রবিবার, ৭ মে ২০১৭
প্রথম পাতা » বিশ্ব সংবাদ » মস্কো-ইসলামাবাদ সম্পর্ক: বেপরোয়া উদ্যোগ না স্বতঃস্ফূর্ত মিলন
মস্কো-ইসলামাবাদ সম্পর্ক: বেপরোয়া উদ্যোগ না স্বতঃস্ফূর্ত মিলন
ইয়াসির মালিক
অতি সাম্প্রতিক সময়ে পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে রাশিয়া, পাকিস্তান ও চীন ত্রিপক্ষীয় একটি জোট প্রতিষ্ঠায় প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করছে। গত কয়েক বছরে কৌশলগত তাৎপর্যপূর্ণ কিছু ঘটনা হয়তো কৌশলগত সম্পৃক্ততায় পরিণত করেছে। ইসলামাবাদ-মস্কো সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা বিশ্লেষণ করার জন্য চমৎকার একটি বিষয়। আর এ কারণেই দুই দেশের মধ্যকার এই পরিবর্তনের বিষয়টি বোঝার দরকার রয়েছে।সার্বিক পর্যালোচনা
সমসাময়িক বৈশ্বিক রাজনীতি ব্যাপক পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করছে। দীর্ঘ দিন ধরে কৃষিজ অর্থনীতি থেকে বৈশ্বিক শিল্প জায়ান্ট হিসেবে চীনা পথচলা এবং রাশিয়ার নব-উত্থান বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশকে নাটকীয়ভাবে বদলে দিয়েছে। সঙ্ঘাত ও সহযোগিতার মাত্রা ব্যাপকভাবে বদলে গেছে, বৈশ্বিক কৌশলগত দৃশ্যপটে নতুন নতুন সুযোগের পাশাপাশি চ্যালেঞ্জেরও সৃষ্টি হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো পাকিস্তান এবং কিছুদিন আগে পর্যন্ত তার বৈরী রাশিয়ার মধ্যকার সম্পর্কের বরফ গলা। একেবারে শুরু থেকে ভাঙন পর্যন্ত সম্পর্ক ছিল তিক্ত। পুরো স্নায়ুযুদ্ধকালে মার্কিন শিবিরেই ছিল পাকিস্তান। ভাঙনের পর সৃষ্ট নানা ঘটনা উভয় পক্ষের মধ্যেই তাদের অতীত তিক্ততা প্রশমনের কারণ হয়। এরপর উভয় দেশের কর্মকর্তাদের সফর বিনিময়ে এবং বৈশ্বিক রাজনীতির দ্রুত পরিবর্তনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে উন্নতির নতুন নতুন দরজা খুলে যেতে থাকে।
দ্বিপক্ষীয় স্বার্থে রাশিয়া ও পাকিস্তান উভয়েই নানা ক্ষেত্রে একে অন্যকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। আগের বছর পুতিনের সরকার এসসিওতে পাকিস্তানের পূর্ণ সদস্য হওয়ার বিষয়টি অনুমোদন করে; অস্ত্র অবরোধ তুলে নেয়; প্রতিরক্ষা, অবকাঠামো ও জ্বালানির মতো বিভিন্ন খাতে সহযোগিতার প্রস্তাব দেয়।
বর্তমান সময়ে রাশিয়ার নতুন করে উত্থান যুক্তরাষ্ট্রের একক অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এই দুই ঐতিহ্যবাহী প্রতিদ্বন্দ্বির কাছে ক্ষমতা লাভের প্রয়াসে দক্ষিণ এশিয়া ক্রমবর্ধমান হারে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অবাধ ও অস্বাভাবিক কৌশলগত সম্পর্ক রাশিয়াকে এই অঞ্চলে তার নতুন মিত্র খুঁজতে বাধ্য করে। ফলে পাকিস্তানের প্রতি কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ সম্প্রসারণ ঘটিয়ে রাশিয়া এই অঞ্চলে তার প্রভাব জাহির করার চেষ্টা করছে।
মস্কোর উচ্চাভিলাষ
এর পরপরই পাকিস্তান ও রাশিয়া পারস্পরিক স্বার্থের নজিরবিহীন যুগে প্রবেশ করে। ভারত মহাসাগরের উষ্ণ পানিতে প্রবেশে রাশিয়ার উচ্চাভিলাষ, কৌশলত প্রতিদ্বন্দ্বি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের অবস্থান সুসংহত করা এবং বিকল্প অস্ত্র ও জ্বালানি বাজার খোঁজার প্রয়াসই পাকিস্তানের দিকে ঠেলে দেয় রাশিয়াকে। এটা কেবল পাকিস্তানের ভূকৌশলগত গুরুত্বই তীব্র করেনি, সেইসাথে উভয় দেশের জন্য নতুন নতুন সুযোগের দরজাও খুলে দেয়।
অতীতের তিক্ততা ভুলে রাশিয়া ও পাকিস্তানের কাছাকাছি আসার ফলে বিশেষ করে প্রতিরক্ষা খাতে দ্রুত অগ্রগতির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটেই দুই দেশ দুই সপ্তাহের যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নেয়। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করে করাচিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আমান ২০১৭ নামের বহুজাতিক নৌমহড়াতেও রাশিয়ার নৌবাহিনী অংশ নেয়।
দুই দেশের সামরিক বাহিনীও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। রাশিয়ার কাছ থেকে প্রায় ১৫৩ মিলিয়ন ডলারে এমআই-৩৫ হেলিকপ্টার কেনার আলোচনা চলছে। এই ক্রয় পাকিস্তানের বিমান প্রতিরক্ষার সামর্থ্য বাড়াবে। এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এএইচ-১ কোবরা অ্যাটাক হেলিকপ্টারের স্থলাভিষিক্ত হবে।
অধিকন্তু রাশিয়া হলো বিশ্বের অন্যতম গ্যাস মজুত থাকা দেশ। পাশ্চাত্যের সাথে অবনতিশীল সম্পর্কের কারণে রাশিয়া এখন বিকল্প বাজার খুঁজছে। অন্যদিকে পাকিস্তানে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। দুই পক্ষের প্রয়োজনের আলোকেই লাহোর থেকে করাচি পর্যন্ত ১,৩০০ কিলোমিটার উত্তর-দক্ষিণ তরলীকৃত গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণে রাশিয়া দুই বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
আবার রাশিয়া ও পাকিস্তান উভয়েই আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বেপরোয়া। পাকিস্তান মনে করে, এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আফগানিস্তানে শান্তি থাকা জরুরি। তাছাড়া বিপুল ব্যয়ে নির্মিত চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের নিরাপত্তার জন্যও এটা অত্যাবশ্যক। আর রাশিয়া মনে করে, মধ্য এশিয়া হয়ে মাদক পাচার বন্ধ করতে এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে মার্কিন প্রভাব খর্ব করতে আফগানিস্তানে তার প্রভাব বাড়ানো দরকার।
তালেবানের সাথে যে গুটিকতেক দেশের সম্পর্ক রয়েছে, পাকিস্তান তার অন্যতম। আবার রাশিয়া একসময় আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার সমর্থক হলেও এখন তালেবানের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওয়াশিংটনের ওপর চাপ বাড়াতে তালেবানকে ব্যবহার করতে চাইছে রাশিয়া। এই সুযোগ কাজে লাগাতে তালেবান ও কাবুল প্রশাসনকে স্থবির হয়ে থাকা শান্তি আলোচনা আবার শুরু করতে তাগিদ দিয়ে আসছে। উভয়েই কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার প্রয়াসও উভয় দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সহযোগিতার পরিসর বাড়িয়ে দিয়েছে।
পাকিস্তানের বহু-বিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্পের অংশীদার হওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছে রাশিয়া। সিপিইসিতে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তি বাণিজ্যে নতুন পথের সন্ধান দেবে। সিপিইসিতে ভারতের যেকোনো সম্ভাব্য হুমকির মোকাবিলায় পাকিস্তান তখন রাশিয়ান কার্ডটি ব্যবহার করতে পারবে।
পাক-রাশিয়া সম্পর্কের নতুন বিকাশে কিছু উদ্বেগও সৃষ্টি হয়েছে। রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক বিকাশের সময় পাকিস্তানকে উভয় প্রতিদ্বন্দ্বির মধ্যকার সম্পর্কে ভারসাম্যা বজায় রাখতে হবে। উভয় দেশকে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানোর পাশাপাশি বাণিজ্য, জ্বালানি ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা সম্প্রসারণ ও জোরদার করতে হবে।
পারস্পরিক বিনিয়োগ উদ্যোগ এবং যৌথ ব্যবসায়িক কার্যক্রম দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত স্বার্থে হওয়া উচিত। অধিকন্তু, জনগণ পর্যায়ে যোগাযোগ, সাংস্কৃতিক বিনিময়ও ক্রমবর্ধমান হারে বাড়াতে হবে সম্পর্ক জোরদার করার জন্য। অবশ্যই মনে রাখতে হবে, এই ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের নেপথ্যে রয়েছে ইন্দো-মার্কিন নজিরবিহীন ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি। ভারত যাতে এই অঞ্চলের ভারসাম্য নষ্ট করতে না পারে সেজন্য সব ক্ষেত্রে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার সব সুযোগ সর্বোচ্চভাবে ব্যবহার করতে হবে পাকিস্তানকে।