সোমবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭
প্রথম পাতা » » “উভয়সংকটে” পড়েছেন মিয়ানমার লেডি
“উভয়সংকটে” পড়েছেন মিয়ানমার লেডি
ল্যারি জ্যাগান, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৭
পক্ষকাল ডেস্কঃ
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর শুদ্ধি অভিযান থেকে জীবন বাঁচাতে গত তিন সপ্তাহে চাল লাখ মুসলিম রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ‘পোড়ামাটি নীতি’ অবলম্বন করছে। দেশটির অন্যান্য স্থানে বিদ্রোহ দমনের জন্য সেনাবাহিনী ষাট-এর দশক থেকে যে কুখ্যাত ‘ফোর কাট’ নীতি অনুসরণ করে আসছে রাখাইনের দমন অভিযান সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। এই নীতির মূল কথা হলো খাদ্য, অর্থ, তথ্য ও জনবল - এই চারটির সুযোগ বন্ধ করে দেয়া। রাখাইনে তিন হাজারের বেশি বাড়িঘর মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে বলে স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীদের সূত্রে জানা গেছে।আন্তর্জাতিক মহলের শোরগোল কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে: এর প্রতিবাদে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য মিশন বাতিল করেছে। অং সাং সু চি’র একসময়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র, বিশেষ করে তিনি যখন গৃহবন্দী ছিলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী সপ্তাহে রোহিঙ্গা ইস্যুটি জরুরিভিত্তিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উত্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে বাংলাদেশ সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সমস্যার পেছনে মূল কারণগুলো তুলে ধরবেন: পররাষ্ট্র মন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলি গত সপ্তাহে ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন যে “তিনি কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা অবিলম্বে বাস্তবায়নের জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানাবেন।” অন্য বিশ্ব নেতারাও জরুরি ভিত্তিতে কফি আনার কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সু চি আগামী সপ্তাহে শুরু হওয়া সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন না। তার বদলে মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। সরকারের মনোভাবের ভিত্তিতে কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা অনুসরণ করে কিভাবে রাখাইন পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায় সেদিকে মনযোগ দেবেন তিনি।
শুরু থেকেই নেত্রী এই কৌশল নিয়েছেন বলে সরকারের ভেতরের সূত্রগুলো উল্লেখ করলেও রাখাইনের নিরাপত্তা পরিস্থিতি তাকে সেদিকে এগুতে দিচ্ছে না। গত সপ্তাহের শেষ দিকে সু চির দফতর থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, “স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে বৈধ দায়িত্ব পালনকালে আচরণবিধি কঠোরভাবে মেনে চলা, সকল সঠিক সংযম প্রতিপালন করা এবং সমপার্শ্বিক ক্ষতি ও নিরপরাধ বেসামরিক লোকজনের ক্ষতি এড়িয়ে চলতে নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।”
তবে, রাখাইন রাজ্যে সমঝোতার ব্যাপারে সরকারের পথনকশা তুলে ধরে দু’একদিনের মধ্যে সু চি জাতির উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখবেন বলে সরকারি সূত্রগুলো জানিয়েছে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রাখাইন কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের জন্য দ্রুত একটি মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটির কাজে সহায়তার জন্য দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা বোর্ড গঠন করা হবে।
কিন্তু ইয়াংগুন-ভিত্তিক কূটনীতিক ও বিশেষকরা বলছেন যে, মিয়ানমার নেত্রী এখন উভয় সংকটে পড়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক সাউথ এশিয়ান মনিটরকে জানান যে, রাখাইন প্রশ্নে তার অবাধে কথা বলার পূর্ণ স্বাধীনতা নেই।” তার মতে, গুলি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কেবল সেনা কমান্ডার।
বিগত সামরিক সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার আগে যে সংবিধান রচনা করা হয় তাতে সেনাবাহিনী ও বেসামরিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির ব্যবস্থা রয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী পার্লামেন্টের উভয় কক্ষ এবং ১৪টি আঞ্চলিক সংসদে ২৫ শতাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত। তিনজন ভাইস প্রেসিডেন্টের একজন নিয়োগ করে সেনাবাহিনী। পুলিশসহ তিনটি মন্ত্রণালয় - সীমান্ত, স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা - থাকবে সেনাবাহিনীর হাতে।
হিউম্যান রাইট ওয়াচের আঞ্চলিক প্রধান ও দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের একজন পর্যবেক্ষক ফিল রবার্টসন বলেন, “শক্তির কেন্দ্র তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাতমাদো (মিয়ানমার সেনাবাহিনী) এবং স্থানীয় প্রশাসনে এর চাটুকাররা ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমক্রেসি’র মুখ্যমন্ত্রীদের চারপাশে একটি বৃত্ত তৈরি করে রেখেছে। ফলে নিজ ঘরেই তারা বন্দী এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফিতা কাটা ছাড়া তাদের তেমন কোন ক্ষমতা নেই।”
রাখাইনের ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে এই ঘটনাই ঘটছে। সেখানে স্থানীয় এনএলডি প্রশাসন সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ। আরাকান ন্যাশনাল পার্টির স্থানীয় রাজনীতিকরাও কট্টরপন্থী, এদের দৃষ্টিভঙ্গী পুরোপুরি মুসলিম বিরোধী। রাখাইন রাজ্যের স্থানীয় বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী আরো বেশি শত্রুভাবাপন্ন। তাদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বহু দশক ধরে সংঘাত চলছে। এরা রোহিঙ্গাদের বাঙ্গালি বলে উল্লেখ করে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এই বৈষম্যমূলক আচরণ স্বাধীনতার আগে থেকেই চলছে।
আসলে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পোড়ানো ও লুটপাটের কাজটি রাখাইনের বৌদ্ধ গ্রামবাসীরাই করছে। “শুদ্ধি অভিযানে” সেনাবাহিনী ও পলিশের সঙ্গে রয়েছে এরা।
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয় বলে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করে দেশটির বেশিরভাগ মানুষ। এদেরকে বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী বলে মনে করা হয়। যদিও বহু রোহিঙ্গা পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ওই অঞ্চলে বসবাস করছে।
তাই জনমতের বিবেচনায় এক অসম্ভব অবস্থানে গিয়ে পড়েছেন অং সাং সু চি। তিনি প্রকাশ্যে রাখাইনের মুসলমানদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করতে পারছেন না। এতে বামার নামে পরিচিত মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগত গোষ্ঠীগুলো ক্ষুব্ধ হতে পারে। গত বছর অক্টোবর এবং এ বছর আগস্টে আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারি আর্মি (এআরএসএ)’র হামলার পর ওই জাতিবিদ্বেষ আরো তীব্র হয়েছে।
আর সে কারণেই এই ইস্যুতে তিনি তার নৈতিক কর্তৃত্ব ব্যবহারের বদলে নিশ্চুপ থাকার পথ বেছে নেন। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে ২০১২ সালে প্রথম সহিংসতা শুরুর পর থেকেই তিনি এই কৌশল অবলম্বন করছেন। আর এখন সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তার জন্য পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে। নির্বাচনের পর থেকে দুই নেতাকে এক সঙ্গে কাজ করার পথ খুঁজতে হয়। সু চি’র রয়েছে জনসমর্থন, কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতে।
একজন সাবেক সিনিয়র সেনা অফিসার বলেন, “এনএলডি সরকারের একেবারের প্রথম দিন থেকে দুই প্রকৃত নেতা - নেত্রী ও জেনারেলের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট বোঝাপড়া চলে আসছে তারা কিভাবে একসঙ্গে কাজ করবেন সে বিষয়ে। এটা তাদের কার্যত নেতৃত্বের ব্যাপারে পারস্পরিক স্বীকৃতি: মিন অং হিলাইং নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আর বাকিসব বিষয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সু চি।”
সমস্যা হলো রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উভয়পক্ষের অভিন্ন উদ্বেগ নিয়ে আলোচনায় বসার মতো কোন ক্ষেত্র এই দুই নেতার সামনে নেই। জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদ (এনডিএসসি) একমাত্র আলোচনার জায়গা। কিন্তু সেখানে ১১ জন সদস্যের মধ্যে ছয়জনই সেনাবাহিনীর নিযুক্ত। গণতান্ত্রিক সরকারকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা এনডিএসসি’র রয়েছে। বর্তমান সুবিধাটুকু হারানোর ভয়ে এনডিএসসি’র বৈঠক ডাকতে সু চি ভয় পাচ্ছেন।
সরকারের সিনিয়র কর্মকর্তারা জানান, এনএলডি সরকারের আমলে একবারও এনডিএসসি’র বৈঠক ডাকা হয়নি। যদিও রাখাইনের ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দুটি বৈঠক হয়েছে - একটি গত অক্টোবরে, দ্বিতীয়টি এআরএসএ হামলার পর। এনডিএসসি’র বৈঠক আরেকটি কারণে সু চি ডাকছেন না। কারণ, সেনাপ্রধান হিলাইংয়ের মেয়াদ শিগগিরই শেষ হচ্ছে। তার মেয়াদ বৃদ্ধি’র ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার একমাত্র জায়গা এনডিএসসি। তিনি ২০২০ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে থাকতে চান। তাই সাময়িকভাবে হলেও সু চি এ নিয়ে কোন বিরোধে জড়াতে চান না বলে সরকারের ভেতরের সূত্রগুলো জানিয়েছে।