আ.লীগের অর্জন, নির্বাচন সুষ্ঠু করার চাপ বেড়েছে
পক্ষকাল সংবাদ : নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনকে অনেক অর্জনের নির্বাচন মনে করছে আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে এই নির্বাচন তাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য একটা চ্যালেঞ্জ বলেও মনে করছেন দলটির নেতাদের অনেকে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আরেকটি নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রাক্কালে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন সুষ্ঠু করা এবং জয়ের মাধ্যমে দলের জনপ্রিয়তা দেখানোরও তাগিদ ছিল আওয়ামী লীগের। এ কারণে সেলিনা হায়াৎ আইভীকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। আইভীর ব্যক্তি ইমেজ ও জনপ্রিয়তার ওপর ভরসা করে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ ‘বাজি’ ধরতে পেরেছে।
তবে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার ও আওয়ামী লীগের ওপর সুষ্ঠু নির্বাচনের ধারা বজায় রাখার চাপ বেড়ে গেছে। মানুষের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে সরকার চাইলেই সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। পাশাপাশি দলীয় রাজনীতিতে কী ধরনের নেতাদের এগিয়ে নিতে হবে আর কাদের দূরে রাখতে হবে-সেই শিক্ষাও দিয়েছে এই নির্বাচন।
নারায়ণগঞ্জে আইভীর বিপুল বিজয়ের পর গতকাল শুক্রবার আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কেন্দ্রীয়ভাবে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন তদারকের দায়িত্বে থাকা ১০ জন নেতার সঙ্গে কথা হয় । তাঁদের প্রায় সবাই বলেছেন, আইভীর জয়ের ব্যাপারে সবাই আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা নেই সরকারি দলের। ফলে ভোটারদের আচরণ কী হতে পারে-তা নিয়ে শঙ্কাও ছিল। শেষ পর্যন্ত স্বস্তির জয়ই এসেছে।
এসব নেতার মতে, এখন আর বিএনপির নেতারা কথায় কথায় বলতে পারবেন না যে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে সরকার ভেসে যাবে। তবে এখন আওয়ামী লীগের অর্জনের চেয়ে মানুষের মধ্যে বেশি আলোচিত হবে, সরকার চাইলেই সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। এর ফলে একটা চাপও তৈরি হবে।
গতকাল সন্ধ্যায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে আইভী বলেছেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে বলেই নৌকার জয় হয়েছে। প্রমাণ হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। নারায়ণগঞ্জে যে উদহারণ সৃষ্টি হলো, তা সারা বাংলাদেশে হবে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গতকাল বলেন, ‘আমাদের বড় অর্জন একটা ভালো নির্বাচন উপহার দিয়েছি। ভবিষ্যতেও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ আন্তরিক থাকবে।’
মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘এই নির্বাচনে একটা বিষয় পরিষ্কার, এখনো আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি। তারা প্রায় এক লাখ ভোট পেয়েছে। আমাদের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ নিজেদের ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করা। আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও বিবেচনায় রাখতে হবে।’ তিনি মনে করেন, মাঠে আইভীর মতো শক্ত ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থী না থাকলে বিপদে পড়তে হবে। আইভীর জয়ের পেছনে সরকারের উন্নয়ন, জঙ্গি দমনে সফলতা ও আইভীর ব্যক্তি গ্রহণযোগ্যতা কাজ করেছে।
কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত সব স্থানীয় নির্বাচনই কম-বেশি বিতর্কিত হয়েছে। বর্তমান কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। বিএনপি নির্বাচন কমিশন গঠনে ১৩ দফা প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত রাখার দাবি আছে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগও নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাই করার ক্ষেত্র খোঁজ করছিল। নারায়ণগঞ্জে সেই সুযোগ নেওয়া হয়েছে। এই নির্বাচন আওয়ামী লীগের নেতাদের পাশাপাশি কর্মীদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে।
একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এর মাধ্যমে আমরা ২০১৯ সালের নির্বাচনের রিহার্সাল দিলাম। আইভীর মতো ভালো প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারলে জাতীয় নির্বাচনেও আমরা ভালো করব-এই আত্মবিশ্বাস এসেছে।’
সরকারি দলের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, আইভীকে প্রার্থী করার আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারায়ণগঞ্জে একাধিক জরিপ চালিয়েছেন। তাতে আইভীর এগিয়ে থাকার তথ্য এসেছিল। আর বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে প্রত্যক্ষ ভোটের শেষ নির্বাচন হয় নারায়ণগঞ্জে। তাই কমিশন ও সরকার একটি বিতর্কমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের চাপে ছিল। আর নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনের পরিবেশ ও ফলাফল কী হয়, তা দেখার জন্য দেশি-বিদেশি অনেকে উৎসুক ছিলেন।
অন্যদিকে আইভী নিজেও ভোটের আগে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে ভোটে জয়ী হওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আরজি জানান।
আওয়ামী লীগের দুজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন নিয়ে সরকার ও আওয়ামী লীগের অনেক হিসাব-নিকাশ ছিল। সেনাবাহিনী ছাড়াই সুষ্ঠু নির্বাচন করার লক্ষ্য ছিল সরকারের। এটা করে দেখানো গেছে। আর বিএনপি বলছে, সরকারের জনপ্রিয়তা তলানিতে। অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের জরিপে বিএনপির তুলনায় আওয়ামী লীগের অধিক জনপ্রিয়তার তথ্য এসেছে। নারায়ণগঞ্জে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর বিজয় প্রমাণ করে দলটির জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমরা জনপ্রিয় ও ভালো প্রার্থীর ওপর আস্থা রেখেছি। জনগণ আমাদের প্রার্থীর প্রতি আস্থা রেখেছে। এর প্রতিদান পেয়েছি। ভবিষ্যতেও এ ধরনের নেতাদের প্রমোট করা হবে।’
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন তদারকের দায়িত্বে থাকা দুজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, নারায়ণগঞ্জে আইভীর জয় থেকে আওয়ামী লীগের অনেক কিছু শেখার আছে। কারণ আইভীর কোনো ক্যাডার বাহিনী নেই। তাঁর টাকার জোরও নেই। শামীম ওসমানের মতো পেশিশক্তির অধিকারী একজনের সঙ্গে যুদ্ধ করে ‘সাহসের প্রতীক’ হয়ে ওঠেন। আর আইভী মেয়র হয়ে নারায়ণগঞ্জে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। নারায়ণগঞ্জের মানুষ তাঁর সাহস ও উন্নয়নের পক্ষে রায় দিয়েছে।