা আনসার আল ইসলামের জন্য একটি বড় শক্তির জায়গা হবে।”
তামিম আহমেদ চৌধুরী
গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলায় ঘরছাড়া তরুণ-যুবকদের জড়িত থাকার তথ্য প্রকাশের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিখোঁজ ১০ জনের যে প্রথম তালিকা দিয়েছিল, তাতে সিলেটের তামিম আহমেদ চৌধুরীর নাম আসে।
তামিম জেএমবির নেতা বলে গোয়েন্দাদের দাবি। তবে আইএসের বিভিন্ন প্রকাশনার উপর ভিত্তি করে তাকে সংগঠনটির বাংলাদেশ শাখার সমন্বয়ক বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের খবরে।
বলা হচ্ছে, কানাডার উইন্ডসরের বাসিন্দা ৩০ বছর বয়সী তামিম ২০১৩ সাল থেকে নিখোঁজ। তিনি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার দুবাগ ইউনিয়নের বড়গ্রামের প্রয়াত আব্দুল মজিদ চৌধুরীর নাতি।
মজিদ চৌধুরী একাত্তরে শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন বলে স্থানীয়দের তথ্য। তামিমের বাবা শফি আহমদ জাহাজে চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি সপরিবারে কানাডায় পাড়ি জমান।
কোথায় তারা?
তামিম চৌধুরীর অবস্থানের সম্পর্কে এক প্রশ্নে আইজিপি শহীদুল বলেন, “সে দেশে থাকতে পারে, দেশের বাইরেও থাকতে পারে। আমরা তাদের খুঁজছি। গুলশান ঘটনার আগে দেশেই ছিল।”
তিনি বলেন, তামিমের সঙ্গে জেএমবির ‘নতুন ধারার’ একটি গ্রুপ রয়েছে এবং তাদের পুলিশ ‘মোটামুটি’ চিহ্নিত করতে পেরেছে। তামিমকে গ্রেপ্তার করা গেলে ‘তার উপরে’ কে বা কারা আছে- তা জানা সম্ভব হবে।
তামিমকে গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা চালিয়ে ২২ জনকে হত্যার পেছনের মূল ব্যক্তি বলে মনে করছে পুলিশ। ২৬ জুলাই কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানের নয়জন নিহতের পর যে মামলা হয়েছে তাতেও তামিমকে আসামি করা হয়েছে।
গুলশানের ঘটনায় তামিম চৌধুরীর সম্পৃক্ততার তথ্য তুলে ধরে আইজিপি ব্রিফিংয়ে বলেন, “তামিম তাদের রিক্রুট করেছে, ঘটনার আগে তাদের ব্রিফিং দিয়েছে, তাদেরকে পাঠিয়েছে এবং ঘটনার সময় তাদেরকে এগিয়ে দিয়েছে, আমরা সে তথ্য পেয়েছি।”
তিন ঘটনায় ‘একই দল’
শহীদুল হক বলেন, গুলশান, শোলাকিয়া এবং কল্যাণপুরের ঘটনায় যারা ধরা পড়েছে, তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই ‘মাস্টার মাইন্ড’ চিহ্নিত করা হয়েছে।
“তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যে এ কথা স্পষ্ট যে এই জঙ্গিরাই এ ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে, তিনটি ঘটনা একই গ্রুপের।”
আইজিপি বলেন, গুলশান ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ে নতুন অনেক তথ্য পেয়েছে। তারপর শোলাকিয়ার ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তার ভিত্তিতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতা চালাচ্ছিল। সেখান থেকেই ঢাকায় আরেকটি জঙ্গি হামলার প্রস্তুতির কথা পুলিশ জানতে পারে এবং কল্যাণপুরে অভিযান চালায়।
২৬ জুলাই রাতে কল্যাণপুরের ওই জঙ্গি আস্তানায় সোয়াটের বিশেষ অভিযানের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা তাদের সুযোগ দিয়েছি, তারা যদি সারেন্ডার করে তাহলে তাদের কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু তারা তো সারেন্ডার করেই নাই, তারা পুলিশ হত্যা করতে যুদ্ধ করবে এমন কথা বলেছে।”
এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে আইজিপি বলেন, হিযবুত তাহরীরের কর্মীরা সরাসরি নাশকতায় সম্পৃক্ত- এমন প্রমাণ তারা তদন্তে পাননি।
“তারা সরাসরি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের মধ্যে আমরা পাইনি। যারা ছিল তাদের মধ্যে অনেকে আগে জামায়াত-শিবির করেছে।”
হলি আটিজান বেকারিতে কমান্ডো অভিযান শুরুর আগের এক ভিডিওতে ক্যাফে থেকে হাসনাত রেজা করিমকে সপরিবারে বেরিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে।
হলি আটিজান বেকারিতে কমান্ডো অভিযান শুরুর আগের এক ভিডিওতে ক্যাফে থেকে হাসনাত রেজা করিমকে সপরিবারে বেরিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে।
‘সন্দেহমুক্ত নন’
গুলশানের ঘটনায় উদ্ধার পাওয়া নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিম ‘সন্দেহমুক্ত নন’ বলেও এক প্রশ্নের জবাবে জানান পুলিশ প্রধান।
তিনি বলেন, “ওই ঘটনার পূর্বে তার যে রেকর্ড এবং ওই ঘটনার দিন তার যে আচরণ- সবগুলো সন্দেহের মধ্যে আছে, সে সন্দেহমুক্ত নয়। তার বিরুদ্ধে কংক্রিট এভিডেন্স আমরা সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি। সে আমাদের নলেজে আছে। যখনই আমাদের মনে হবে তাকে কাস্টডিতে নেওয়া দরকার তখন আমরা নিতে পারব।”
গুলশানে জঙ্গি হামলার পর জিম্মি দশা থেকে জীবিত ফিরে আসা ৩২ জনের মধ্যে হাসনাতসহ দুজন এখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে রয়েছেন, বাকি সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
আইজিপি বলেন, “যারা জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। ধর্মীয়ভাবে বিভ্রান্ত হয়ে…. তাদের ভাষায় হিযরত করে বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে গেছে, তাদের যদি শুভবুদ্ধির উদয় হয়, স্বাভাবিক জীবন ও পরিবারে আসতে চায়, তাহলে তাদের পরিবারকে সহায়তা দেওয়া হবে। তাদের ভয়ের কোনো কারণ নাই।”
আর বিভিন্ন ঘটনায় যাদের নাম এসেছে, তারা ফিরতে চাইলে তাদেরও দেশের প্রচলিত আইনে সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।