বৃহস্পতিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০১৬
প্রথম পাতা » বিনোদন | ব্রেকিং নিউজ | সম্পাদক বলছি » একাত্তরে গণহত্যার প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’
একাত্তরে গণহত্যার প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’
পক্ষকাল ডেস্ক
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় যে গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, তা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে তারা সময় নেয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ শুরু হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী তাদের শিকারে পরিণত করেছে দেশের সাধারণ মানুষকে।
প্রাণ বাঁচাতে মানুষ পালাচ্ছে শহর ছেড়ে গ্রামে, গ্রাম ছেড়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পাশের দেশ ভারতে। এসবের মধ্যে এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখ গঠিত হয়েছে প্রবাসী অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার। কিন্তু বাংলাদেশজুড়ে যে গণহত্যা ঘটে চলেছে, তা তখনো বিশ্ববাসীর অজানা।
বাংলাদেশের অনেক শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীর মতো জহির রায়হানও যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতের কলকাতায়। এর আগে বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনকে মাথায় রেখে এর রূপক হিসেবে জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্র বানিয়ে তিনি নিজের শৈল্পিক ক্ষমতা, রাজনৈতিক সচেতনতা ও মুক্তিকামী রাজনীতির প্রতি তাঁর জোরালো অবস্থানের ছাপ রেখেছেন। শিল্পীরা যে যে যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে কাজ করা শুরু করে দিয়েছেন।
একজন চলচ্চিত্র-নির্মাতা হিসেবে জহির রায়হান দুনিয়ার মানুষকে বাংলাদেশে চলতে থাকা গণহত্যার খবর জানান দেওয়ার এক বড় দায়িত্ব কাঁধে নেন। বিশ্ববাসী ভিয়েতনামের মাই লাই গণহত্যার কথা জানে, কিন্তু বাংলাদেশে যে তখন শত শত মাই লাই ঘটে চলেছে, সেটা তো বিশ্ববাসীকে জানাতে হবে। পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য এটা জরুরি হয়ে পড়েছিল। জহির রায়হানের বানানো স্টপ জেনোসাইড ছবিটি সে কাজই করেছে।
বিশ্বের দেশে দেশে চলমান মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতাই জহির রায়হানের রাজনৈতিক আদর্শ। এ ধরনের প্রচারধর্মী বা প্রামাণ্যচিত্র বানানের অভিজ্ঞতা ছিল না জহির রায়হানের। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর কলকাতায় অবস্থান তাঁর চোখ খোলার সুযোগ করে দিয়েছে। কলকাতায় বসে তিনি দেখেছিলেন বিভিন্ন দেশের বিপ্লব ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন নিয়ে পূর্ব ইউরোপ ও কিউবায় বানানো বেশ কিছু ছবি। জহির রায়হান নেমে পড়েন বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে ছবি বানানোর কাজে। সঙ্গী আরেক চলচ্চিত্র-নির্মাতা আলমগীর কবির।
নির্দিষ্ট করে জানা না গেলেও বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, জহির রায়হান একাত্তরের এপ্রিল-মে মাসের দিকে এই প্রামাণ্যচিত্র তৈরির পরিকল্পনা করেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থের জোগানের সমস্যা তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে নেই ছবি বানানোর সরঞ্জামও। ফলে মূলত বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া স্টক ফুটেজ ও নিউজ রিলের ছবির ওপর নির্ভর করেই তৈরি হয় স্টপ জেনোসাইড। বলা যায়, স্টপ জেনোসাইড সম্পাদনার টেবিলে তৈরি হওয়া একটি ছবি।
বিভিন্ন জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রসঙ্গে লেনিনের একটি বক্তব্য দিয়ে শুরু হয় ছবিটি। ২০ মিনিটের এই ছবিতে বাংলাদেশের মানুষ আছে, এর প্রকৃতি আছে, আছে পাকিস্তানিদের অত্যাচার, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগের দৃশ্য। নির্যাতিত মানুষের হাহাকার-বিলাপ-অসহায়ত্ব। আছে ভিয়েতনামে মার্কিন বোমাবর্ষণের কিছু স্থিরচিত্র দিয়ে ফুটিয়ে তোলা সেখানকার ভয়াবহতার বয়ান। সায়গনের কোনো এক অসহায় শিশু থেকে ভারত সীমান্তের শরণার্থী শিবিরের লোকজনের ছবি। ডেটলাইন সায়গন থেকে চলে আসে ডেটলাইন বনগাঁয়। ধারাভাষ্যে যখন আমরা শুনি, ‘ডেটলাইন বনগাঁ, স্টপ’ তখন ছবিতে দেখি যুদ্ধ ও গণহত্যার শিকার হয়ে বাংলাদেশের সাধারণ নারী, শিশু বা বৃদ্ধরা ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে, শরণার্থীতে পরিণত হচ্ছে। অনিশ্চিত অজানার পথে চলছে শরণার্থীদের দীর্ঘ যাত্রা। ধারাভাষ্যে আবার শোনা যায়, ‘ইট ইজ নট ভেরি ডিফিকাল্ট টু ফাইন্ড দেম।’ ব্যাপারটি তো আসলেই তাই। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ ও গণহত্যার শিকার মানুষদের তো এই একই দশা। তাদের তো খুঁজে পাওয়া যায় সবখানেই।
ছবিতে আমরা শুনি নির্যাতিত মেয়েদের কথা। দেখি সারি সারি মৃতদেহের ছবি, লাশ নিয়ে কুকুর, শেয়াল ও শকুনের টানাটানি। হিটলার, নাৎসি বাহিনী ও তাদের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ। জার্মান প্রিজন ক্যাম্প থেকে ভারতের শরণার্থী শিবির। মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশন, তাদের যুদ্ধপ্রস্তুতি সবই। জহির রায়হান ছবিটি শেষ করেন এক ধাক্কা দিয়ে, পর্দাজুড়ে ভেসে ওঠে স্টপ। ধারাভাষ্যে আমরা শুনি স্টপ জেনোসাইড, স্টপ স্টপ স্টপ…।
স্টপ জেনোসাইড স্পষ্টতই একটি প্রচারধর্মী ও বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বানানো ছবি এবং উদ্দেশ্যটি হচ্ছে বাংলাদেশে তখন যে গণহত্যা ঘটে চলেছে, তার বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত গড়ে তোলা ও বিশ্বের মনোযোগ আদায় করা। এ ধরনের ছবির শিল্পগুণ, নির্মাণশৈলী বা আঙ্গিক সাধারণত খুব বিবেচনার বিষয় হয় না। কিন্তু স্টপ জেনোসাইড এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। চলচ্চিত্র ভাষার আধুনিকতা ও শিল্পগুণের বিবেচনায়ও এটি একটি অনন্য সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত। এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত ছবিগুলোর মধ্যে স্টপ জেনোসাইড সব বিবেচনায়ই সেরা। বাংলাদেশের গণহত্যার কথা বলতে গিয়ে তিনি দুনিয়াজুড়ে নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার মানুষের কথাও বলেছেন। স্টপ জেনোসাইড সেদিক দিয়ে দেশ ও কাল ছাড়িয়ে যাওয়া একটি ছবি।
অনেক সমালোচক মনে করেন, কলকাতায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বানানো যেসব চলচ্চিত্র তিনি দেখেছেন, তাদের মধ্যে কিউবার পরিচালক সান্তিয়াগো আলভারেসের ছবি দ্বারা তিনি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। স্টপ জেনোসাইড-এর নির্মাণশৈলীর সঙ্গে আলভারেসের হাস্তালা ভিত্তোরিয়া সিয়েম্প্রে ছবিটি নির্মাণের গল্পের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই ছবিও মূলত সম্পাদনার টেবিলে বসে বানানো এবং মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় ছবিটি তৈরি করেছিলেন আলভারেস। ফিদেল কাস্ত্রো আনুষ্ঠানিকভাবে চে গুয়েভারার মৃত্যুর খবর ঘোষণা করেছিলেন যে সমাবেশে, সেখানে দেখানোর জন্য ছবিটি বানানো হয়েছিল।
স্টপ জেনোসাইড ছবির প্রথম প্রদর্শনী কবে ও কোথায় হয়েছিল সে সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য জানা যায় না। একাত্তরের মে বা জুন মাসের দিকে প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল বলে অনেকের লেখায় উল্লেখ আছে। এতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন বলে জানা যায়। ব্রিটিশ চলচ্চিত্রতাত্ত্বিক ও সমালোচক জেমস লিহির একটি লেখার সূত্রে আমরা জানি যে এই ছবিটি তৈরিতে অর্থ জুগিয়েছিলেন বাংলাদেশের ভারতীয় বন্ধুরা। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এর গুরুত্ব টের পেয়েছিলেন। ভারতের সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ছবিটি দেখে আলোড়িত হয়ে ভারতের সরকারি চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান ফিল্ম ডিভিশনকে ছবিটি কিনে নিতে ও আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
বর্তমান সময়ের স্বাধীন ধারার প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা মানজারে হাসিন মনে করেন, দেশে মুক্ত ও স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণের ধারা তৈরির জন্য যে আন্দোলন এখনো চলছে সেই ধারার প্রথম ছবি হচ্ছে স্টপ জেনোসাইড। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বানানো বাংলাদেশের সেরা ছবি।