শনিবার, ২৬ নভেম্বর ২০১৬
প্রথম পাতা » তথ্য-প্রযুক্তি | বিশ্ব সংবাদ » নয়া উদারবাদের আলিঙ্গনেই ট্রাম্পের উত্থান
নয়া উদারবাদের আলিঙ্গনেই ট্রাম্পের উত্থান
পক্ষকাল ডেস্কঃ
সম্বিৎ ফিরতেই তাড়া করে ফিরছে দু’টি প্রশ্ন: কেন, কীভাবে?
রিয়েল এস্টেট মুগল, নিউ ইয়র্কের ধনকুবের ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত। যখন, গত ছ’বছর ধরে জাতীয় আয়ের ৯৭শতাংশই গিয়েছে ধনীশ্রেষ্ঠ ১শতাংশের হাতে- যাদের একজন ট্রাম্প নিজে। এহেন ট্রাম্পকে কেন নির্বাচিত করলেন মার্কিন ভোটাররা? কীভাবেই বা নির্বাচিত করলেন সেই প্রার্থীকে, যাঁর বিরুদ্ধে ক’দিন আগেও তাঁরা দিয়েছিলেন ৬০-৮০শতাংশ ‘নেতিবাচক’ রায়। এই দু’টি প্রশ্ন এখন তাড়িয়ে বেরাচ্ছে গোটা বিশ্বকে।
ভোটের কয়েক ঘণ্টা আগেও রয়টার্স/ইপসসের জনমত সমীক্ষা জানিয়েছিল, হিলারির জয়ের সম্ভাবনা ৯০শতাংশ। নিউ ইয়র্ক টাইমসের রায় ছিল হিলারির জয়ের সম্ভাবনা ৮৫শতাংশ। ভোটের চব্বিশ ঘণ্টা আগে ওয়াশিংটন পোস্টের পূর্বাভাস ছিল ‘সার্বিক মানচিত্র এখনও স্পষ্টই হিলারি ক্লিন্টনের অনুকূলে।’ হাফিংটন পোস্ট তো প্রাক্তন ফার্স্ট লেডির জয়ের সম্ভাবনা দেখেছিল ৯৮.২শতাংশ। লস এঞ্জেলস টাইমস তাঁকে দিয়েছিল ৩৫২টি ইলেকটোরাল কলেজ (পেয়েছেন সাকুল্যে ২২৮)। নেট সিলভারের ওয়েবসাইট জানিয়েছিল প্রাক্তন বিদেশসচিবের জয়ের সম্ভাবনা ৭১শতাংশ।
ওয়াল স্ট্রিটের বৃহৎ ব্যাঙ্ক, বৃহৎ কর্পোরেশন সমর্থন জানিয়েছিল তাঁকে। তাঁর প্রচারাভিযানে খরচ করা হয়েছিল ৫৩কোটি ৪৪লক্ষ ডলার, যেখানে ট্রাম্পের ৩৬কোটি ৭৪লক্ষ ডলার। রিপাবলিকান রাষ্ট্রপতিদের প্রশাসনে কাজ করেছেন এমন ৫৪জন ৫৪জন জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগের প্রাক্তন কর্তা তাঁর উপরই রেখেছিলেন বিশ্বাস। মনে করেছিলেন মার্কিন সামরিক-গোয়েন্দা বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে ট্রাম্প একেবারেই অযোগ্য।
কেউ কখনও ভাবেনি ট্রাম্প জিতবেন। হতবাক তামাম দুনিয়া।
শুরুতে প্রথম ধাক্কায় চ্যানেলে খুঁজে পাওয়া যায়নি দাপুটে পোলস্টারদের। ‘জনমত সমীক্ষাগুলি ভুল ছিল, প্রত্যেকেই ভুল ছিলাম, আমরা সবাই ভুল করেছিলাম।’ অসহায় স্বীকারোক্তি ছিল একজন রাজনৈতিক ভাষ্যকারের, ফল ঘোষণার বিকেলে সি এন এনে।
এখন ওরা দায়ী করছে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য, বর্ণবিদ্বেষকে। দায়ী করছে এফ বি আই, জেমস কমিকে। দায়ী করছে বার্নি স্যান্ডার্স, নারী-বিদ্বেষকে। দায়ী করছে দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্তের বাইরে থাকা বাকি দলগুলিকে, নির্দল প্রার্থীদের। দায়ী করছে কর্পোরেট মিডিয়াকে, তাঁকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসার জন্য। দায়ী করছে সোসাল মিডিয়া, উইকিলিকসকে।
অথচ, কেউ বলছে না দায়ী আসলে নয়া উদারবাদ। কেউ বলছে না, একটি বিষয় স্ফটিক স্বচ্ছ: এটা আসলেই হিলারি, ডেমোক্র্যাটদের ব্যর্থতা, নয়া উদার প্রতিষ্ঠানের বিপর্যয়।
কেউ বলছে না, নয়া উদারনীতির বিনিয়ন্ত্রণ, বেসরকারিকরণ, কঠোর ব্যয়সংকোচ, কর্পোরেট বাণিজ্য মানুষের জীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ। নরক যন্ত্রণায় বহু মানুষ। তাঁরা হারিয়েছেন কাজ, হারিয়েছেন পেনশন। তাঁরা হারিয়েছেন নিরাপত্তার সমস্ত রক্ষাকবচ। তাঁরা নিজেদের শিশুদের জন্য এমন এক ভবিষ্যৎ দেখতে চেয়েছেন, যা অন্তত বর্তমানের মতো ভয়াবহ না। প্রায় ৫কোটি মানুষ, সাড়ে ৩২কোটি জনসংখ্যার ১৫শতাংশ, গরিব। বেকারির হার সরকারি হিসেবেই ৫শতাংশ, আসলে ১০শতাংশের কাছাকাছি। চার দশক ধরে মার্কিন শ্রমজীবী জনগণের মজুরি দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়। কমে চলেছে ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান। আক্রান্ত মধ্যবিত্তরা।
৪০বছর ধরে অবাধ মুক্ত বাজার। ১৯৭৬, জিমি কার্টারের পর থেকে যে ক’জন ডেমোক্র্যাট রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন, প্রত্যেকেই আরও গভীর ও সম্প্রসারিত করেছেন নয়া উদারবাদকে। দুর্বল করেছেন শ্রমিকদের অধিকার, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার। মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধিসভার সঙ্গে এবারে সেনেটও রিপাবলিকানদের দখলে।
মানুষ নয়া উদার নীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, যা আদতেই ছিল আটের দশকে রেগানের ‘রাষ্ট্র কোনও সমাধান নয়, সমস্যার’ যোগ্য সম্প্রসারণ। এই জনাদেশ ওবামা প্রশাসনের বিরুদ্ধে পরোয়ানা। হিলারি যদি হেরে থাকেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে, তবে ওবামা হেরেছেন মার্কিন সেনেটে।
গত আট বছরে দেশকে কীভাবে ‘পরিবর্তন’ করেছেন, ওবামা হোয়াইট হাউসের দাবি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য হয়নি মানুষের কাছে। হওয়ার কথাও নয়। সাতটি যুদ্ধ, প্রতিদিন দ্রোন হামলার জন্য দায়ী তিনি। ছিলেন ওয়াল স্ট্রিটের বন্ধু। অসহ্য স্থিতাবস্থার ধারাবাহিকতা রক্ষার হিলারির আশ্বাস সেকারণে মানুষের মধ্যে কোনও ছাপ ফেলতে পারেনি। তাঁর প্রতিশ্রুতি তুলে ধরতে পারেনি কোনও প্রকৃত বিকল্প। ‘ধনকুবের শ্রেণি’র বিরুদ্ধে শ্রমিকদের চ্যালেঞ্জ জানানোর বার্নি স্যান্ডার্সের ডাকে দৃশ্যতই বিচলিত ছিলেন হিলারি। লড়াই থেকে স্যান্ডার্স সরে যাওয়াতে একেবারে ফাঁকা মাঠ পেয়ে গিয়েছিলেন ট্রাম্প।
এবং সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন। মানুষের যন্ত্রণাকে সরাসরি খুঁচিয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প। ব্রেক্সিটের প্রচারে ছিল এই একই যন্ত্রণার কথা। যেমন বলছেন ইউরোপের উগ্র দক্ষিণপন্থীরা। তাঁরা তুলছেন উগ্র জাতীয়তাবাদের ভাবাবেগ। উসকে দিচ্ছেন দূরের অর্থনৈতিক আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভকে- ওয়াশিংটন, উত্তর আমেরিকার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরুদ্ধে অসন্তোষকে। তাঁদের জবাব, তোমার সংকটের জন্য দায়ী ‘ওরা’: অভিবাসীরা, কৃষ্ণাঙ্গরা, মুসলিমরা।
শ্রমিক-মুখী ছদ্মবেশে ট্রাম্প অকাতরে বিলিয়েছেন ডাহা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। অর্থনৈতিক অসন্তোষকে সদ্ব্যবহারে ‘বলির পাঠা’ করেছেন বর্ণবিদ্বেষকে। উসকে দিয়েছেন শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদকে। ক্ষমতা হারানো, সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় ট্রাম্পের উত্থানে বড় ভূমিকা পালন করেছে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য। বলেছেন মার্কিন ‘বিবেক’ নোয়াম চমস্কি।
ট্রাম্পের বার্তা ছিল স্পষ্ট: ‘পুরোটাই নরক’। হিলারির জবাব ছিল, ‘সব ভালোই চলছে।’ যদিও মোটেই ভালো চলছিল না, বরং পরিস্থিতি ছিল শোচনীয়।
শ্রমিকদের মধ্যে সবচেয়ে হতদরিদ্র অংশ, যাদের পারিবারিক আয় ৩০,০০০ডলারের কম, তাদের ক্ষেত্রে রিপাবলিকানদের পক্ষে ভোটদানের হার গত চার বছরে বেড়েছে ১০শতাংশ। মধ্য-পশ্চিমের প্রদেশগুলিতে এই হার বেড়েছে আরও বেশি। উইসকিনসনে ১৭শতাংশ, লোয়াতে ২০শতাংশ, ইন্ডিয়ানাতে ১৯শতাংশ এবং পেনসিলভানিয়াতে ১৮শতাংশ। যাদের পারিবারিক আয় ৩০,০০০ থেকে ৫০,০০০ডলারের মধ্যে, তাদের ক্ষেত্রে রিপাবলিকানদের প্রতি সমর্থন বেড়েছে ৬শতাংশ। আর ৫০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ডলারের মধ্যে যাদের আয়, তাদের ক্ষেত্রে ৫শতাংশ। অন্যদিকে, চার বছর আগের তুলনায় অনেক বেশি ধনীদের সমর্থন পেয়েছে ডেমোক্র্যাটরা। যাদের আয় ১,০০,০০০ থেকে ২,০০,০০০ডলারের মধ্যে, তাদের ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন বেড়েছে ৯শতাংশ। যাদের আয় ২,৫০,০০০ডলারের উপরে, তাদের ক্ষেত্রে ১১শতাংশ। আর সবচেয়ে ধনীদের ক্ষেত্রে একেবারে ৬০শতাংশ।
ধনীরা যখন ডেমোক্র্যাটদের ভোট দিয়েছে, গরিবরা তখন সরে গিয়েছে। স্বাভাবিক।
সমর্থনের সমীকরণ বদলের নিশ্চিত পূর্বাভাস ছিল জনমত সমীক্ষায়। ভোটারদের ৫২শতাংশই বলেছিলেন, নির্বাচনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো অর্থনৈতিক সংকট। দ্বিতীয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর ১৮শতাংশের চেয়ে অনেক উপরে। ৬৮শতাংশই বলেছিলেন, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা চার বছর আগের তুলনায় হয় একই আছে, না হলে আরও খারাপ হয়েছে। ৩৯শতাংশ বলেছিলেন, তারা এমন একজন প্রার্থীকে চান যিনি ‘আনতে পারেন পরিবর্তন।’
মে মাসে লন্ডন রেডিওতে এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ জেফ ফক্স সম্ভাব্য ট্রাম্পের জয় নিয়ে সতর্ক করেছিলেন, যদিও তিন আশাবাদী ছিলেন হিলারির জয় নিয়ে। ফক্স বলেছিলেন, হিলারির প্রচারে রয়েছে ‘স্থিতাবস্থারই’ নতুন সংস্করণের প্রতিশ্রুতি। অন্যদিকে ট্রাম্প বলছেন, ‘পরিবর্তনের’ কথা।
বর্ণ, বয়েস, লিঙ্গ, শিক্ষা এবং শ্রেণি-নির্বিশেষে মানুষ ভোট দিয়েছেন ট্রাম্পকে। বুথফেরত সমীক্ষায় এমন বহু শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক, যাঁরা ভোট দিয়েছিলেন ওবামাকে, এবারে ভোট দেননি হিলারিকে। প্রাক্তন বিদেশসচিবের প্রতি কাজ করেছে অবিশ্বাস, সন্দেহ। মুখোশ কাজ করেনি। তাঁরা ভোট দিয়েছেন সেই ট্রাম্পকে, যিনি গলাধাক্কা দিয়ে মুসলিমদের বের করে দেওয়ার কথা বলেছেন বারবার, যিনি গলা চড়িয়ে বলেছেন মহিলাদের শ্লীলতাহানির কথা, মেক্সিকানদের ধর্ষক বলতে দু’বার ভাবেননি, যার পক্ষে ছিল নয়া নাৎসিদের সমর্থন।
শ্বেতাঙ্গ মানুষের বয়সের প্রতিটি গোষ্ঠীই ঢেলে ভোট দিয়েছে ট্রাম্পকে। ১৮-২৯, ট্রাম্প পেয়েছেন ৪৮শতাংশের সমর্থন, যেখানে হিলারি ৪৩শতাংশ। ৩০-৪৪, ট্রাম্প ৫৫শতাংশ, হিলারি ৩৭শতাংশ। ৪৫-৬৪, ট্রাম্প ৬৪শতাংশ, হিলারি ৩৪শতাংশ। আর ৬৫বছরের উপরে, ট্রাম্প ৫৮শতাংশ, হিলারি ৩৯শতাংশ।
অন্যদিকে কৃষ্ণাঙ্গদের ৮৮শতাংশ, লাতিনোদের ৬৫শতাংশ এবং এশীয়দের ৬৫শতাংশের সমর্থন পেয়েছেন হিলারি। অর্থ স্পষ্ট: অভিবাসীদের অধিকাংশই ভোট দেননি ট্রাম্পকে, বিপরীতে উজাড় করে দিয়েছেন মার্কিন মুলুকে জন্ম নেওয়া নাগরিকরা।
ট্রাম্পের উগ্র প্রচারাভিযান, সংখ্যালঘু ভোটের তীব্র মেরুকরণ সত্ত্বেও ওবামার তুলনায় কমেছে হিলারির সমর্থন। চার বছর আগে ওবামা পেয়েছিলেন কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটের ৯৩শতাংশ। লাতিনোদের ৭১শতাংশ। শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের ক্ষেত্রে চার বছর আগে ওবামা যেখানে পেয়েছিলেন ৬৫শতাংশের সমর্থন, সেখানে এবারে হিলারি পেয়েছেন ৩১শতাংশ।
ব্রিটেনে, লেবার নেতা জেরেমি করবিনের জন্য এই জনাদেশ ‘রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি প্রশ্নাতীত প্রত্যাখ্যান, যা আসলেই কাজ করছে না অধিকাংশ মানুষের জন্য।’ দক্ষিণপন্থীদের ভাষায়, ‘একটি উন্নততর বিশ্বের জন্ম’, ফ্রান্সের নব্য-ফ্যাসিবাদী ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেত্রী মেরি লা-পেনের টুইট: ‘ওদের দুনিয়ার বিপর্যয় ঘটেছে, আমাদের নির্মাণকাজ চলছে।’ আগামী বছর এপ্রিলে ফ্রান্সে নির্বাচন। এখন থেকেই পেন নিজেকে ডাকছেন ‘ম্যাডাম ফ্রেক্সিট’। বলছেন, ‘আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, কাল ফ্রান্সে।’
ট্রাম্প, হিলারি যদিও কেউই জনপ্রিয় নন। ৪৩শতাংশ মানুষই ভোটদানে বিরত ছিলেন। এবং ভোটদানে বিরত থাকার এই হার গত কুড়ি বছরে সবচেয়ে বেশি। ২৩কোটি ভোটরের মধ্যে ১১কোটি-ই হয় ভোটদানে বিরত ছিলেন, অথবা তৃতীয় কোনও দলকে ভোট দিয়েছেন।
দু’জনের মধ্যে কেউই পাননি ৫০শতাংশ সমর্থন। হিলারি পেয়েছেন বৈধ ভোটের ২৬.৫শতাংশ। ট্রাম্প ২৫.৯শতাংশ।
তেইশ কোটি ভোটারের মধ্যে ট্রাম্প পেয়েছেন মাত্র ৬কোটি ভোট। প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজনই ভোট দেননি ট্রাম্পকে। তবু নির্বাচিত। শিরোধার্য মার্কিন গণতন্ত্র।
দু’জনের মধ্যে কেউই পুঁজিবাদী শোষণ, বর্ণবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ, লিঙ্গবিদ্বেষ এবং যুদ্ধের প্রকৃত সমাধান উপস্থিত করেননি। হিলারির চেয়ে বেশি পপুলার ভোট পাননি ট্রাম্প। এতেই মানুষের মনোভাব কিছুটা আঁচ করা যায়। যদিও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ব্যবস্থা পপুলার ভোট-ভিত্তিক নয়। দ্বিদলীয় রাজনীতিতে তৃতীয় কোনও দলের সম্ভাবনাও নেই। ভুলে গেলে চলবে না শ্রমিকদের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলিকে সামনে এনে বছরের গোড়ায় বার্নি স্যান্ডার্স ঝড় তুললেও, যখন তাঁকে সরে যেতে হয়, তখন সম্ভবত তাঁর সমর্থকদের একটি অংশ দু’জনের কাউকেই ভোট দেননি।
কেবল ব্যক্তি ট্রাম্পই নয়, বিপজ্জনক হলো তাঁর এই জয় প্ররোচিত করবে মহিলা-বিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ, অভিবাসী-বিরোধী বিপদকে। তাঁর মুখ্য সমর্থন এসেছে শ্বেতাঙ্গদের কাছ থেকে। ভোট দেওয়ার সময় বুঝে হোক, আর না বুঝে- একজন শ্রমিক হিসেবে তাঁরা ভোট দেননি।
ব্যাটম্যান থেকে ট্রাম্পের ‘রিয়ালিটি’ শো- মার্কিন কর্পোরেট সংস্কৃতির অলীক কল্পনায় একজন বলিষ্ঠ, ধনী, শ্বেতাঙ্গ পুরুষই সমাধান করে দিতে পারেন সমস্ত সমস্যার। একজন ‘সহৃদয়’ পুঁজিপতিই প্রত্যেকের জন্য করে দিতে পারেন কাজের সুযোগ। ফিল্ম থেকে রেডিও, টেলিভিশন থেকে কমিক বই- অনেকেই কিনেছেন ট্রাম্পের এই রূপকথা। হিলারির প্রতিশ্রুতিতেও ফ্যান্টাসি কম ছিল না, তবে তা কাজে দেয়নি।
আগামী বছরগুলিতে আসছে প্রকৃত ‘রিয়ালিটি’র কড়া ওষুধ। প্রাথমিক টলমলে ভাব কাটিয়ে চাঙ্গা শেয়ার বাজার। যদি সাময়িক। এই সংকট থেকে পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
নয়া উদারবাদকে ডেমোক্র্যাটদের আলিঙ্গন এনে দিয়েছে ট্রাম্পের অভাবনীয় জয়। চমস্কির কথায়, ডেমোক্র্যাটদের শ্রমিকশ্রেণিকে পরিত্যাগের কারণেই ট্রাম্পের এই উত্থান।
ডেমোক্র্যাটদের জন্য এখন তাই নির্ণায়ক মুহূর্ত। নয়া উদারবাদের সওয়ারি হবে, না তাকে পরিত্যাগ করবে। অকুপাই আন্দোলন তাদের দিতে পারে নতুন শক্তি। নয়া উদারবাদের চার দশকের ব্যর্থতার বিকল্প নির্মাণ ডেমোক্র্যাটদের জন্য জরুরি। দেশের শ্রমজীবী জনগণের সঙ্গে ডেমোক্র্যাটদের বিচ্ছিন্নতা নিয়ে ইতিমধ্যেই দলের নেতৃত্বের দিকে আঙুল তুলেছেন বার্নি। বলেছেন এটা গোটা দলের কাছেই অস্বস্তিকর। লক্ষ লক্ষ শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক ট্রাম্পকে ভোট দিলেন। আপনাদের ঠিক করতে হবে কোন দিকে থাকবেন? শ্রমজীবী জনগণ, তরুণ প্রজন্ম না কি ওয়াল স্ট্রিট, বিলিওনেয়ারের সঙ্গে? একই কথা ব্রিটেনে লেবার পার্টির ‘রক্ষণশীল’ নেতাদের বলছেন করবিন।
টমাস পিকেত্তির সতর্কবার্তা, ‘বিশ্বায়ন নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতেই হবে, না হলে রাজ করবে ট্রাম্পবাদ।’
প্রথমে সুখবর, উপকূল থেকে উপকূল- প্রতিবাদে উত্তাল আমেরিকা। ২০১৮’র সেনেট নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন বার্নি। পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিষয়টিও উড়িয়ে দেননি।
দুঃসংবাদ, শ্বেতাঙ্গ জাতীয়বাদের ‘আইকন’ স্টিফেন ব্যানন এখন ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের ‘স্ট্র্যাটেজিক’ গুরু। এবং প্রচারাভিযানের প্রধান। উগ্র দক্ষিণপন্থী মিডিয়া নেটওয়ার্ক ব্রাইটবার্ট নিউজের প্রধান ব্যাননের নিয়োগে সহজাত উচ্ছ্বাস নব্য নাৎসি এবং শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের মধ্যে।
এই স্টিফেন ব্যাননই দু’বছর আগে মোদীর নির্বাচনকে ‘বিশ্বায়িত বিদ্রোহের’ অংশ হিসেবে ‘বিরাট জয়’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। বলেছিলেন, তাকিয়ে দেখুন গোটা দুনিয়াতে চলছে ‘মধ্য-দক্ষিণ’ বিদ্রোহ। ‘আপনি এটা দেখতে চলেছেন লাতিন আমেরিকায়। আপনি এটা দেখতে চলেছেন এশিয়াতে। আপনি ইতিমধ্যেই দেখছেন ভারতে।’ ট্রাম্পও ভুল করেননি মোদীকে চিনতে। নিউ ইয়র্কে ট্রাম্প হাউসে তাঁর ভারতীয় পার্টনার অতুল ও সাগর চোরদিয়া দেখা করলে, মোদী সম্পর্কে প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন ট্রাম্প।
বার্নি স্যান্ডার্স ইতিমধ্যেই ব্যাননকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক সমাজে আমরা সমস্ত বিষয়ে ভিন্নমত হতে পারি, কিন্তু বর্ণবিদ্বেষ, ধর্মান্ধতা কখনও আমাদের সরকারি নীতি হতে পারে না। মার্কিন রাষ্ট্রপতি হোয়াইট হাউসে একজন বর্ণবিদ্বেষীকে রাখতে পারেন না। আমরা কখনও পিছনের দিকে হাঁটতে পারি না।’
প্রতিনিধিসভা, সেনেট, হোয়াইট হাউসে যদি ‘ফ্যাসিবাদীরা’ জিতে থাকেন, তবে ‘প্রগতিশীল’ ওয়াল স্ট্রিটকে নিয়ে পপুলার ফ্রন্ট গঠন অনিবার্য।