মঙ্গলবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬
প্রথম পাতা » » জার কোটি টাকার ঋণখেলাপি, হাতে ৫০ লাখ টাকার ঘড়ি
জার কোটি টাকার ঋণখেলাপি, হাতে ৫০ লাখ টাকার ঘড়ি
পক্ষকাল সংবাদঃ বিভিন্ন ব্যাংকে তার খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ হাজার কোটি টাকা। দুর্নীতির দায়ে তাকে গ্রেফতার করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদুক)। কিন্তু আটকে রাখা যায়নি। গ্রেফতারের ৩ মাসের মাথায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। যদিও সেই জামিন আপিল বিভাগে বাতিল হয়ে যায়। তবে ব্যক্তিটি কিন্তু ঠিকই বহাল তবিয়তে রয়েছেন। হাত ৫০ লাখ টাকা মূল্যের ঘড়ি পরে ঘুরে বেড়ান। তার স্বজনরা এ নিয়ে গর্বিত। সবাইকে বলে বেড়ান ঘড়িটি ২২ ক্যারেট স্বর্ণ দিয়ে তৈরি। যিনি সেটা পরেন তিনিও এ নিয়ে গর্বিত। কেউ দেখতে চাইলে বেশ উৎসাহ ভরে ঘড়ি পরা হাত বাড়িয়ে দেন। জামিন বাতিল হলেও খুলনায় বর্তমানে দিব্যি রয়েছেন তিনি।
হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি এই ব্যক্তিটির নাম টিপু সুলতান। যিনি স্থানীয়দের কাছে ‘খুলনা দৌলতপুরের জামাই’ বলেও পরিচিত। তার নামের পূর্বে ‘আলহাজ’ উপাধিও রয়েছে। নানা কারণে ব্যাংক পাড়ায় এবং খুলনার পাট রফতানিকারকদের কাছে বহুল আলোচিত-সমালোচিত এই টিপু সুলতান নামক ব্যক্তিটি। তার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির নাম ঢাকা ট্রেডিং হাউস।
টিপু সুলতানের আদি বাড়ি বগুড়া । বর্তমানে তিনি ব্যবসার কারণে খুলনায় বসবাস করেন। জনতা ব্যাংকের ২৭২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাকে চলতি বছর ৩১ মার্চ গ্রেফতার করেছিল। উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে তিন মাস পর বেরও হয়েছিলেন । কিন্তু হাইকোর্টের দেওয়া জামিন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ৫ সদস্যের বেঞ্চ গত ২৮ আগস্ট বাতিল করে দেন। এই বেঞ্চে ছিলেন প্রধান বিচারপ্রতি এস কে সিনহা ।
জানা যায়, বেশি দামে পাট কিনে কম দামে পাট রফতানি করে খুলনার প্রকৃত পাট রফতানিকারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন টিপু সুলতান। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, পাট রফতানিতে স্বর্ণপদক পাবার আশায় বাকিতে পাট কিনে কম দামে রফতানি করেছেন তিনি ।
এখানেই শেষ নয়। একদিকে পাট ব্যবসায়ীদের টাকা বাকি, অন্যদিকে গুদাম ভর্তি পাট, সেই পাট দেখিয়ে রূপালী ব্যাংকের দৌলতপুর কর্পোরেট শাখা থেকে প্লেজ ঋণগ্রহণ করা তার স্বভাবে পরিণত হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
ঢাকা ট্রেডিং হাউস যখন যাত্রা শুরু করেছিল তখন টিপু সুলতানের ব্যবসায় কয়েকজন পার্টনার ছিলেন। কিন্তু তার এই টাকা আত্মসাতের মনোভাব দেখে তারা সরে পড়েন।
ঢাকা ট্রেডিং হাউসের একসময় নাম ছিল রেলি ব্রাদার্স । বর্তমান সরকারের চলতি আমলের প্রথম দিকে পাট মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে রেলি ব্রাদার্স ২২ কোটি টাকায় ক্রয় করে নেয় ঢাকা ট্রেডিং হাউস। এরপর সেই রেলি ব্রার্দাস রূপালী ব্যাংকের দৌলতপুর শাখায় মর্টগেজ রেখে ঋণ তোলা হয় ৫২ কোটি টাকা । এরপর অবকাঠামো নির্মাণের কথা বলে এবং গুদামের পাট দেখিয়ে প্লেজ ঋণ মিলে এই ব্যাংক থেকে মোট ১১০ কোটি টাকা ঋণ নেন টিপু সুলতান ।
সরকারি মূল্য ২২ কোটি থাকার পরও সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক কি করে এত বিপুল অঙ্কের টাকা ঋণ প্রদান করল এই প্রশ্ন তুলেছেন সচেতন ব্যক্তিরা। রূপালী ব্যাংকের তৎকালীন এজিএম গোলাম মোরশেদের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সহাস্যে জবাব দিয়েছিলেন-‘বোঝেন তো সরকারী মূল্য আর প্রকৃত মূল্যর মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য থাকে।’
তিনি জানান, ব্যাংকের কাছে ঢাকা ট্রেডিং হাউসের মূল্য দেখানো হয়েছে ১১০ কোটি টাকা । তাই তাদের ৫২ কোটি টাকা ঋণ দিতে অসুবিধা হয়নি। ঢাকা ট্রেডিং হাউসের হিসাব রক্ষণ বিভাগে কর্মরত সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ব্যাংকে হিসাবে সব ছিল শুভঙ্করের ফাঁকি’।
অভিযোগ রয়েছে, জনতা ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক ছাড়াও আরব বাংলাদেশ ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপি টিপু সুলতান ।
বিগত বিএনপি সরকারের আমলে হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠতার সুযোগে চিনি আমদানির কথা বলে জনতা ব্যাংক মতিঝিল লোকাল শাখা হতে মোট ৩২১ কোটি টাকার ঋণ গ্রহণ করেছিলেন টিপু সুলতান। কিন্তু চিনি আমদানি না করে সেই টাকা অন্যত্র সরিয়ে ফেলেন তিনি। পরে তার এলসির মার্জিনের টাকা বাদ দিয়ে জনতা ব্যাংকই ২৭২ কোটি টাকার ঋণখেলাপির অভিযোগ করে। যা দুদক তদন্ত করে মামলা দায়ের করে। এই মামলায় দুদকের ঢাকার একটি টিম তাকে ৩১ মার্চ খুলনার ঢাকা ট্রেডিং হাউস থেকে গ্রেফতার করে খুলনা জেলা কারাগারে প্রেরণ করে। পরে দুদকের আবেদনের আগেই টিপু সুলতান নিজ ব্যবস্থায় খুলনা থেকে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে স্থানান্তরিত হন।
বিগত বিএনপি সরকার আমলে হাওয়া ভবনের সূত্র ধরে তার উত্থান হলেও টিপু সুলতান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টাও করেন। খুলনাস্থ ঢাকা ট্রেডিং হাউসে বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বড় ফ্রেমে বাঁধানো ছবি টাঙিয়ে রেখেছেন। অফিস এবং তার বাংলোতে যে কেউ প্রবেশ করলে সেই ছবি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজনৈতিক সংহিসতার সময় পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়ে যাওয়া ট্রাক-বাসের মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে চেক গ্রহণের পূর্বে তোলা ছবি সর্বত্র ব্যবহার করেছেন টিপু সুলতান। অভিযোগ রয়েছে, শুধু মাত্র সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নিজের পুরাতন গাড়ি পুড়িয়ে এই চেক গ্রহণের সুযোগ লাভ করেন তিনি।
দুদকের আপত্তির পরও আগস্ট মাসে হাইকোর্টের দেওয়া জামিনে মুক্তি লাভ করেন টিপু সুলতান। জামিনে মুক্তি লাভ করার পর খুলনায় এলে তাকে ঢাকা ট্রেডিং হাউসের পক্ষ থেকে ব্যান্ড পার্টির মাধ্যমে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। যা পাট ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
সর্বদা ক্ষমতাশালীদের কাছে থাকতে অভ্যস্ত আলহাজ্ব টিপু সুলতান আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে লন্ডন প্রবাসী এক শিল্পপতিকে নিয়ে খুলনা সফররত শেখ সালাউদ্দিন জুয়েলের সাথে সাক্ষাত করেন। এই সময় তিনি তার মামলার ব্যাপারে শেখ সালাউদ্দিন জুয়েলের সহানুভূতি কামনা করেন। কিন্তু সালাউদ্দিন জুয়েল আইন নিজস্ব গতিতে চলেবে বলে জানিয়ে দেন। পরে এই আলহাজ্ব টিপু সুলতানকে নিয়ে তাদের বাসায় আসার জন্য শেখ সোহেলও ওই লন্ডন প্রবাসীর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
দুদুকের এই সংক্রান্ত মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, হাইকোর্টের জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করার আগেই টিপু সুলতান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেল থেকে মুক্তি পান। পরে তারা জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করলে ২৮ আগস্ট প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্ব সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্য বেঞ্চ হাইকোর্টের দেওয়া জামিন বাতিল করেন।
আলহাজ্ব টিপু সুলতান বর্তমানে খুলনাস্থ ঢাকা ট্রেডিং হাউসে অবস্থান করছেন। এ ব্যাপারে তার বক্তব্য নেবার জন্য একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তার মুঠো ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায় ।
জানা গেছে, নানাভাবে আলোচিত-সমালোচিত আলহাজ্ব টিপু সুলতান যে হাতঘড়িটি ব্যবহার করেন এর মূল্য ৫০ লাখ টাকা। তার ঘনিষ্ঠজনরা তেমনটাই প্রচার করেন। পরিচিত মহলে গর্ব করে তারা বলেন, ২২ ক্যারেট স্বর্ণ দিয়ে তৈরি ওমেকা ব্র্যান্ডের এই ঘড়ি। যে কেউ ঘড়িটি দেখতে গেলে তিনি আগ্রহের সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দেন ঘড়ির দর্শনার্থীদের দিকে।