শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭
প্রথম পাতা » ব্রেকিং নিউজ | রাজনীতি » প্রশাসনের পদোন্নতিতে এবার কচুকাটা হয়েছে প্রতিমন্ত্রীর দফতরে
প্রশাসনের পদোন্নতিতে এবার কচুকাটা হয়েছে প্রতিমন্ত্রীর দফতরে
পক্ষকাল ডেস্ক ঃ
গত ১১ ডিসেম্বর সোমবার ১৩৩জন যুগ্মসচিবকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এদের ১২৮ জনের প্রজ্ঞাপন একসঙ্গে জারি হয়েছে। এছাড়া যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত দু’জন কর্মকর্তার প্রজ্ঞাপন ওইদিনই আলাদাভাবে জারি করা হয়েছে। পরের দিন অর্থাৎ ১২ ডিসেম্বর আলাদা প্রজ্ঞাপনে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সদস্য মো. ইয়াকুব আলী পাটোয়ারীকে পদোন্নতি দেয়া হয়। বাকি দু’জন কর্মকর্তা সরকারের বাইরে লিয়েনে কর্মরত থাকায় তাদের প্রজ্ঞাপন পরবর্তীতে জারি করা হবে। পদোন্নতি পাওয়া এই কর্মকর্তাদের মধ্যে ৭৮ জন ছিলেন লেফট আউট, অর্থাৎ অতীতে এদেরকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করা হয়েছিল। কিন্তু, এবারও পদোন্নতি থেকে বাদ পড়েছেন শুধু প্রশাসন ক্যাডারেরই ২৫৫ জন কর্মকর্তা, যাদের অধিকাংশই যোগ্য, দক্ষ এবং বাদ দেয়ার যৌক্তিক কোনও কারণ নেই। এছাড়া অন্যান্য ক্যাডারসহ মোট বঞ্চিতের সংখ্যা তিনশ’রও বেশি। যারফলে ব্যাপক ক্ষোভ-অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে গোটা প্রশাসনেই।সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, এবারের পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরুর আগে প্রধানমন্ত্রী যে দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন সেটি পরে আর কার্যকর করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছিলেন ‘লিবারেল’ দৃষ্টিতে দেখার জন্য। এতে পদোন্নতির যোগ্য অধিকাংশ কর্মকর্তার পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি হতো এবং বঞ্চিতের সংখ্যা কমে আসতো। প্রশাসনে স্বস্তি ফিরে আসার সুযোগ তৈরি হতো, যা সার্বিকভাবে গোটা সরকারের জন্যই মঙ্গলজনক হতো। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী পদোন্নতির সুপারিশও তৈরি করেছিল এসএসবি (সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড)। কিন্তু সম্ভব হয়নি প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক’র অবৈধ হস্তক্ষেপের কারণে। তিনি এসএসবির সুপারিশের ফাইলটি তার দফতরে গোটা ১ মাস ২ দিন আটকে রাখেন। এসএসবির সুপারিশের ওপর ব্যাপকভাবে কাটাকাটি করেন, অনেকটা কচুকাটার মতো করে। যদিও নিয়ম অনুযায়ী এটা তিনি করতে পারেন না।
জনপ্রশাসনের এবারের পদোন্নতিতে এমন কুচকাটা করা নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এই ক্ষোভকে আড়াল করতেই কৌশলে পুরো দোষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। প্রতিমন্ত্রীর দফতর থেকে আন অফিসিয়াল সংবাদ মাধ্যমকে বলা হচ্ছে, গত মাসে এসএসবির সুপারিশ চূড়ান্ত করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হলে তিনি অনুমোদন না করে আরও খতিয়ে দেখার জন্য ‘কিছু পর্যবেক্ষণসহ’ ফাইল ফেরত পাঠান। আর এ কারণেই নাকি পদোন্নতিতে বিলম্ব হয়েছে।
অথচ ইতিপূর্বে এ সংক্রান্ত ফাইল প্রধানমন্ত্রীর কাছে আদৌ পাঠানোই হয়নি। ফাইলটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়েই ছিল। যা কিছু ঘটেছে সব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়েই। জানা গেছে, এই সব কিছুরই নাটের গুরু, প্রতিমন্ত্রীর পিএস মো. শাহ্রিয়ার কাদের ছিদ্দিকী। প্রশাসনের ১১ তম ব্যাচের জুনিয়র এই কর্মকতাই নেতৃত্ব দিয়েছেন এসএসবির সুপারিশের উপর কুচকাটায়। যিনি বিগত বিএনপি-জামায়াত আমলের সুবিধাভোগী এবং জামায়াতপন্থি কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী অতিরিক্ত সচিব পদে এই পদোন্নতির জন্য গত ১১ সেপ্টেম্বর প্রথম এসএসবির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় পৌনে দু’মাস ধরে বেশ কয়েক দফায় বৈঠক ও পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করে এসএসবি সর্বসম্মতভাবে ১৭২ জন কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির সুপারিশ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য তৈরি করা এই সুপারিশ গত ২ নভেম্বর প্রতিমন্ত্রীর দফতরে দেয়া হয়। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী এ সংক্রান্ত ফাইলটি প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য না পাঠিয়ে নিজের কাছেই আটকে রাখেন। এসএসবির সুপারিশ থেকে অনেক কর্মকর্তার নাম বাদ দেন। আবার নিজের পছন্দের কিছু কর্মকর্তার নামও অন্তর্ভুক্ত করেন। কাটাকাটি শেষে প্রতিমন্ত্রী দক্ষিণ কোরিয়া সফরে যাওয়ার আগে গত ৪ ডিসেম্বর ফাইলটি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছে পাঠান। মন্ত্রীর দফতরেও কিছু নাম যোগ-বিয়োগ হয়। পুরো এক সপ্তা থাকে মন্ত্রীর দফতরে।
জানা গেছে, এসএসবি ১৭২ জন কর্মকর্তার নাম সুপারিশ করা ছাড়াও আরো ১৯ জন কর্মকর্তার একটি তালিকা তৈরি করেছিল প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বিবেচনার জন্য। অর্থাৎ এসএসবির বিবেচনায় মোট কর্মকর্তার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১৯১ জন। কিন্তু জানা গেছে, ওই ১৯ জনের কাউকে নতুনভাবে বিবেচনা করা হয়নি। এদের তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানোই হয়নি। উল্টো ১৭২ জন কর্মকর্তার মধ্য থেকেও প্রায় ৮০ জন কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে তাদের স্থলে নতুন কিছু নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যোগ-বিয়োগের পর অবশেষে ১৩ত জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতির সিদ্ধান্ত দেন প্রতিমন্ত্রী এবং মন্ত্রী। গত ১০ ডিসেম্বর সকালে ফাইলটি এসএসবির কাছে পাঠানো হয় এ অনুযায়ী নতুন করে সুপারিশ তৈরির জন্য। ওইদিন সকালে এসএসবির জরুরি বৈঠক ডাকা হয়। নতুন সুপারিশে এসএসবি সদস্যদের অনুমোদন নেয়া হয়। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী স্বাক্ষরের পর তা পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। পরদিন সকালে প্যারিস যাবার আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদোন্নতির ফাইলে অনুমোদন দেন এবং দুপুরের মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি হয়।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদোন্নতির ফাইলটি একদিন অর্থাৎ পুরো চব্বিশ ঘণ্টাও ছিল না। অথচ এমন কথা প্রচার করা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে ইতিপূর্বে আরও একবার এসএসবির এই সুপারিশ পাঠানো হয়েছিল। তিনি পুনরায় খতিয়ে দেখার জন্য নাকি নির্দেশ দিয়েছেন। আর সেই কারণেই কাটাছেঁড়া এবং বিলম্ব হয়েছে। আদতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ইতিপূর্বে ফাইল পাঠানোই হয়নি। বরং যতোটা জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী এবার কিছুটা ‘লিবারেল’ অর্থাৎ অধিক সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতির সুযোগ দেয়ার পক্ষে ছিলেন। তাঁরই নির্দেশনা অনুসরণ করে এসএসবি দীর্ঘ পৌনে দুই মাস বৈঠক ও আলোচনা-পর্যালোচনা করে ১৭২ জন কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির সুপারিশ তৈরি করেছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, প্রশাসনে পদোন্নতির বিষয়ে সর্বোচ্চ বডি এসএসবি। এসএসবির সুপারিশে দ্বিমত পোষণ অর্থাৎ নাম যোগ-বিয়োগ করতে পারেন একমাত্র প্রধানমন্ত্রী। জনপ্রশাসনের ইতিহাসে এবার নতুন নজির স্থাপন করেছেন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক। তিনি যেভাবে ফাইলটি আটকে রেখে কাটাছেঁড়া করেছেন অতীতে কখনও এমনটি দেখা যায়নি জনপ্রশাসনে।
জানা গেছে, এসব কাটাকাটিতে মূল ভূমিকা রেখেছেন প্রতিমন্ত্রীর পিএস মো. শাহ্রিয়ার কাদের ছিদ্দিকী। তিনিই মূলত প্রতিমন্ত্রীকে দিয়ে ফাইলটি ১ মাস ২দিন এই দফতরে আটকে রাখেন। এসময় জনপ্রশাসন কেন্দ্রীক পুরনো চিহ্নিত তদবিরবাজরা মোটা অংকের অর্থ নিয়ে প্রতিমন্ত্রীর দফতরে ভীড় করে। যারা মাধ্যম ধরতে পারেননি অর্থাৎ প্রতিমন্ত্রীর দফতরে তদবির করতে পারেননি মূলত তারাই এবার পদোন্নতি থেকে বাদ পড়েছেন। অন্যদিকে প্রতিমন্ত্রীর দফতরকে ম্যানেজ করে বিএনপি-জামায়াতের অনেক চিহ্নিত কর্মকর্তাই পদোন্নতি বাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন, যারা ওই সময় প্রশাসনে প্রভাবশালী বা ডাকসাইটে বলে পরিচিত ছিলেন। এরমধ্যে বিএনপি আমলে প্রভাবশালী মন্ত্রীদের পিএস পদে কাজ করেছেন এমন কর্মকর্তাও কয়েকজন রয়েছেন। এছাড়া দুর্নীতিবাজ ও বিত্তশালী কর্মকর্তারা এবার অনেকেই পার পেয়ে গেছেন। অথচ, বাদ পড়েছেন অনেক নিরীহ কর্মকর্তা- যারা প্রশাসনে যোগ্য, সৎ, দক্ষ কর্মকর্তা বলে পরিচিত।
উল্লেখ্য, প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক এর বর্তমান একান্ত সচিব শাহ্রিয়ার কাদের ছিদ্দিকী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে জামায়াত সমর্থক বলে পরিচিত ছিলেন। তিনি বিগত বিএনপি-জামায়াত আমলে প্রায় পুরো দু’বছর জনপ্রশাসন (তৎকালীন সংস্থাপন) মন্ত্রণালয়ের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ এপিডি উইং-এ দায়িত্ব পালন করেছেন। যদিও তিনি ঊর্ধ্বতন নিয়োগ-২ শাখায় কর্মরত ছিলেন, তখনকার দলাদলিতে তারও কিছুটা ভূমিকা ছিল। এসবের পুরষ্কার হিসেবেই ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে কুয়েতস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রথম সচিব পদে পোস্টিং পান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইতিবাচক মনোভাবের কারণে এবারের পদোন্নতিকে ঘিরে জনপ্রশাসনে এমন একটা আশার সঞ্চার হয়েছিল যে, এতে প্রশাসনে ইতিবাচক ধারার সূত্রপাত ঘটবে। বঞ্চিতের সংখ্যা অনেকটাই কমে আসবে, অস্থিরতা কমবে এবং প্রশাসন গতি পাবে। কিন্তু সেটি আর সম্ভব হয়ে উঠেনি। এবারের পদোন্নতির ফাইলে কী ঘটেছে তা অনেক কর্মকর্তাই জানেন। বিশেষ করে যারা পদোন্নতি থেকে বাদ পড়েছেন এরা মোটামুটি সবাই জানেন এবং তারা ক্ষুব্ধ। তাদের সঙ্গে অন্য সাধারণ কর্মকর্তারাও প্রতিমন্ত্রীর দফতরের এমন কর্মকা-ে ক্ষুব্ধ। এই পরিস্থিতিকে আড়াল করার জন্যই মূলত ১১ ডিসেম্বর পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর প্রতিমন্ত্রীর দফতর থেকে আন-অফিসিয়ালি সাংবাদিকদের একটি ব্রিফিং দেয়া হয়। ব্রিফিংয়ে সব দোষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়।
এবার যারা পদোন্নতি পেয়েছেন তাদের মধ্যে বিসিএস ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের একজন, ১৯৮৪ ব্যাচের ১৩ জন, ১৯৮৫ ব্যাচের ৩২ জন, ১৯৮৬ ব্যাচের ২৫ জন এবং নিয়মিত ব্যাচ হিসেবে নবম ব্যাচের ৪২ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। এ ছাড়া প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে অন্যান্য ক্যাডার থেকে ১৭ জনকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এই পদোন্নতিপ্রাপ্তদের মধ্যে ৭৮ জন কর্মকর্তা রয়েছেন, যাদের প্রয়োজনীয় সকল যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নানা কারণে এর আগে একাধিকবার বঞ্চিত হয়েছিলেন।