শুক্রবার, ১৯ আগস্ট ২০১৬
প্রথম পাতা » ই-পেপার | বিশ্ব সংবাদ | ব্রেকিং নিউজ » টোকিওর বাংলাদেশ দূতাবাসে পরিচয়হীন এক দাতার দান
টোকিওর বাংলাদেশ দূতাবাসে পরিচয়হীন এক দাতার দান
কাজী ইনসানুল হক, টোকিও (জাপান) থেকে
টোকিওর বাংলাদেশ দূতাবাস
টোকিওর মর্যাদাবান কিওই চো এলাকায় সদ্যনির্মিত বাংলাদেশের নিজস্ব দূতাবাস ভবনে কয়েক দিন আগে একদিন কর্মদিবস শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমার টেবিলে পোস্ট বক্সে আসা সেদিনের চিঠিপত্র। দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা একটি একটি করে খাম খুলছেন। চিঠির বিষয় পড়ছেন ও রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ নিচ্ছেন। একটি ভারী খামের ব্যাপারে সবার কৌতূহল। সেই খামে প্রাপক-প্রেরক কিছুই লেখা নেই। কিছুটা ভয় আর দ্বিধা নিয়ে (বিস্ফোরক জাতীয় কিছু নেই সেটা নিশ্চিত হয়ে) বন্ধ খাম খোলা হলো। বিস্ময়ে হতবাক সবাই। খামের ভেতরে একটা ছোট্ট চিরকুট, সেই সঙ্গে এক মিলিয়ন ইয়েন। চিরকুটের লেখা তরজমা করলে দাঁড়ায়-‘গুলশান ট্র্যাজেডিতে নিহত সাতজন ও আহত একজন জাপানির জন্য আমরা শোকাহত। কিন্তু আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদ ঠেকাতে বিদেশি ছাড়াও তোমাদেরও কেউ কেউ নিহত ও আহত হয়েছে। তাদের জন্য এটি আমাদের সামান্য টোকেন সহযোগিতা, গ্রহণ করলে খুশি হব।*
জুলাইয়ের প্রথম দিনে ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে ধর্মান্ধ উগ্রবাদীদের হামলায় নিহত সাতজন জাপানির সকলের ‘সোসিকি’ (সৎকার) অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা। তিনি স্বীকার করলেন, ওই অনুষ্ঠানগুলোতে যেতে তিনি কিছুটা ভয়ই পেয়েছিলেন। কারণ একেবারে আত্মীয়স্বজন পরিবেষ্টিত পারিবারিক অনুষ্ঠান ও তাদের বাংলাদেশে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ভায়োলেন্ট কিছু ঘটতেও পারে। মাথা নত তো হয়েছে আরও বেশি নত করে সৎকার অনুষ্ঠানে যাওয়ার পর তিনি উল্টো আচরণ পেলেন। পরম আতিথেয়তায় তাঁকে তারা বরণ করে নিলেন। তাঁকে শবদেহে ফুল দিতে দেওয়া হলো প্রথম সারিতে নিহতদের পরিজনদের সঙ্গে বসিয়ে। সৎকারের আনুষ্ঠানিকতায় পরিবারের সবার মতো তিনিও মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তি কামনা করলেন।
একই রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল আমরা যারা জাপানপ্রবাসী তাদেরও। গুলশানের নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর আমরা সন্দিহান ছিলাম প্রতিবেশী বা সহকর্মীরা বিষয়টা কীভাবে নেন। প্রবাসীদের সন্তানেরা স্কুলে সহপাঠীদের কাছে কী রকম পরিস্থিতির মোকাবিলা করবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল তারা বরং আমাদের জন্যই চিন্তিত। আমরা বা আমাদের পরিবার ঠিক আছে কিনা সেটাই জিজ্ঞেস করছেন। কেউ কেউ অবশ্য সমালোচনা করেছেন। কিন্তু আমাদের নয়। তারা তাদের সরকারের সমালোচনা বলেছেন, বহির্বিশ্বে নিরাপত্তাব্যবস্থা সন্তোষজনক কিনা তা যাচাই না করে জাপানিদের পাঠানোর ব্যাপারে সতর্কতা নেওয়া উচিত ছিল। আবার কেউ বলেছেন, অর্থ ও প্রযুক্তি দিয়ে সহযোগিতা করব আবার জীবনও দেব এটা মেনে নেওয়া যায় না। ভবিষ্যতে ঝুঁকিপূর্ণ দেশসমূহে কর্মী বা এক্সপার্ট পাঠানোর ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত ইত্যাদি।
গুলশানে জঙ্গি হামলায় নিহত জাপানিদের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন রাবাব ফাতিমা
প্রবাসী বাংলাদেশিরা নিহত জাপানিদের স্মরণে বেশ কিছু শোকসভা করেছেন। পূর্ব নির্ধারিত ইদ পুনর্মিলনী ও আনন্দ অনুষ্ঠানগুলো পরিহার করে সেই ভেন্যুতেই শোকসভা করার সংবাদ জাপানিরা ভালো ভাবেই নিয়েছেন। এনআরবি জাপান আয়োজিত শোকসভায় বিশিষ্ট জাপানিরা এসেছিলেন। বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিন ব্যবসা করছেন এশিয়া ব্রান্ডের প্রেসিডেন্ট ইশিজাকি মিয়াকো। ওই অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি তো কেঁদেই ফেললেন। বললেন, বাংলাদেশের একজন পরিচিত ব্যক্তি তাঁর অফিসে এসে তাঁর কাছে মাফ চেয়েছেন। তাঁর প্রশ্ন, হাতে গোনা কয়েকজন বিপথগামী যুবকের জন্য গোটা বাংলাদেশ কেন দায়ী হবে। আমাদের চিরচেনা বাংলাদেশ তা নয়। বিদেশিদের প্রতি সর্বদা স্বাগতম জানানো দেশটির মানুষজনের আতিথেয়তার কথা আমরা জানি।
একই রকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন এনএইচকে রেডিও বহির্বিশ্ব বিভাগের পরিচালক, বালা বিভাগের প্রধান, একাধিক বাংলা বইয়ের লেখক, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর জাপানি সংস্করণের অনুবাদক ওয়াতানাবে কাজুহিরো, বাংলাদেশের প্রাচীনতম জাপানি এনজিও শাপলা নীড়ের চেয়ারপারসন ইওয়াকি ইওকিও, মারুবেনি করপোরেশনের সাবেক বাংলাদেশ প্রধান ইনাদেমি হিদাকি এবং অভিনেতা ও গায়ক কোদা তাৎসুয়া প্রমুখ।
নিহত সাতজন ও গুরুতর আহত একজন মোট আটজন জাপানি বাংলাদেশে গিয়েছিলেন বাংলাদেশে নির্মিতব্য মেট্রোরেলের কাজে ও বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে অংশীদার হতে। জাইকা প্রধান স্পষ্টই বলেছেন, বাংলাদেশে মেট্রোরেলসহ সব উন্নয়নকাজ অব্যাহত থাকবে। একদিন মেট্রোরেল চালু হবে। অকালে জীবন দেওয়া এই সাতজন ও গুরুতর আহত একজন জাপানির নামে কি আমরা আটটি স্টেশনের নামকরণ করে তাদের প্রতি আমাদের ঋণ দায় কমাতে পারি না?
*তথ্যসূত্র: রাবাব ফাতিমা।