২০১৮ সালে বাংলাদেশে আগাম নির্বাচন
পক্ষকাল ডেস্ক/উৎসঃ আজকাল /ঃ
বাংলাদেশে আগাম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাবনা জোরদার হয়ে উঠেছে। নির্ধারিত সময়ের আগে ২০১৮ সালেই এই নির্বাচনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট মহলগুলি থেকে। নির্বাচন কমিশন তাদের রোডম্যাপে আগাম নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের এখনও দেড় বছর বাকি। তার কিছু আগে নির্বাচন করা কারিগরি দিক থেকে অসম্ভব নয়। যদিও অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠানে এখনও অনেক বিষয়ের সুরাহা হয়নি। নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা অস্পষ্ট। নির্বাচন নিয়ে প্রধান দুই দলই অবশ্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সংবিধান অনুযায়ী, সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদের শেষ ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ফলে আগামী বছরের শেষ দিকে (নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০১৮) তফসিল ঘোষণা করে ২০১৯ সালের শুরুতেই নির্বাচন করতে হবে। আগাম নির্বাচন হলেও প্রথাগত কিছু প্রস্তুতি নির্বাচন কমিশনকে গ্রহণ করতে হয়। তার একটি হলো, রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে সংলাপ। নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ অনুযায়ী, জুলাই মাসে এই সংলাপ শুরু করে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি নাগাদ তা শেষ হবে। এছাড়াও, ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ এবং নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারনসহ আরও কিছু কাজ রয়েছে। এ সব কিছু সম্পাদন করে নির্ধারিত মেয়াদের ২/৩ মাস আগেই নির্বাচন করা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অবশ্য আগাম নির্বাচনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে, বিএনপি’র পক্ষ থেকেও আগাম নির্বাচন করার কোনও দাবি নেই। বিএনপি শুধু চাইছে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের অধীনে একটি নিরপেক্ষ প্রশাসন।
নির্বাচনের আগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঘিরে পর্দার আড়ালে কিছু কর্মকান্ড হয়ে থাকে। সেটা হল, প্রভাবশালী কিছু দেশ তাদের কৌশলগত স্বার্থ সুরক্ষায় আগামী সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে চায়। নির্বাচনের প্রস্তুতির পাশাপাশি অন্দরমহলের সেই ধরনের কর্মকান্ড শুরু হয়েছে। কৌশলগত স্বার্থ সুরক্ষায় এখানে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও রাশিয়া।
বিগত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। ভারত ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’ বলে একতরফা নির্বাচনকে সমর্থন করেছিল। চীন ও রাশিয়া বিষয়টিকে বাংলাদেশের একান্ত নিজস্ব বিষয় হিসাবে অভিহিত করে প্রকারান্তরে সমর্থন করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ অধিকাংশ আসনে ভোট ছাড়াই প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে যাওয়ায় ওই নির্বাচনে হতাশ হয়।
ভারতের হাই কমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠক করেছেন। বৈঠকের পর তিনি পরামর্শের জন্যে দিল্লি গিয়েছিলেন। শ্রিংলা মঙ্গলবার কূটনৈতিক সংবাদদাতাদের সংগঠন ডিকাবের নিয়মিত আয়োজন ‘ডিকাব টক’ অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতি থেকে দূরে থাকবে ভারত। এমন কি নির্বাচনের প্রাক্কালে কোনও প্রকার রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতেও তার দেশ যুক্ত হবে না। তিনি বলেন, ভারত চায় বাংলাদেশের সাথে জনগনের পর্যায়ে একটি দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই বন্ধুত্ব। শ্রিংলার মন্তব্যে ধারণা হচ্ছে যে, ভারত আগামী নির্বাচনে কোনও রাজনৈতিক পক্ষ নাও নিতে পারে।
বিএনপি সূত্রের খবর, বিএনপি চায় ভারত যেন আগামী নির্বাচনে গতবারের মতো আর আওয়ামী লীগের পক্ষে না যায়। ভারত নির্বাচনে নিরপেক্ষ থাকুক এটাই বিএনপির কাম্য। এই লক্ষ্যে ভারতের চাহিদা মোতাবেক দলটি এই কথাও এই বৃহৎ প্রতিবেশি দেশকে অবহিত করেছে যে, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে জামায়াতকে সরকারে নেয়া হবে না। এর পরই শ্রিংলা নতুন সুরে এটাই বলতে চাইছেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তাদের নাক গলানোর দিন শেষ। তবে অতীতের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, বাংলাদেশের কোনও রাজনৈতিক দল কট্টরভাবে ভারতের সঙ্গে বৈরী আচরণ করলে প্রতিবেশি দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা এবং কূটনীতি বেশ সক্রিয়ভাবে সেই দলটির বিরুদ্ধে কাজ করে। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরকালে হরতাল ডেকে তার সঙ্গে খালেদা জিয়া সাক্ষাৎ না করায় বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি খারাপ হয়েছিল। বিএনপি এখন সেটাই মেরামতের চেষ্টা করছে।
ঢাকায় ভারতের এক কূটনীতিকের সঙ্গে আলাপচারিতায় কিছুটা দ্বিধা সৃষ্টি হয়েছে। জানতে চাওয়া হয়েছিল, আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতের সমর্থন কি বহাল আছে? ওই কূটনীতিক পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আপনার কি মনে হয়, সমর্থন নেই? তবে আমাদের মধ্যে এই প্রশ্নও আছে যে, আওয়ামী লীগ কি ক্ষমতার আসতে পারবে? এখনকার পরিস্থিতি আওয়ামী লীগের যথেষ্ঠ অনুকূলে। তবে যতই দিন যাবে আওয়ামী লীগের জন্যে পরিস্থিতি এইরকম ভাল যাবে না। ফলে আওয়ামী লীগের সামনে আগাম নির্বাচনের চিন্তা এলে অবাক হব না।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচনের ওপর ভারতের কোনও হাত নেই। এখানকার পরিস্থিতিই নির্ধারণ করবে কারা ক্ষমতায় যাবে। আর নতুন সরকার যেই আসুক, তার সঙ্গে মিলিয়ে চলাই হবে বিচক্ষণ কূটনীতি। এক্ষেত্রে, আমরা কিছুটা আগাম পূর্বাভাস কিংবা ধারণা পেতে পারলে আমাদের সম্পর্ক সেই মোতাবেক এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা যাবে। ভারতের সামনে এখন সেটাই বড় প্রশ্ন।’
ভারতের ওই কূটনীতিক বলেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচনের পরিস্থিতি আর এবারের পরিস্থিতি এক নয়। এবার বিএনপি নির্বাচনে যাচ্ছে বলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। নির্বাচনে ভোট বিপ্লবের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। কেননা বিএনপি নির্বাচনে গেলে আওয়ামী লীগ বিরোধী সকল পক্ষ এক হয়ে ভোট দেবে। আমাদের জন্য আশঙ্কার দিক হলো, বিএনপি যতই কথা দিক সরকারে গিয়ে জামায়াতকে তারা বাদ দিতে আদৌ পারবে কিনা সেই প্রশ্ন উড়িয়ে দেয়া যায় না। হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যতই আঁতাত হোক শাপলা চত্বরের কথা ভুলে তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে বলে মনে হয় না। শাপলা চত্বরের মামলা এখনও চলছে।’
আগামী নির্বাচনকে ঘিরে এসব প্রশ্নে ভারতীয় কূটনীতিকদের পাশাপাশি বাংলাদেশের জনগণের মধ্যেও কৌতুহল রয়েছে। নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রস্তুত করবে কিনা সেই প্রশ্নও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে রুশ কেলেংকারির পর বিদেশী কোন দেশ বিশেষ করে ভারতের মতো স্পর্শকাতর প্রতিবেশির কাছ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের নামে ‘ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন’ (ইভিএম)-এর মতো কারিগরি সহায়তা নেয়ার ব্যাপারে বিএনপি’ আপত্তি জানাতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে।