শুক্রবার, ২ জুন ২০১৭
প্রথম পাতা » শিক্ষা ও ক্যারিয়ার | সম্পাদক বলছি » জনগণের কল্যাণের কথাই আমরা চিন্তা করছি;প্রধান বিচারপতি
জনগণের কল্যাণের কথাই আমরা চিন্তা করছি;প্রধান বিচারপতি
পক্ষকাল ডেস্ক ঃসংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর আপিল শুনানিতে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, সুপ্রিম যেহেতু কোর্ট সংবিধানের অভিভাবক। তাই শুধু বিচার বিভাগ নয়, বরং দেশের ভবিষ্যতের চিন্তা ভাবনা আমাদের করতে হয়। প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা যখন সংবিধানের ব্যাখ্যা দিব তখন পুরো সংবিধানকেই পর্যালোচনা করবো। আমরা শুধুই বিচারকের বিষয়ে চিন্তা করছি না। এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, জনগণ কোথায় গেল? সবার ওপরে জনগণ। জনগণ আছে বলে। সংসদ, বিচার বিভাগ আছে। আপনারা কেন এত শঙ্কাবোধ করছেন? তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, জনগণের কল্যাণের কথাই আমরা চিন্তা করছি। জনগণের অধিকার রক্ষায় অধস্তন আদালতের বিচারকরা কাজ করে যাচ্ছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের শুনানির শেষে দিনে প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নী জেনারেলের মধ্যে এসব যুক্তিতর্ক চলে।
প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে ১১তম কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষের চূড়ান্ত যুক্তি উপস্থাপনা শেষে মামলাটি সিএভি রাখেন।
দিনের শুরুতে রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল বক্তব্য রাখেন। পরে অ্যাটর্নি জেনারেলের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য শেষ হয়। রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য শেষে রিটের পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ তার পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন করেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানিতে বলেন, বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট, জাতীয় সংসদ, সুপ্রিম কোর্ট অর্থাৎ শাসন বিভাগ, আইন সভা ও বিচার বিভাগ সবই সংবিধান দ্বারা সৃষ্ট। নির্বাহী বিভাগ আইন সভা বা বিচার বিভাগ কেউ সার্বভৌম নয়। প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ কেবল সংবিধানের আইন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হওয়ার বিধান সংবিধানে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদসমূহ বলতে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের গণ পরিষদে যে সংবিধান গৃহিত হয়েছিল সেই অনুচ্ছেদ সমূহকেই বুঝাবে। সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদ সমূহ ভাল বা মন্দ বা তাতে মৌলিক অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কতটা রক্ষিত হয়েছে বা হয়নি সে কথা বলার এখতিয়ার বিচার বিভাগের নেই। কারণ বিচার বিভাগ সংবিধান দ্বারা সৃষ্ট। সৃষ্টি তার স্রষ্টার ভার-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা রাখে না। সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদসমূহ সমস্ত বিতর্কের ঊর্ধ্বে। কেবলমাত্র যখন তা সংশোধন হয় তখন সে সংশোধন সংবিধানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ কি না তা বিচার করার এখতিয়ার উচ্চ আদালতের আছে।
তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, আমি আপনার সঙ্গে আছি। আপনি যদি অধস্তন আদালত বিষয়ক আদি সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। অ্যাটর্নি বলেন, আমি তো আইন প্রণেতা নই। প্রধান বিচারপতি বলেন, শুধুই কি ১১৬তে হাত দিয়েছেন, পিএসসি, নির্বাচন কমিশন বিষয়ক অনুচ্ছেদ নিয়েও আপনাদের চিন্তা করতে হবে। এসকল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্বাধীনতার প্রশ্নটি জড়িত। আমরা যখন সংবিধানের ব্যাখ্যা দিব তখন পুরো সংবিধানকেই পালোচনা করবো। আমরা শুধুই বিচারকের বিষয়ে চিন্তা করছি না। সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের অভিভাবক। যদি অভিভাবকই হই তাহলে শুধু বিচার বিভাগই নয়, দেশের ভবিষ্যতের কথাও চিন্তা করতে হবে। জনগণের কল্যাণের কথাই আমরা চিন্তা করছি। জনগণের অধিকার রক্ষায় অধস্তন আদালতের বিচারকরা কাজ করে যাচ্ছেন। এ জন্য আমাকে অধস্তন আদালত পরিদর্শনের জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে হচ্ছে।
জবাবে অ্যাটর্নী বলেন, আমরা অনুন্নত দেশ। আমাদের আর্থিক অবস্থা দেখতে হয়। মন্ত্রীরা যদি কোনো অসদাচরণের কারণে অভিযুক্ত হন তাহলে রাজনৈতিক কারণেই তিনি তার পদ হারান। তাছাড়া সংসদের মেয়াদকাল শেষ হলে বা সংসদ ভেঙে গেলে পুণরায় তাদের জনগণের সামনে যেতে হয়। জনগণই তাদের বিগত বছরগুলোর কর্মকান্ডের বিচার-বিবেচনা করে এবং জনতার আদালতেই তাদের বিচার হয়ে যায়।
বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, এটা ব্যক্তির বিচার করা হয়। অ্যাটর্নী বলেন, একজন জেলা জজ যদি অসদাচারণ, অনিয়ম করে তবে তার বিচার তো আপনারাই করেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, এটা ঠিক না। স্থানীয় সংসদ সদস্যরা এক স্কুলকে বাদ দিয়ে আরেক স্কুলকে এমপিও ভূক্ত করে থাকেন। এ নিয়ে হাজার হাজার মামলা আমাদের সামনে আসে। তখন তো আমরাই বিচার করি।
প্রধান বিচারপতি বলেন কয়দিন আগে ভারতে কি হয়েছে? হাইকোর্টের একজন বিচারপতি প্রধান বিচারপতিসহ অন্যান্য বিচারপতির বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছে। কারণ ওই বিচারক জানে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা প্রধান বিচারপতির নেই।
অ্যাটর্নী বলেন: আপনারা কেন এত শঙ্কাবোধ করছেন? শেষ হবে কেন? আজকে যদি মার্শাল ল প্রক্লেমেশন দ্বারা যেই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান করা হয়েছে। তা যদি রাখা হয় তা হবে ইতিহাসের বিরাট ভুল। প্রধান বিচারপতি বলেন এ ধরণের বক্তব্য দেয়া ঠিক না।
অ্যাটর্নী বলেন-আপনারা যে ধরণের বক্তব্য দিচ্ছেন তাতে আমার কাছে এটাই মনে হচ্ছে। এসময় বিচারপতি ইমান আলী বলেন: মার্শল ল যদি বাদ দেন তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন। তাহলে তো চতুর্থ সংশোধনীতে গিয়ে দাঁড়াতে হবে তাই নয় কি। প্রধান বিচারপতি বলেন: আমরা এখনও শুনছি। এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। জানার জন্য বুঝার জন্য শুনছি, প্রশ্ন করছি। তবে রাষ্ট্র যত ধরণের অসঙ্গতি থেকে এনেছে এগুলো থেকে আমরাই সেকিউ করেছি। এখনও রায় দিচ্ছি।
এরপর অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেন: পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টকে কিছু অভিমত নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছিল। কিন্তু ৯৬ অনুচ্ছেদের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ কোনো রিভিউ আবেদন করেনি। মর্ত সাপেক্ষে মার্জনা করেছে বলে রাষ্ট্রপক্ষ যা বলছে তা সঠিক না। রাষ্ট্রপক্ষ জুডিশিয়াল কাউন্সিল নিয়ে রিভিউই করেনি।
তিনি আরো বলেন, সুপ্রিম কোর্ট যখন কোরেনা রায়ে সিদ্ধান্ত দেয় সেই সিদ্ধান্ত বিলুপ্ত করে সংসদ কোনো আইন করতে পারে না। এই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের যে বিধান এটি ১৬কোটি জনগণ না হলেও ১০ কোটি লোক এর পক্ষে আছে।
এর আগে রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা বলেন : জাতীয সংসদের ওপর কেন এত অবিশ্বাস? তার কোনো উত্তর রায়ে কেউ দিতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা এই সংবিধান পেয়েছি। এই সংবিধানের মাধ্যমেই সংসদের সৃষ্টি। আর এ সংসদের প্রতি অবিশ্বাস, অনাস্থা আনা দুঃখজনক। তিনি আরো বলেন, বিচারক অপসনারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়ার ক্ষেত্রে বিচারকদের মধ্যে এত ভয় কেন? আপনারা শপথই নিয়েছেন ভয়-ভীতির উর্ধ্বে ওঠে বিচার করার জন্য। সংসদকে চ্যালেঞ্জ বা অপমান করার ক্ষমতা কারো নেই। বিচার বিভাগেরও নেই। সংসদকে অপমান করবেন না।
প্রধান বিচারপতি বলেন, কে অপমান করেছে বলুন। তখন মুরাদ রেজা বলেন, একজন বাদে সবাই। তারা তো আদালতের বন্ধু।
তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি কি এগুলো বলার জন্য এসেছেন? রিপ্লাই দেন। অমরা তো হিউম্যান বিং ভুল হতেই পারে।জন্যইতো লিখিত যুক্তিতর্ক দাখিল করতে বলেছি। সিনিয়র বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, অ্যামিকাস কিউরিরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেনি এটা বলা ঠিক না। তারা ভুল না ঠিক বলেছে সেটা আমরা দেখবো।