সোমবার, ২২ মে ২০১৭
প্রথম পাতা » » এমপি হারুনের ভাগ্যের চাকা ঘুরছে রকেটগতিতে
এমপি হারুনের ভাগ্যের চাকা ঘুরছে রকেটগতিতে
পক্ষকাল ডেস্কঃ
রাজাপুর-কাঁঠালিয়ার আ’লীগ নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ-বিব্রত, ‘এমপির হাত থেকে স্থানীয় আ’লীগকে বাঁচাতে হবে’
পুলক চ্যাটার্জি, বরিশাল ব্যুরো’মানুষ ছি ছি করছে, লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না। নামের আগে ‘আল্লামা’ জুড়ে এমপি সাহেব ও তার পরিবার এত অপকর্ম করেছেন, তা আমরা জানতাম না।’ সমকালকে এসব কথা বলেন এমপি বি এইচ হারুনের নির্বাচনী এলাকা কাঁঠালিয়া উপজেলার আমুয়া বন্দরের একাধিক ব্যবসায়ী।
রাজধানীর বনানীতে হোটেল রেইনট্রিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী ধর্ষণ ঘটনায় নিন্দা-সমলোচনার ঝড় বইছে ঝালকাঠির রাজাপুর-কাঁঠালিয়ার সর্বত্র। হোটেল রেইনট্রির মালিক রাজাপুর-কাঁঠালিয়া থেকে (ঝালকাঠি-১) নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুন ওরফে বি এইচ হারুনের স্ত্রী মনিরা হারুন ও তার চার ছেলেমেয়ে। তবে জমির মালিকানা বি এইচ হারুনের স্ত্রীর নামে। ওই হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে অস্ত্রের মুখে ধর্ষণ ঘটনার সঙ্গে ছেলে মাহীর হারুনের সংশ্লিষ্টতা, পাঁচ বছরে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া, এক ব্যাংক গ্রাহকের সঙ্গে প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকার প্রতারণা ইত্যাদি নিয়ে রাজাপুর-কাঁঠালিয়ায় রাজনীতি সচেতন মহলসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মুখে এখন আলোচনার বিষয় এমপি বি এইচ হারুন ও তার পরিবার। ক্ষুব্ধ-বিব্রত রাজাপুর-কাঁঠালিয়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-সমর্থকরা।
বিষয়টি নিয়ে দুই উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বলছেন, বানানীর ধর্ষণ ঘটনায় রাজাপুর-কাঁঠালিয়ায় আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দলের নেতারাও জানতেন না, পাঁচ বছরে এমপি বজলুল হক হারুন ও তার পরিবারের সদস্যদের ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে রকেটগতিতে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কাঁঠালিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তরুণ সিকদার বলেন, এমপি বিএইচ হারুনের হাত থেকে রাজাপুর-কাঁঠালিয়া আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে হবে। শুনেছি, হোটেল ব্যবসার আড়ালে চলে মাদক ব্যবসা। কাঁঠালিয়ার সব চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী এমপি হারুনের ঘনিষ্ঠ। তার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হচ্ছে এলাকার মানুষ। শিগগির কর্মী-সমর্থরা এমপি হারুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মাঠে নামবেন।
একই উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তারিকুল ইসলাম বুলবুল বলেন, যার বাবা ছিল ‘বুলবুলে পাকিস্তান’, তার কাছ থেকে সাধারণ মানুষ ভালো কিছু আশা করতে পারে না।
রাজাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জিয়া হায়দার খান বলেন, রেইনট্রি হোটেলের ঘটনায় রাজাপুর আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মী বিব্রত। আগামী নির্বাচনে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
রাজাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন মাতুব্বর বলেন, ‘আমরা বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে আছি। এলাকাবাসীর কাছে মুখ দেখাতে পারছি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। আগামী নির্বাচনে এ আসনে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শাজাহান ওমরকে (বীরউত্তম) পরাজিত করতে দলের নেতাকর্মীদের বেগ পেতে হবে।’
২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে বি এইচ হারুন নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় ৩৮ লাখ টাকার অর্থসম্পদ দেখান। স্ত্রী মনিরা হারুনের নামে তখন কিছুই ছিল না। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে বিএইচ হারুন হলফনামায় দেখান স্ত্রী ও তার নিজের নামে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ রয়েছে ১৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া নগদ প্রায় ৩ কোটি ৬৭ লাখ ও ব্যাংকে স্থায়ী আমানত ৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা এবং গাজীপুর ও ঢাকায় ৩৮ কাঠা জমির কথা উল্লেখ করা হয়। ছেলে আদনান হারুন ও নাহিয়ান হারুনকে ৩৩ কোটি টাকা ব্যবসার জন্য প্রদান এবং ভাই ফজলুল রব আজাদের নামে ১৫ কোটি টাকার আমানত দেখানো হয়। বনানীতে হোটেল রেইনট্রির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১২ সালে। বি এইচ হারুন প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালক। ওই ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে আটটি নামি-দামি কোম্পানিতে মালিকানা রয়েছে বি এইচ হারুনের। যার মধ্যে পাঁচটির চেয়ারম্যান তিনি। হোটেল রেইনট্রিসহ রাজধানীর গুলশান-বানানী এলাকায় তার মালিকানাধীন বহুতল ভবন রয়েছে ৪-৫টি। একটি সূত্র জানায়, আল-হুমায়রা মেডিকেল সেন্টার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এমপি হারুন। অভিযোগ রয়েছে, ২০০৮ সাল থেকে সব হজযাত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ওই মেডিকেল সেন্টার থেকে করানো বাধ্যতামূলক ছিল। এ সুবাদে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বি এইচ হারুন।
গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ: অভিযোগ রয়েছে, প্রিমিয়ার ব্যাংকের গ্রাহক পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলার বাসিন্দা রুমি এন্টারপ্রাইজের মালিক খলিলুর রহমানের ১৩৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বিএইচ হারুন। খলিলুর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুর্নীতি দমন কমিশনের পৃথক অভিযোগে বলেছেন, ২০০৮ সালে সিডরে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ১৫ হাজার ঘর নির্মাণের ২০৪ কোটি টাকার কাজ পেয়েছিলেন তিনি। খলিলুর রহমানের অ্যাকাউন্ট ছিল ঢাকার বংশাল শাখায়। তিনি অভিযোগ করেন, ৩৩৮টি চেক বই ইস্যু দেখিয়ে এমপি হারুন ভুয়া স্বাক্ষর দিয়ে ১৩৪ কোটি টাকা তুলে নেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদকে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাচ্ছেন না খলিলুর রহমান। চেক প্রতারণার অভিযোগে বি এইচ হারুনের বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার ওই মামলার অভিযোগ গঠনের তারিখ ছিল। খলিলুর রহমানের অভিযোগ, প্রভাব খাটিয়ে এমপি হারুন অভিযোগ গঠনের তারিখ আইনজীবীর মাধ্যমে পিছিয়ে দিয়েছেন। এদিকে বি এইচ হারুনের বিরুদ্ধে খলিলুর রহমানের চেক জালিয়াতি মামলার তদন্ত শুরু করেছে দুদক।
রেইনট্রি বিতর্ক: তথ্যমতে, ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ‘দ্য রেইনট্রি ঢাকা লিমিটেড’ নামে যে কোম্পানি নিবন্ধিত হয় সেটিই বর্তমানের রেইনট্রি হোটেল। ওই হোটেলের পরিচালকরা হলেন : বি এইচ হারুনের স্ত্রী মনিরা হারুন, তিন ছেলে শাহ মো. নাহিয়ান হারুন, শাহ মো. আদনান হারুন ও মাহীর হারুন এবং মেয়ে হুমায়রা হারুন। এর মধ্যে শাহ মো. আদনান হারুন হোটেলটির এমডি। বি এইচ হারুনের নামে থাকা জমিতে হোটেলটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১২ সালে। বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালু হয় চলতি বছরের শুরুতে। বনানীর আবাসিক এলাকায় ১৯৮৯ সালে কেনা পাঁচ কাঠা জমির ওপর নির্মিত হোটেল রেইনট্রিকে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দিতে ২০১৬ সালে গণপূর্তমন্ত্রীকে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু ওই অনুরোধ রাজউকে পাঠানো হলে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পায়নি হোটেল রেইনট্রি। তারপরও সব ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল হোটেল রেইনট্রি। সব বিষয়ে বক্তব্য জানতে মুঠো ফোনে একাধিকবার কল করলেও এমপি হারুন রিসিভ করেননি।
সমকাল