রবিবার, ৬ নভেম্বর ২০১৬
প্রথম পাতা » ই-পেপার | ব্রেকিং নিউজ | রাজনীতি | সম্পাদক বলছি » তাহেরের সঙ্গে মীর জাফরের চেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেন জিয়া
তাহেরের সঙ্গে মীর জাফরের চেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেন জিয়া
ড. আনোয়ার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ওয়ান ইলেভেনে সেনা শাসনের কারা নির্যাতিত শিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল (অব.) আবু তাহেরের ছোট ভাই। বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল দিন ৭ নভেম্বরে তিনি এক সরব সাক্ষী। সেদিনের গণবাহিনীর কমান্ডিং চিফ কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বন্দি জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করাসহ যে ঘটনা ঘটে গেছে, তারই বর্ণনা দিয়েছেন পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজে। পূর্বপশ্চিমের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন ড. আনোয়ার হোসেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন উৎপল দাস।
পূর্বপশ্চিম: ৭ নভেম্বর কেন এসেছিল বলে মনে করেন?
আনোয়ার হোসেন: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর খোন্দকার মোশতাক আহমদের যে সরকার ক্ষমতা নেয়, তার কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল না। সেনাবাহিনীর ছোট একটা অংশ ছাড়া মোশতাকের প্রতি অধিকাংশ সেনা কর্মকর্তারই সমর্থন ছিল না। সাধারণ জনসমর্থন তো ছিলই না। পরিবর্তন বলতে যা হয়েছে তা হলো, আগে ইন্দো-সোভিয়েত শক্তির আধিপত্য মেনে দেশ চলত; শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর সেখানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো। মোশতাক সরকারের দুর্বলতা ও ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ একটি নতুন চক্রান্তে নেতৃত্ব দেন। তিনি ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থানের (কাউন্টার-রেভল্যুশনারি ক্যু) মাধ্যমে ক্ষমতা নিয়ে নেন। আর সে কারণেই জাতির জীবনে ৭ নভেম্বর নেমে এসেছিল। তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান গৃহবন্দি দশা থেকে মুক্ত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিল।
পূর্বপশ্চিম: ঘটনার দিন জেনারেল জিয়াউর রহমান টেলিফোনে কথা বলেছিলেন কর্নেল তাহেরের সঙ্গে। এ বিষয়ে আপনার ভাই কি কিছু জানিয়েছিলেন?
আনোয়ার হোসেন: ঘটনার দিন তাহের ভাই নারায়ণগঞ্জে আমাদের বাড়িতে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন। ভোর চারটার দিকে ভাইয়াকে ফোন করেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি সাহায্য চাইছিলেন। আলাপ শেষ হওয়ার আগেই লাইনটা কেটে গেল। ওই দিন বহু সেনাসদস্য, এনসিও এবং জেসিও আমাদের নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে এলেন। তাঁরা বলছিলেন, ভারত খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে মদদ জুগিয়েছে এবং সেই বাকশালের সমর্থকেরা আবার ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে।
পূর্বপশ্চিম: সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কর্নেল তাহের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন। এসময় তাদের কী বলেছিলেন কর্নেল তাহের?
আনোয়ার হোসেন: বিকালে সেনাবাহিনীর কয়েকজন আমাদের বাসায় আসেন এবং তারা তাহের ভাইকে বললেন, বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং মূল সেনাবাহিনীর মধ্যে তুমুল উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। যেকোনো সময় গোলাগুলি শুরু হয়ে যেতে পারে।
তাহের ভাই তথন দ্রুত সেনাসদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের শান্ত থাকতে বললেন। একইসঙ্গে চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের খোঁজখবর রাখার এবং নিজেদের মধ্যে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সবাইকে দেশের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখার জন্য তৈরি থাকতে বলেছিলেন তিনি।
তিনি আরো বলেছিলেন, কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষী কর্মকর্তা শুধু ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সাধারণ সৈনিকদের ব্যবহার করতে চাইছে। সাধারণ সৈনিকদের ব্যারাকে ফিরে যেতে অনুরোধ করলেন। যে যতই উসকানিমূলক কথা বলুক, তা কানে নিয়ে নিজেদের মধ্যে তারা যেন গোলাগুলি না করে- সেই অনুরোধ জানিয়েছিলেন। পাশাপাশি জনগণের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে যেকোনো সময় ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি থাকতেও তাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন।
পূর্বপশ্চিম: জাসদের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যদের জন্য ১২ দফা দাবি পেশ করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান সেসব দাবির বিষয়ে কী ধরনের মত পোষণ করেছিলেন?
আনোয়ার হোসেন: জাসদের পক্ষ থেকে সৈন্যদের সঙ্গে ব্যাপক যোগাযোগ, আলোচনা ও মতবিনিময়ের পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়। ৬ নভেম্বর তাহের ভাই সৈনিকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন। ঢাকা সেনানিবাসের সব ইউনিট প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সবাইকে সজাগ থাকতে এবং পরবর্তী নির্দেশের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলে দেওয়া হলো। ৬ নভেম্বর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। ৭ নভেম্বর ভোররাত একটায় সিপাহী অভ্যুত্থান শুরু হবে বলে ঠিক হয়। তখনই ১২টি দাবি পেশ করা হয়। দাবিগুলোর মধ্যে প্রধান প্রধান দাবি ছিল- ১. খালেদ মোশাররফ চক্রকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা, ২. বন্দিদশা থেকে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা, ৩. একটা বিপ্লবী সামরিক কমান্ড কাউন্সিল গঠন করা, ৪. দল-মতনির্বিশেষে সব রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি দান, ৫. রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার, ৬. বাকশালকে বাদ দিয়ে একটা সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন করা, ৭. বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবি মেনে নেওয়া ও তার বাস্তবায়ন করা।
কিন্তু মুক্ত হওয়ার ২ দিন পরই এসবের কথা বেমালুম ভুলে যান জিয়াউর রহমান। বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে আমার দুই ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। পরে ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নেন জিয়া।
পূর্বপশ্চিম: জেনারেল জিয়ার সঙ্গে কর্নেল তাহেরের মূল বিরোধের কারণ কী ছিল বলে মনে করেন?
আনোয়ার হোসেন: জাসদের নেতৃত্বেই সেদিন জিয়া গৃহবন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত হয়েছিল। এর আগে ও পরে তিনি কথা দিয়েছিলেন- বাকশালকে বাদ দিয়ে একটা সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। দাবি অনুযায়ী তিনি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। এই কারণেই কর্নেল তাহেরের সঙ্গে মতবিরোধ দেথা দেয় জিয়ার। একসময় তাহের ভাইকে পথের কাঁটা ভাবতে শুরু করেন এবং ষড়যন্ত্র করে গোপন আদালতের মাধ্যমে প্রহসনের বিচারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সেনাকে।
পূর্বপশ্চিম: জিয়াউর রহমান যে কথা দিয়েছিলেন তা রাখেননি। এমনকি কর্নেল আবু তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন– জিয়ার রহমান কেন এমন করলেন বলে আপনার মনে হয়?
আনোয়ার হোসেন: মীরজাফর যেমন বিশ্বাসঘাতকতা করে ২০০ বছরের গোলামীর কবলে ঠেলে দিয়েছিল, ঠিক তেমনি জিয়াউর রহমানও বিশ্বাসঘাতকতা করেই ক্ষমতায় আসীন হয়েছিল। মীরজাফরের চেয়ে বড় কোনো বিশ্বাসঘাতক থাকলে সেটা তিনি- আর কেউ নন, জিয়াউর রহমনাই সেই বিশ্বাসঘাতক। ২৪ নভেম্বর পুলিশকে দিয়ে কর্নেল আবু তাহেরকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার সময় বলা হয়- জিয়াউর রহমান তাহের ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে চান। কিন্তু তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান পাল্টা-অভ্যুত্থান চলতেই থাকে। এরই এক পর্যায়ে সেনানিবাসে আটক জিয়াউর রহমান জাসদ নেতা তাহেরের সহায়তায় মুক্তি পেয়ে ক্ষমতা নেওয়ার পর তাহেরসহ ১৭ জনকে সামরিক আদালতে গোপন বিচারের মুখোমুখি করে। অবশেষে ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই রায়ের পর ২১ জুলাই ভোরে যুদ্ধাহত সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ইতিহাস কখনো জিয়াকে ক্ষমা করবে না।