বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর ২০১৭
প্রথম পাতা » রাজনীতি | সম্পাদক বলছি » মিয়ানমার ইস্যুতে বাংলাদেশে কমেছে চীনের জনপ্রিয়তা
মিয়ানমার ইস্যুতে বাংলাদেশে কমেছে চীনের জনপ্রিয়তা
আফসান চৌধুরী/পক্ষকাল ডেস্কঃ বাংলাদেশে চীনের জনপ্রিয়তায় অব্যাহতভাবে ভাটা পড়েছে। ভারতের প্রাধান্য-পরবর্তী বাংলাদেশে চীন কিছু সময়ের জন্য উষ্ণতা উপভোগ করতে শুরু করলেও তা পরিপূর্ণতা প্রাপ্তির আগেই থমকে গেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করায় দেশটির আগের জনপ্রিয় অবস্থান নড়ে গেছে।
চীন এসবকে তেমন একটা পরোয়া করে বলে মনে না হলেও ধারণা করা হচ্ছে, এখানে অজনপ্রিয়তার ভারসাম্যের একটি ব্যবস্থা সক্রিয় রয়েছে। এ থেকে ভারত সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাচ্ছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত চুপচাপ বসে আছে। তার ভূমিকা নিয়ে আগে যে অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হয়েছিল, এখন তা অনেকটা কম স্বার্থপরমূলক মনে হচ্ছে। বাংলাদেশের জনমতে এখন চীনকে অনেকটা ভারতের মতোই মনে হচ্ছে।
মনে হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে চীন ও ভারত উভয়েই অনিশ্চয়তায় ভুগছে। উভয় দেশই আধিপত্য বিস্তারের যুদ্ধে লিপ্ত। ভারতের সবচেয়ে অসুবিধা হলো তার ঐতিহাসিক রেকর্ড। এই অঞ্চলের ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি তার আচরণ ইতিবাচক নয়। জনগণ পর্যায়ে কার্যক্রম, বাণিজ্য ও সংস্কৃতি অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও ভারতের প্রতি ক্ষোভ দীর্ঘ দিন ধরেই রয়েছে।
এই নতুন সমীকরণ থেকে সবচেয়ে বেশি ফায়দা হাসিল করেছে চীন। এই অঞ্চলের ছোট ছোট অর্থনীতির প্রবল প্রয়োজন মেটাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নিয়ে এখানে প্রবেশ করেছে চীন। ভারতের ক্ষীণদর্শী অবস্থানের ফলে চীনকে স্বাগত জানানোর পরিবেশ আগে থেকেই তৈরি ছিল। তাদেরকে বরণ করে নেওয়া হয়, বিশেষ করে বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায়।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষায় ‘১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সবচেয়ে কঠিন সময়ে’ বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে চীন দৃঢ়ভাবে মিয়ানমারের পাশে দাঁড়ানোতে বাংলাদেশে চীনা জনসমর্থন দ্রুত কমে গেছে। বাংলাদেশের কঠিন সময়টাতেই চীন অনুপস্থিত। তার মিত্র মিয়ানমার। ফলে রোহিঙ্গা ঘটনার আগে চীনের প্রতি যে সমর্থন ছিল তা হ্রাস পেয়েছে।
ভারতের অবস্থানটি অনেক দিনের হিসাব-নিকাষে গড়ে ওঠলেও চীন এই পথে এসেছে সম্প্রতি। সে মিয়ানমারের সর্বোত্তম রক্ষাকারী এবং মিয়ানমার হলো রোহিঙ্গা ঘটনায় ভিলেন। ভারতকেও মিয়ানমারের সমর্থক মনে হয়েছে। তবে ভারতকে কিছু কম ‘বিশ্বাসঘাতক’ বিবেচনা করার কারণ হলো মিয়ানমারে দেশটির প্রভাব খুব বেশি নয়। এই বিষয়টি মিয়ানমারের সর্বোত্তম মিত্র চীনের অনুকূলে কাজ করছে না।
আঞ্চলিক বন্ধু ও শত্রু
মিয়ানমারের তুলনায় কোনো দেশই বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় মিত্র ভাবছে না। কেউই রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসবাদী হুমকির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ না করায় বেশির ভাগই মনে করছে, সবই ধরে নিয়েছে ‘ঐতিহাসিক শত্রুদের’ স্রেফ ছুঁড়ে ফেলে নতুন বন্ধু জোটানোর ভালো সময় এটাই।
নতুন মিত্র সন্ধানসহ ওই প্রক্রিয়ায় একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অনুকূলে কয়েক কদম এগিয়ে আছে।
মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ এখন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিত্রতা নিয়ে কথা বলছে কম। উল্লেখ্য, আমেরিকার আইএস সমস্যা যখন শুরু হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় বাংলাদেশ সরকার ছিল অখুশি। কারণ দেশটি বলেছিল, বাংলাদেশে বড় আকারে সমস্যাটি আছে। বাংলাদেশ ওই দাবি অস্বীকার করে বলেছিল, গুটিকতেক আইএস কর্মী থাকলেও থাকতে পারে। বেশির ভাগ জেহাদিই দেশীয়, তারা জেএমবির মতো স্থানীয় দলের পরিচালিত।
বাংলাদেশ আইএস আছে ধরনের গবেষণাকে সমর্থন করতে বা সে যুক্তিকে জোর দিতে যুক্তরাষ্ট্র বেশ ভালো পরিমাণে অর্থ ব্যয় করেছে। কিন্তু শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে অনড় ভূমিকা গ্রহণ করেন, সব গবেষণা এবং গবেষকদের ছুঁড়ে ফেলে দেন।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ইতিবাচক খবর তৈরি করেছে। এসব খবরের সবই বাংলাদেশের পক্ষে। অন্যদিকে পাশ্চাত্যের উদারবাদীদের মধ্যে অং সান সু চির প্রতি নমনীয়তা অনেক। মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করার ইচ্ছা ভারতীয় ও চীনা মহলের চেয়ে ইউরোপের মধ্যে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও কানাডার বেশ কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করে প্রকাশ্যেই প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি সমর্থন প্রকাশ করেছেন। মিয়ানমারে পাশ্চাত্যের স্বার্থ কম থাকায় তাদের পক্ষে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব। চীনের পক্ষে তা সম্ভব নয়। ভারতের পক্ষেও নয়, যদিও তাদের সম্পৃক্ততা অনেক কম।
এটা রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিরাট কোনো পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলবে বিষয়টি তেমন নয়, কিংবা সাবেক সমাজতন্ত্রী শিবিরের বিরুদ্ধে পুরনো পাশ্চাত্যের মধ্যে ‘স্নায়ুযুদ্ধ’ সৃষ্টি করবে, তা-ও নয়। তবে এটা পরিষ্কার, ছয় মাস আগেও যেমন ছিল, এখন অবস্থা তার চেয়ে অনেক নমনীয়।
চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত এবং বিনিয়োগে পাশ্চাত্য বেশ উদ্বিগ্ন থাকলেও রোহিঙ্গা ইস্যু তাদেরকে নৈতিক অজুহাত হিসেবে উঁচু গলায় কথা বলার সুযোগ এনে দিয়েছে। বাণিজ্য যুদ্ধ নামক কেকের ওপর এটা চিনির একটি আবরণ। প্রকৃতপক্ষে এটা হলো চীনের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের একটি উদ্যোগ। চীন অবশ্য এটা পছন্দ করবে না।
ভারত কোনোটার পক্ষেই নেই। সে পাশ্চাত্যের দৃঢ় মিত্র। ভারত বিস্তৃত পরিসরে নানা বক্তব্যের মধ্যে নিজেকে আড়াল করতে পারে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন-পাশ্চাত্য নতুন সমীকরণের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, সেটা ভিন্ন বিষয়। তবে দক্ষিণ এশিয়ার ভারতীয় ড্রাগনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নতুন যোদ্ধা হিসেবে চীনের ভাবমূর্তি অনেকাংশেই কালিমালিপ্ত হয়েছে।