শুক্রবার, ৯ ডিসেম্বর ২০১৬
প্রথম পাতা » ব্রেকিং নিউজ » পাচার হয়ে কেউ এ পাড়ায় ঢুকে গেলে মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব
পাচার হয়ে কেউ এ পাড়ায় ঢুকে গেলে মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব
পক্ষকাল সংবাদ ঃ
‘মুক্তি পাওয়া অসম্ভব, পালানোরও কোনো কায়দা নাই’দালালদের ছলচাতুরীর প্রলোভনে পড়ে বাংলাদেশের বহু নারী দেশে বিদেশে পাচার হচ্ছে। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন পাচার হওয়ার কারণে তাদের সবার জীবনে ভয়ানক দুর্ভোগ নেমে এসেছে।
পাচারের শিকার হয়ে স্থায়ী যৌনকর্মী হয়ে যাওয়া একজন জানান, পরীক্ষায় পাশ করে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ালেখা শুরুর যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন এক মহিলা তাকে ফরিদপুরের একটি যৌন-পল্লীতে বিক্রি করে দেয়।
পরিচয় গোপন রাখার স্বার্থে ওই যৌনকর্মী বলেন, নিজের ইচ্ছায় কেউ এ জায়গায় আসে না। সবাই পাচারের শিকার। তবে অন্য পল্লী থেকে কেউ কেউ স্বেচ্ছায় পাড়া বদল করে থাকে।
জানা যায় দালালরা সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকায় মেয়েদের পতিতালয়ে সর্দারনীর কাছে বিক্রি করে। পাচার হয়ে কেউ এ পাড়ায় ঢুকে গেলে মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। পাচার হয়ে আসার পর পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া ওই কর্মী বলেন, “গোসল করতে গেলেও লোক দাঁড়ানো থাকবে সাথে, টয়লেটে গেলেও লোক থাকবে সাথে। পালানোর কোথাও কায়দাই নাই। রাত্রে আবার রুমে দিয়ে তালা লাগায় দেয় বাইরে থেইকা।”
একটা পর্যায়ে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হলেও তার আর বাড়ি ফেরা হয়নি।
দেশের মধ্যে কতসংখ্যক নারী পাচার হচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো হিসেব পাওয়া যায় না। তবে জাতিসংঘের এক পরিসংখ্যানে বিশ্বের ৩৪ শতাংশ নারী নিজ দেশেই পাচার হয়। আর ৩৭ শতাংশ আন্তঃ-সীমান্ত পাচারের শিকার।
অন্যদিকে সেইভ দ্য চিলড্রেনের ২০১৪ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী পূর্ববর্তী ৫ বছরে বাংলাদেশের ৫ লাখ নারী বিদেশে পাচার হয়েছে। যাদের গন্তব্য ভারত, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদিসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ।
ঢাকার একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন প্রিয়া(ছদ্মনাম)। ২০১৪ সালে কাজের কথা বলে ভারতে নিয়ে বিক্রি করা হয় তাকে। যশোরের একটি মানবাধিকার সংগঠনের মাধ্যমে এবছর অক্টোবর মাসে তিনি দেশে ফেরেন। প্রিয়া বলছিলেন, “বর্ডার পার করার পর আমাকে বম্বে নিয়ে যায়। তিন দিন পরে আমারে একটা হোটেলে দেয়। ওখানে অনেক নির্যাতন হয় আমার ওপর। কাজের নাম করে নিয়ে ওরা আমাকে খারাপ কাজে দেয়। একটা লোকের কাছে দিয়ে বলতো স্বামী স্ত্রী যে কাজ করে তোমরা তাই কর। আমি করতে চাইতাম না তাই মারতো। বেল্ট খুলে খুলে মারতো। দেয়ালে মাথা ধাক্কাতো।”
ভারতীয় সমাজকল্যাণ বোর্ডের বরাত দিয়ে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি জানায় ১৮টি রুট দিয়ে বছরে ২০ হাজার বাংলাদেশি নারী ও শিশু ভারতে পাচার হয়।
ভারতে সবাইকে বিক্রি করে দেয়া হয় হোটেল কিংবা যৌন পল্লীতে। এছাড়া শ্রম-দাস হিসেবে থাকতে বাধ্য হন অনেকে। মালিকের হুকুম না শুনলে ভয়াবহ নির্যাতন নেমে আসে সবার ওপর। ভারত থেকে উদ্ধার রিয়া (ছদ্মনাম) বলেন, কথা মতো কাজ না করলে তাকে লাঠি এমনকি চাবুক দিয়েও পেটানো হতো। রিয়া জানান তিনি যেখান থেকে এসেছেন সেখানে এখনো অনেক বাংলাদেশি নারী রয়েছে।
“সবাই কান্নাকাটি করে আর ম্যাডামদের বলে আমরা কি কখনো মা বাপের বুকে যাতি পারবো না? না গেলি আমাদের এখানেই মেরে ফেল, আমরা এখানেই মরে যাই।”
রিয়া বলেন, দেশে ফিরে আসলেও পাচার হওয়া নারীকে বাংলাদেশের সমাজে কখনোই সহজভাবে গ্রহণ করা হয় না। এসব কারণে অনেকেই আবার ভারতে পুরনো ঠিকানায় চলে যেতে চায়।
পাচার রোধে ২০১২ সালে বাংলাদেশে নতুন আইন হয়েছে। ২০১৫ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পুলিশের ডিআইজি মো. হুমায়ুন কবির দাবি করেন, নতুন আইন এবং মানব পাচার রোধে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের ফলে নারী পাচার আগের থেকে কিছুটা কমেছে। তিনি বলেন, “পাচার রোধে স্পেশাল আইন করা হয়েছে, স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল করা হচ্ছে এবং পুলিশ যাতে সার্বক্ষণিক তদন্ত কাজটি যথাযথ গুরুত্ব-সহকারে করে সেজন্য পুলিশ হেডকোয়ার্টার কনসার্ন এখানে মনিটরিং সেল করা হয়েছে।”
নারী পাচার পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, পাচারের মামলা তদন্ত এবং বিচার যে হারে হচ্ছে তা সন্তোষজনক নয়। তাই এটি থামানো যাচ্ছে না। মহিলা আইনজীবী সমিতির হিসেবে ২০১২ সালে আইন হবার পর নারী পাচারে মামলা হয়েছে দুই হাজার ৬শ ৭০টি, রায় হয়েছে মাত্র ১৪টি। এখনো ২১৫৬টি মামলা বিচারাধীন এবং ৫০০ মামলার তদন্ত চলছে।
“এটা কিন্তু কোনোভাবেই কমে নাই। কারণ আমরা আগে যে হারে নারীদের ফিরিয়ে এনেছি এখন তারচেয়ে বেশি ফেরত আনা হচ্ছে। আর যে সমস্ত জায়গায় আগে কখনো মেয়ে ছিলনা যেমন গোয়া এরকম অনেক রেড লাইট জায়গাতে অনেকে বাংলাদেশি মেয়ে আছে।”