রোহিঙ্গাদের শরণার্থী জীবন
তসলিমা নাসরিন
মিয়ানমারের রাখাইন বা আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গারা আক্ষরিক অর্থেই দেশহীন মানুষ, কোনও দেশই তাদের আপন দেশ নয়। মিয়ানমারে বংশ পরম্পরায় বাস করেও তারা মিয়েনমারের নাগরিক নয়। তাড়া খেয়ে বাংলাদেশে, ইন্দোনেশিয়ায়, মালয়েশিয়ায়, থাইল্যান্ডে বা ভারতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা সেসব দেশেরও নাগরিক নয়। সব দেশেই তারা শরণার্থী। অনাকাঙ্ক্ষিত শরণার্থী।
বাংলাদেশ থেকে নাফ নদী পেরোলেই মিয়ানমার। টেকনাফ থেকে নৌকো নিলে ওপাড়েই মংডো। আরাকান রাজ্যের উত্তরে এই মংডো অঞ্চলেই বাস রোহিঙ্গাদের। এক সময় বঙ্গের পূর্বাঞ্চল থেকে মানুষেরা মংডোতে গিয়ে বসত শুরু করেছিল। সম্ভবত পনেরো শ’ শতকে। অথবা তারও আগে। মানুষ গিয়েছে ইংরেজ আমলে। গিয়েছে ইংরেজ বার্মিজ যুদ্ধের পর। গিয়েছে একাত্তরে। দুটো অঞ্চল, একটি নদীর এপার ওপার। এপারে মড়ক, ওপারে চলে যাও। ওপারে হানাহানি, এপারে চলে এসো। এভাবেই তো মানুষ বেঁচেছে পৃথিবীর সর্বত্র।
আফ্রিকা থেকে আমাদের পূর্ব পুরুষ চলে এসেছিল অনুকূল আবহাওয়ার দিকে। দল বেঁধে গিয়েছিল যেদিকে খাদ্য সেদিকে, যেদিকে নিরাপত্তা সেদিকে। মানুষের ইতিহাস বলে মানুষ এক প্রান্ত থেকে ভ্রমণ করেছে আরেক প্রান্তে। বাঁচার জন্য।
রোহিঙ্গারাও তেমনি। অথচ তাদের আজ দেশ বলে কিছু নেই। জাতিসংঘ তো রোহিঙ্গাদের নাম দিয়েছে, ‘জগতের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী’ হিসেবে। দেশ থেকেও দেশ নেই-এই অনুভূতিটা আমি বেশ অনুভব করতে পারি। আমিও তো ওদের মতো বাঁচার তাগিদে এক দেশ থেকে আরেক দেশে গিয়েছি, কেবল শরণার্থী হয়েই থেকেছি জীবনভর।
ভারতভাগ হওয়ার সময়ই রোহিঙ্গাদের মধ্যে গড়ে ওঠা কট্টর ইসলামপন্থী মুজাহিদিন দল গোলমাল বাঁধায়। তারা জিন্নার সঙ্গে দেখা করে বলে ‘আমরা পাকিস্তানের অংশ হতে চাই, রাখাইনের পূর্বাঞ্চল পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে জুড়ে দাও’। জুড়ে দেওয়ার অনুরোধ জিন্নাহ রাখেননি!
দেশভাগ হওয়ার পর থেকে মুজাহিদিনরা রাখাইনের পূর্বাঞ্চলকে মিয়ানমার থেকে আলাদা করার সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে যায়। ওরাই এক সময় রাখাইনের পুর্বাঞ্চল শাসন করতে শুরু করে। এ সময় বাংলাদেশ থেকেও মুজাহিদিনদের আমন্ত্রণে প্রচুর মুসলিম রাখাইনে এসে মিয়ানমার সরকারের বিনা অনুমতিতে বসত শুরু করে। প্রতিক্রিয়ায় রাখাইন অঞ্চলের শত শত বৌদ্ধ ভিক্ষু মুজাহিদিনদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে। এরপরই মিয়ানমার সরকার মুজাহিদিনদের শক্তি চুরমার করে দিতে উদ্যোগ নেয়। একদিন মুজাহিদিনদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয় মিয়ানমার আর্মি। নেতাদের অনেকেই মরেছে, কেউ পালিয়েছে। এসব ঘটেছে এক দশকের মধ্যেই।
সেদিনও রোহিঙ্গাদের বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে আর্মি। ১৩০ জনকে হত্যা করেছে, এক লক্ষ রোহিঙ্গাকে উদ্বাস্তু করেছে। ২০১২ সালেও ১০০ রোহিঙ্গাকে মেরে ফেলা হয়েছিল, দেড় লক্ষ রোহিঙ্গাকে উদ্বাস্তু করা হয়েছিল। মনে আছে রোহিঙ্গারা জীবন বাঁচাতে পালাচ্ছিল মিয়ানমার থেকে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল সমুদ্রে নৌকো ভাসিয়ে দিয়ে যেদিকেই যাচ্ছিলো, সেদিকেই পাড় ছিল কিন্তু অনুমতি ছিল না নৌকো ভেড়াবার। মানবতার কী বীভৎস অপমান!
জানি না কী করছেন ‘শান্তির দূত’ আং সান সু চি। মিয়ানমার আর্মিদের বর্বরতার বিরুদ্ধে মোটেও তো মুখ খোলেন না। আসলে গদিতে এতই আরাম যে ওটি ধরে রাখার জন্য শান্তির দূত হয়েও চূড়ান্ত অশান্তি করতে দ্বিধা করেন না। মানবাধিকারের জন্য সারাজীবন লড়াই করেও অন্যের মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে এতটুকু লজ্জিত হন না।
সব রোহিঙ্গা মুজাহিদিন নয়, সব রোহিঙ্গাই জিহাদি নয়। বেশিরভাগ রোহিঙ্গাই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। বেশিরভাগ রোহিঙ্গাই শান্তিতে বাস করতে চায়, জীবনের নিরাপত্তা চায়।
ইমতিয়াজ মাহমুদ খুব ভালো লিখেছেন, –‘আমাদের দেশের একদল লোক রোহিঙ্গা সমস্যাকে মুসলিমদের সাথে বৌদ্ধদের বিবাদ হিসাবে দেখিয়ে উত্তেজনা তৈরি করতে চায়। এতো সরলীকরণ করলে হবে না। সবার আগে যে কথাটা আমাদেরকে মাথায় রাখতে হবে, বার্মার রোহিঙ্গারা সেখানকারই একটা এথনিক গ্রুপ। সংখ্যায় যত কমই হোক, ওদের অধিকার আছে সেই দেশের নাগরিক হিসাবে সেখানেই মর্যাদার সাথে বসবাস করার আর সেই দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার। কেবলমাত্র রোহিঙ্গা বলেই ওদের সাথে রাষ্ট্র বৈষম্য করবে সেটা তো অন্যায়।
আর এই যে আমরা রোহিঙ্গাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার খবর পাই, রোহিঙ্গা হত্যার খবর পাই, সে যে অন্যায় সেটা তো আর নানারকমভাবে ব্যাখ্যা করে বলার দরকার নাই। কিন্তু ওদের সেই দুর্দশা তো আপনি ফটোশপ করে বা বানানো ফটো পোস্ট করে সমাধান করতে পারবেন না। এইসব করে আপনি এখানে দাঙ্গা লাগাতে পারবেন, তাতে রোহিঙ্গাদের বিশেষ কোনও লাভ হওয়ার তো কোনও সম্ভাবনা দেখি না।
ওদের জন্যে যদি কিছু করতে চান, আমাদের সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নানা পর্যায়ে সমস্যাটি তুলে ধরার জন্যে। আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করা বার্মার পুরনো অভ্যাস। কিন্তু বার্মাও তো পাল্টাচ্ছে। আঞ্চলিক আর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা ছাড়া আপনি বার্মার বিরুদ্ধে আর কি করতে পারেন?
আর প্রতিবাদ সে তো করতেই হবে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা তো আমাদের সকলেরই দায়িত্ব। প্রতিবাদও করতে হবে যেন বার্মার শাসকরা বুঝতে পারে বিশ্বের মানুষ এই অন্যায় সহ্য করবে না। কিন্তু আমরা যখন রোহিঙ্গাদের এই মানবিক বিপর্যয়ের প্রতিবাদ করবো সেটা যেন ওদের মৌলবাদী সশস্ত্র গ্রুপগুলোর প্রতি নৈতিক সমর্থনে রূপ পরিগ্রহ না করে, সেটাও তো একটু খেয়াল রাখা দরকার। দুনিয়ার যেখানেই এইসব জিহাদীরা সন্ত্রাসের পথে নেমেছে –তার কোনটাই কি শেষ বিচারে মানুষের পক্ষে গেছে?
রোহিঙ্গাদের প্রতি অন্যায় মানুষের প্রতি অন্যায়। মেহেরবানী করে এটাকে আপনাদের ইসলামি আন্দোলনের সাথে মিলিয়ে নিবেন না। তাহলে এই অসহায় জনগোষ্ঠীটি সারা দুনিয়ার মানুষের সহমর্মিতা হারাবে।’
আমারও এই একই কথা। রোহিঙ্গাদের নিয়ে দু’ পক্ষই প্রচারণা চালাচ্ছে। কট্টর মুসলিমরা দেখাচ্ছে মিয়ানমারে মুসলিমদের মেরে কয়লা বানিয়ে ফেলেছে। মুসলিম বিরোধীরা বলছে রোহিঙ্গারা সকলেই জিহাদি, ওদের কোনও ফেভার কোরো না।
কিন্তু মানবাধিকারে বিশ্বাস করলে আমাকে ওই দু’পক্ষের কোনোটিতেই ভিড়লে চলবে না। যদি প্রমাণিত হয় কোনও রোহিঙ্গা জিহাদি কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, তার শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু সে যদি নিরপরাধ হয়, তবে তাকে নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব সহ সব মৌলিক অধিকারই ফিরিয়ে দিতে হবে।
মিয়ানমারে যদি রোহিঙ্গারা নিরাপদ বোধ না করে, তবে যে দেশে তাদের যেতে ইচ্ছে হয়, বাস করতে ইচ্ছে হয়, সে দেশেই যেন তাদের যাওয়ার, এবং বাস করার অধিকার থাকে। জগতের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীকে জীবন বাঁচাতে সাহায্য না ক’রে যেন কোনও দেশ বড়াই না করে যে তারা গণতন্ত্রে বা মানবাধিকারে বিশ্বাস করে।