বুধবার, ২২ নভেম্বর ২০১৭
প্রথম পাতা » » দুর্নীতির রাহুগ্রাসে সরকারি, মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালীদের পছন্দের প্রার্থীরাই নিয়োগ পাচ্ছেন
দুর্নীতির রাহুগ্রাসে সরকারি, মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালীদের পছন্দের প্রার্থীরাই নিয়োগ পাচ্ছেন
পক্ষকাল ডেস্কঃ
খাদ্য অধিদপ্তরে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বিভিন্ন পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। নিয়োগের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্ন হলেও তিন বছর ধরে ঝুলে রয়েছে তার ফল। ফলে হাজারো চাকরিপ্রার্থী এখনও গুনছেন অপেক্ষার প্রহর। সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষও নিয়োগ আটকে থাকার সদুত্তর দিতে পারছে না। খাদ্য অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, আইনি জটিলতার কারণে এ নিয়োগ থমকে গেছে। তবে অপর একটি সূত্রে জানা গেছে, ওই মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তার পছন্দের প্রার্থীরা নিয়োগের চূড়ান্ত ফলাফলে না আসায় তা প্রকাশ করা হচ্ছে না। দোহাই দেওয়া হচ্ছে আইনি জটিলতার। শুধু এ প্রতিষ্ঠানেই নয়, বহু সরকারি অফিসে জনবল নিয়োগে চলছে যথেচ্ছাচার। ‘মনের মতো’ না হলে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। আর যেসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে, সেখানে রয়েছে দলীয়করণ ও আর্থিক বাণিজ্যের বিস্তর অভিযোগ। অবশ্য কিছু প্রতিষ্ঠানে ব্যতিক্রমও রয়েছে। আইনকানুন মেনেই সম্পন্ন হচ্ছে নিয়োগ প্রক্রিয়া। তবে এর সংখ্যা বেশি নয়।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারি বেশিরভাগ নিয়োগে অনিয়ম, ঘুষ আর দুর্নীতিতে বাদ পড়ছেন মেধাবীরা। প্রভাবশালীদের তদবিরের স্তূপ নিয়োগদানকারী কর্তৃপক্ষের টেবিলে। সংশ্নিষ্টরা জানান, মন্ত্রণালয় ও সংস্থায় নিয়োগ নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। এর বেশিরভাগ অভিযোগই দলীয়করণ ও আর্থিক বাণিজ্যের। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, নিয়োগ নিয়ে আদালতের শরণাপন্নও হতে হচ্ছে চাকরিপ্রত্যাশীদের। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম, স্বেচ্ছাচার বেশি। এমতাবস্থায় নিয়োগে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠনের দাবি জোরালো হয়ে উঠছে। যদিও মাঝেমধ্যে সচিব সভায় এ নিয়োগে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠন নিয়ে শুধু আলোচনা হয়। সংশ্নিষ্টরা মনে করেন, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠন করে তার অধীনে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে নানা ধরনের অভিযোগ কমে আসবে। প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়োগ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অধীনে হওয়ায় এখানে দুর্নীতির সুযোগ কম।
এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম সমকালকে বলেন, সচিব সভায় অনেক কিছু আলোচনা হলেও কার্যবিবরণীতে আসে না। তিনি বলেন, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি পদে নিয়োগে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠন কতটা বাস্তবসম্মত, তা দেখা প্রয়োজন। তবে এর বাইরে নিয়োগের পদ্ধতি শক্তিশালী করলে অভিযোগ কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন। এসব নিয়োগ প্রক্রিয়া যেন দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হয়, সে বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ থেকে বারবার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
এ ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলি খান সমকালকে বলেন, সরকারি চাকরিতে এ ধরনের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুধু দুর্নীতির বিস্তার ঘটাচ্ছে না, সমাজকে কলুষিতও করছে। ছোট বা বড়- যে চাকরিই হোক, যোগ্যতার ভিত্তিতে হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন। অন্যথায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের চাকরিপ্রত্যাশীদের অভিযোগ থেকে জানা গেছে, সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় প্রথম হয়েও চাকরি মিলছে না। মিলছে অর্থের বিনিময়ে। কোনো ক্ষেত্রে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্তার পছন্দসই লোক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব না হলে ওই নিয়োগ স্থগিত বা বাতিল করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, সরকারি চাকরিতে দলীয়করণ ও আর্থিক বাণিজ্যের প্রচলন শুরু হয় ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে। ওই সময় দলীয় নেতাকর্মীদের বেছে বেছে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এ সময় বিসিএসেও দলীয় কর্মীদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরও অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। কিন্তু এটি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর। ওই সময় দলীয় নেতাকর্মীদের দুটি বিসিএসে নিয়োগ দেওয়ায় পরে ওই নিয়োগ বাতিল করে আলোচনার জন্ম দেয়। বর্তমান সরকারের আমলেও ওই একই ধারা চলছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে কৌশল পরিবর্তন হয়েছে। চাকরি ক্ষেত্রে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে ঠিকই, তবে এর ভেতরেও রয়েছে কারসাজি। পছন্দসই কর্মকর্তা নিয়োগ দিতেই মৌখিক পরীক্ষা ৩০ নম্বর করে এক ধরনের কৌশল নেওয়া হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, পছন্দের প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় কম নম্বর পেলেও মৌখিক পরীক্ষায় পুরো নম্বর দিয়ে তার নিয়োগের পথ সুগম করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার এই মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর আড়াই লাখ শূন্য পদে নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে গত সাড়ে তিন বছরে প্রায় দেড় লাখ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বাকি এক লাখ পদে নিয়োগ দ্রুত সম্পন্ন হবে। বেশিরভাগ নিয়োগ নিয়েই চাকরিপ্রত্যাশীদের অভিযোগ রয়েছে। এমন একজন চাকরিপ্রার্থী কোবাদ হোসেন। যশোরের শার্শা উপজেলায় তার বাড়ি। তিনি সরকারি বিভিন্ন সংস্থায় একাধিকবার নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা- দুটোতেই ভালো করেছেন। লিখিত পরীক্ষার ফলে মেধাতালিকায় ছিলেন। কিন্তু অর্থ দিতে না পারা এবং কারও সুপারিশ না থাকায় চাকরি পাননি। তার সরকারি চাকরি লাভের বয়সসীমা বেশি দিন নেই। এই চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের লোকপ্রশাসন কেন্দ্রের নিচে এ প্রতিবেদকের দেখা হয়। তিনি একটি মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থার তৃতীয় শ্রেণি পদে লোক নিয়োগের ব্যবহারিক পরীক্ষা দিতে এসেছেন। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, এ সরকারের আমলে বিভিন্ন সংস্থার অধীনে প্রায় ২০টি নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন। প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো করার পরও তার চাকরি মেলেনি। শুধু কোবাদ হোসেনই নন, তার মতো চাকরিপ্রার্থী নীলফামারী থেকে আসা সুমনা ইসলাম, রিপন রায়; রংপুর থেকে আসা জহির উদ্দিন ও মামুন হোসেনও একই কথা বললেন এ প্রতিবেদককে।
খাদ্য অধিদপ্তর :খাদ্য অধিদপ্তরের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বিভিন্ন পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। সর্বশেষ দুটি পদে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এরই মধ্যে মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। এখনও এ নিয়োগ সম্পন্ন হয়নি। খাদ্য অধিদপ্তরের একটি সূত্রে জানা গেছে, ‘খাদ্য বিভাগীয় কর্মকর্তা এবং কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮৫’-এর আওতায় নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন হতো। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সংবিধান (পঞ্চম সংশোধন) আইন, ১৯৭৯ এবং সংবিধান (সপ্তম সংশোধন) আইন, ১৯৮৬ বাতিল হয়ে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল এবং ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত জারি করা নিয়োগ বিধিমালা বা অন্যান্য বিধিমালা অকার্যকর হয়ে যায়। ২০১৩ সালে ১৬৬টি অধ্যাদেশকে সংরক্ষণপূর্বক ওই সময়কালীন জারি করা বিধিমালাগুলোকে ২০১৩ নামে দুটি আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু ওই ১৬৬টি অধ্যাদেশের মধ্যে খাদ্য অধিদপ্তরের বর্ণিত নিয়োগ বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এ কারণে নিয়োগ আটকে যায়। অপর একটি সূত্র জানায়, সংশ্নিষ্টরা চাইলেই মাসখানেকের মধ্যে এ জটিলতা নিরসন করতে পারে। তাদের পছন্দের প্রার্থীরা নিয়োগের চূড়ান্ত ফলাফলে না আসায় তারা এ বিষয়ে উদাসীন। ইচ্ছা করে আইনের জটিলতার দোহাই দিয়ে এ নিয়োগ আটকে রাখা হয়েছে।
রেল :২০১৩ সালের শুরুতেই রেলের বিভিন্ন পদে সাড়ে সাত হাজার লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এর পর চার বছর অতিবাহিত হলেও এখনও রেলের কোনো পদেই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেনি সংশ্নিষ্ট বিভাগ। এর মধ্যে রেলেও অন্যান্য পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। গত বছর কিছু পদে নিয়োগ দিয়েও তা সম্পন্ন করতে পারেনি সংশ্নিষ্ট বিভাগ। কিছু পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। সূত্র জানায়, রেলে নিয়োগ না হওয়ার পেছনে কাজ করছে রাজনৈতিক প্রভাব। প্রতিটি পদের বিপরীতে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সাংসদসহ দলীয় নেতাকর্মীদের হাজার হাজার সুপারিশ রয়েছে। রেল বিভাগের ওয়েম্যান পদে নিয়োগে মন্ত্রী, এমপি ও দলীয় নেতাকর্মীদের সুপারিশ রয়েছে কয়েক হাজার। ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতিই তার প্যাডে একই পদের জন্য ৩৮ জনকে নিয়োগ দিতে সুপারিশ করেছেন। এর বাইরে রয়েছে নিয়োগ কমিটির সুপারিশ। এখন রেল বিভাগ এ পদে কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে, সে তালিকা তৈরি করতে পারছে না।
পুলিশ নিয়োগে অভিযোগ :বর্তমান সরকারের আমলে পুলিশের কনস্টেবল পদে নিয়োগ নিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। গত কয়েক বছরে কয়েক লাখ পুলিশ সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়। এ নিয়োগে বেশিরভাগ এমপি অভিযোগ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। তাদের অভিযোগ, জেলা পুলিশ সুপাররা নিজের মতো করে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। কোনো কোনো এমপি এই নিয়োগ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনও করেছেন। পুলিশের নিয়োগ সামনে আসছে। শিগগিরই এ ব্যাপারে সার্কুলার জারি হবে।
সরকারি হাসপাতাল :আইনি জটিলতার কারণে আটকে রয়েছে সরকারি হাসপাতালে ৩০ হাজার পদে নিয়োগ। জানা গেছে, উচ্চ আদালতের আদেশে সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল হওয়ার কারণেই নতুন করে জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া আটকে গেছে। উচ্চ আদালতের আদেশে সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল হওয়ার পরও ১৬৬টি অধ্যাদেশকে সংরক্ষণ করে ওই সময়কালে জারি করা বিধিমালাগুলোকে ২০১৩ নামে দুটি আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগীয় নন-মেডিকেল কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা ওই আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়নি বলেই আটকে রয়েছে এ নিয়োগ। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, সরকার চাইলে ১৬৬টির সঙ্গে আরেকটি অধ্যাদেশ সংরক্ষণ করে স্বাস্থ্য খাতে দ্রুত জনবল নিয়োগ করতে পারে। অন্যথায় আগামী পাঁচ বছরেও স্বাস্থ্য খাতে জনবল নিয়োগ সম্ভব হবে না।