খাল ভরাট করে পুলিশের হাউজিং:
পক্ষকাল ডেস্কঃ
আইনের রক্ষক পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তাদের আবাসন প্রকল্পের জন্য আইন লঙ্ঘন করে রাজধানীর খিলক্ষেতের একটি খাল ভরাটের অভিযোগ উঠেছে।
বোয়ালিয়া খাল নামে ওই জলাধারটি ভরাট না করতে পুলিশ অফিসার্স হাউজিং সোসাইটিকে চিঠি দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।
তবে পুলিশ অফিসার্স সোসাইটির কর্মকর্তাদের দাবি, তারা জলাধার আইন লঙ্ঘন না করে শুধু তাদের কেনা জমিটুকু ভরাট করছেন।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এ খালটি এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য জরুরি। এটা ভরাট করা হলে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হবে।
(বোয়ালিয়া সেতুর যে পাশে পুলিশ অফিসার্স হাউজিং সোসাইটির প্রকল্প, তার বিপরীত পাশে খাল এখনও আছে এমন প্রশস্ত)
রাজউক কর্মকর্তারা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, কুড়িল-পূর্বাচল ১০০ ফুট খাল খনন ও উন্নয়ন প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে গেলে বোয়ালিয়া খাল ভরাটের বিষয়টি তাদের নজরে আসে।
তখন বিস্তারিত জানতে ১০০ ফুট খাল খনন প্রকল্পের পরিচালক রাজউকের ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান প্রকল্পের পরিচালককে চিঠি দেন তারা। ড্যাপ প্রকল্পের কর্মকর্তারা জরিপ করেও খাল ভরাটের প্রমাণ পান।
এরপর গত ১৭ এপ্রিল ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান প্রকল্পের পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম বাংলাদেশ পুলিশের এআইজি (উন্নয়ন) এবং বাংলাদেশ পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির দপ্তর সম্পাদককে চিঠি পাঠান।
চিঠিতে বলা হয়, “নগর পরিকল্পনা শাখার সরেজমিন জরিপে দেখা গেছে যে, কুড়িল-পুর্বাচল লিঙ্ক রোডে সংলগ্ন ‘পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতি’ আবাসন প্রকল্প এলাকার অভ্যন্তরে বোয়ালিয়া খাল আপনার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ভরাট করা হয়েছে, যা জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০-এর পরিপন্থি।
(বোয়ালিয়া সেতুর দুই পাশে খালের প্রশস্ততার পার্থক্য চোখে পড়ে খালি চোখেই)
“এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে উক্ত এলাকাসহ খিলক্ষেত, লেকসিটি কনকর্ড এবং তদসংলগ্ন পার্শ্ববর্তী এলাকার বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য উক্ত বোয়ালিয়া খালের নিষ্কণ্টক পানি প্রবাহ অতীব জরুরি।”
বোয়ালিয়া খালটি ভরাট বন্ধ করার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানানো হয় রাজউকের চিঠিতে।
রাজউকের কর্মকর্তারা বলছেন, ৩০০ সড়কের পাশে ১০০ ফুট এ খাল প্রথমে বোয়ালিয়া খালের সঙ্গে মিলবে। পরে আবার বোয়ালিয়া খাল থেকে বালু নদী পর্যন্ত যাবে।
বোয়ালিয়া খাল ভরাট হয়ে গেলে কুড়িল থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত ১০০ ফুট খাল প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হবে বলে জানান রাজউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের খালটি ওই খালের সঙ্গে মিলেছে। একারণে ওই খালটি যদি প্রবাহমান না থাকে তাহলে আমাদের এই খালের কার্যক্রম ব্যাহত হবে।
(পুলিশ অফিসার্স হাউজিং সোসাইটির প্রকল্পের জন্য ভরাটের ফলে শীর্ণ বোয়ালিয়া খালের ধারা)
“বোয়ালিয়া খালের সংযোগস্থলে স্লুইচগেট থাকবে পানি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। এছাড়া বারিধারা, গুলশান, বাড্ডা, ক্যান্টনমেন্ট, বিমানবন্দর, নিকুঞ্জ এলাকার প্রস্তাবিত স্যুয়ারেজ নেটওয়ার্কের পাইপও বোয়ালিয়া খালের ওপর পড়বে। সে কারণেও ওই খালের প্রবাহ ঠিক রাখা একান্ত জরুরি।”
গণপূর্তমন্ত্রী মো্শাররফ হোসেন ‘প্রয়োজনে বোয়ালিয়া খাল ড্রেজিং’ করার কথাও বলেছেন বলে রাজউকের এই প্রকৌশলী জানান।
তিনি বলেন, “আমাদের এই প্রকল্প না হলেও তো জলাধার আইন অনুযায়ী তারা (পুলিশ) এই খাল ভরাট করতে পারে না। একটা একটা বহমান খাল ভরাট করা তো কোনো শুভ লক্ষণ না।”
এই বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের অতিরিক্ত আইজি (উন্নয়ন) ও পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির দপ্তর সম্পাদক গাজী মো. মোজাম্মেল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পুলিশের আবাসন প্রকল্পে জলাধার আইন লঙ্ঘন হয়নি।
“ড্যাপে এই জমিকে আরবান রেসিডেন্সিয়াল জোন হিসেবে চিহ্নিত করা আছে।”
তিনি বলেন, সিএস এবং আরএস ম্যাপে এই খালের মাপ কোথাও ২০ ফুট, কোথাও ৩০ ফুট আবার কোথাও ৪০ ফুট। খাল ভরাটের অভিযোগ অবান্তর।
(চলছে পুলিশ অফিসার্স হাউজিং সোসাইটির প্রকল্পের কাজ, শীর্ণ হচ্ছে বোয়ালিয়া খাল)
“সরকার আমাদেরকে যে নকশায় অধিগ্রহণ করে দিয়েছে, সে অনুযায়ী খাল যতটুকু পরিমাণ আছে ততটুকু পরিমাণ রেখেছি। নকশার চেয়ে বেশি একটুও ভরাট করিনি।”
খালের জমি নিতে হলে রাজউককে মূল্য পরিশোধ করতে হবে বলে জানান মোজাম্মেল হক।
“ড্যাপে যে ১৫০ ফুট খাল দেখাচ্ছে, ওই জায়গাটা তো আমাকে কিনে নিতে হয়েছে সরকারের কাছ থেকে। তারা যদি ৪০ ফুটের জায়গায় ১৫০ ফুট করতে চায়, তাহলে বাকি জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। আমাদের হাউজিংয়ে প্রভিশন রাখা আছে। যখন আপনারা অধিগ্রহণ করবেন তখন আমরা পুরো জমি দিয়ে দেব।”
যেভাবে হারায় খাল
উত্তরখান থানার তেমুখ এলাকায় তুরাগ নদী থেকে বোয়ালিয়া খালের উৎপত্তি। উত্তরখান, পোড়াদিয়া, ভাটিরা ও বরুয়া এলাকা হয়ে বেরাইদের কাছে বালু নদীতে মিলেছে এ খাল।
এক সময় তেমুখ থেকে বেরাইদ পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ছিল এ খাল। তবে এখন তেমুখ থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা পর্যন্ত প্রায় ৮ কিলোমিটার এবং বসুন্ধরার এম ব্লক থেকে বালু নদী পর্যন্ত সাড়ে তিন কিলোমিটারের মতো খাল আছে। মাঝের দেড় কিলোমিটার অংশে খালের কোনো অস্তিত্ব নেই।
মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা গেছে, ৩০০ ফুট সড়কের বোয়ালিয়া সেতুর নিচে খালের প্রশস্ততা প্রায় ১৫০ ফুট। আর খিলক্ষেত-ইছাপুরা সড়কের ওপর পুরোনো বোয়ালিয়া সেতুর কাছে প্রশস্ততা প্রায় ২০০ ফুট। সেখান থেকে উত্তর দিকেও খাল কোথাও ১৫০ ফুট, কোথাও এর চেয়ে বেশি চওড়া।
তবে পুলিশ অফিসার্স হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ৩০০ মিটার অংশে খাল প্রস্থে ৩০-৪০ ফুটের মতো।
(বালু ভরাটের কারণে হারাচ্ছে বোয়ালিয়া খাল)
(বালু ভরাটের কারণে হারাচ্ছে বোয়ালিয়া খাল)
বরুয়া গ্রামের কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সময় এই খাল অনেক প্রশস্ত ছিল। তবে সময়ের পরিক্রমায় একটি সরু হয়ে গেছে।
এই খাল হয়ে কাওলা, বিমানবন্দর, সেনানিবাস, গুলশান, বারিধারা, নিকুঞ্জ এলাকার বৃষ্টির পানি প্রবাহিত হয় বলে জানান বরুয়া পূর্বপাড়ার বাসিন্দা আইয়ুব আলী।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই সব এলাকার পানি এইদিক দিয়া নামে। খাল বন্ধ করলে বিমানবন্দরসহ ওইসব এলাকা ডুইবা যাইব।”
আগে এই খাল বেরাইদ পর্যন্ত ছিল। তবে অনেকে খালের জমি নিজেদের নামে রেকর্ড করেছে বলে জানান বরুয়ার প্রবীণ বাসিন্দা আবদুর রহমান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পরে লোকজন বসুন্ধরার কাছে জমি বিক্রি করে দিয়েছে। ওই অংশে বসুন্ধরার এম ব্লকের ভেতরে ছিল।
“বর্ষাকালে খালে অনেক পানি থাকত। শুকনার সময় অল্প পানি থাকত। হেই সময় ধান লাগাইত লোকজন। ক্ষেতের মইদ্যে দিয়া সরু খাল আছিল। সেইটাও আস্তে আস্তে ভইরা গ্যাছে।”
সিএস নকশায় খাল থাকলেও আরএস নকশায় অনেকে খালের জমি নিজের নামে রেকর্ড করিয়েছেন বলে জানান তিনি।
“আরএসে রেকর্ড করানোর পর বসুন্ধরা যহন আইল, তহন তারা জমি বসুন্ধরার কাছে বেইচা দিছে। বসুন্ধরা তাদের প্রজেক্ট বানাইছে। এমনি কইরা ওই জায়গায় খাল হারাইয়া গ্যাছে।”