সোমবার, ৮ জানুয়ারী ২০১৮
প্রথম পাতা » তথ্য-প্রযুক্তি | ব্রেকিং নিউজ | রাজনীতি | শিক্ষা ও ক্যারিয়ার | সম্পাদক বলছি » ভয়াবহ তথ্যঃ ভারতের স্কুলেও ভয়ংকর ইসলামবিদ্বেষ
ভয়াবহ তথ্যঃ ভারতের স্কুলেও ভয়ংকর ইসলামবিদ্বেষ
পক্ষকাল ডেস্কঃ
ইউরোপে এক বোমা বিস্ফোরণের সংবাদ ভারতের উত্তর প্রদেশের নয়ডার একটি স্কুলের শিক্ষক পত্রিকা থেকে তার ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পড়ে শোনাচ্ছিলেন। এরইমধ্যে ক্লাসের একমাত্র মুসলিম ছাত্র সাদকে* লক্ষ্য করে অপর এক শিক্ষার্থী বলে ওঠে- ‘সাদ! ইয়েহ কিয়া কার দিয়া তুমনে?’ (সাদ তোমরা এ কী করেছ?)। এমন কথা শোনার পর শিক্ষক একটা কথাও বলেননি।গত দুই দশক ধরে বিভিন্ন স্থানে চরমপন্থী মুসলিমদের হামলা ও পশ্চিম এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের সময় থেকে সাধারণ মুসলিমদের এমনই অপবাদ শুনতে হচ্ছে ভারতজুড়ে। এছাড়া ধর্মীয় সহিংসতা, বাবরি মসজিদ বিতর্ক, মুম্বাই দাঙ্গা, সন্ত্রাসী হামলা ও বিভক্ত রাজনীতি মুসলিমবিদ্বেষ আরো উস্কে দিয়েছে।
পাঠ্যবইয়ে বৈচিত্র্যের মধ্যে একতার কথা বলা হলেও এই বিতর্কের উর্ধ্বে থাকেনি ভারতের স্কুলগুলোও। যেখানে বয়োঃজ্যেষ্ঠ মুসলিমদেরই ইসলামবিদ্বেষের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে, সেখানে এই পরিবেশে মুসলিম শিশুরা কীভাবে বেড়ে উঠছে?
এই বিষয়টিই ভারতীয় লেখক নাজিয়া এরুম তুলে ধরেছেন তার ‘মাদারিং অ্যা মুসলিম’ বইতে। ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিম হিসেবে বেড়ে ওঠার যে উভয় সংকট- তা-ই তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। পাঁচ বছরেরও কম বয়সী শিশুদের সেখানে বিবেচনা করা হয় ধর্মীয় পরিচয়ে।
২০১৪ সালে মেয়ে মাইরার জন্মের পরই বইটি লেখার সিদ্ধান্ত নেন নাজিয়া। সে সময়ে ভারতে চলছিল নির্বাচনী প্রচারণা। ইসলামবিদ্বেষের ব্যাপারে ভারতের মুসলিম মায়েদের কাছ থেকে তথ্য নিয়েছেন লেখিকা।
তিনি তার বইয়ে তুলে ধরেছেন, কীভাবে হেয় করার জন্য বিভিন্ন নামে ডাকা হয় মুসলিম শিক্ষার্থীদের। নাজিয়া লিখেছেন- ‘বাগদাদি, পাকিস্তানি, বাংলাদেশি, ওসামা, আইসিস- মুসলিম শিক্ষার্থীদের এসব নামে ডাকে সহপাঠিরা। তারা প্রশ্ন করে, তোমার মা-বাবা কি বোমা বানাতে পারে? তোমার বাবা কি বন্দুক দিয়ে আমাকে হত্যা করতে পারবে।’
নাজিয়া আরো লিখেছেন, ‘এটা শুধু শিশুদের ক্ষেত্রেই না- আমরা নিজের প্রতি যা করছি, এটা তার প্রতিফলন। যাদের প্রতি কাজটি করা হচ্ছে, শুধু তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না; যারা কাজটি করছে, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
শুধু ভারতের স্কুলগুলোতেই নয়, মুসলিম শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রেও একই সমস্যার শিকার। ২০১৭ সালের মার্চে মার্কিন এক সমাজ গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশটির ৪২ শতাংশ মুসলিম শিশুই ধর্মীয় কারণে হেয় প্রতিপন্ন হয়। তাদের বাজে নামে ডাকা হয়। এমনকী শারীরিকভাবে আক্রমণের শিকার হয় তারা। প্রতি চার অভিভাবকের একজন জানান, এমন ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকে খোদ শিক্ষক ও স্কুল প্রশাসন।
২০১৭ সালের অক্টোবরে আরেক জরিপে দেখা যায়, ধর্মের কারণে বিদ্বেষের শিকার হওয়া মুসলিম শিক্ষার্থীর হার ৫৭ শতাংশ।
নাজিয়ার বইয়ে আয়েশা* নামের এক শিক্ষার্থীর উদাহরণ তুলে ধরে বলা হয়েছে- ‘২০১৫ সালে দিল্লির একটি নামকরা স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হয় আয়েশা। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের বার্ষিকীকে কেন্দ্র করে একটি ক্লাসরুম সাজানোর দায়িত্ব পড়ে তার ওপর। সাজাতে গিয়ে পাকিস্তানের একটি পতাকা কাটতে হয়। তার প্রতি বিদ্রূপ করে এক শিক্ষার্থী বলে ওঠে, ওহ! নিজের দেশের পতাকা কেটে ফেললে?’
বর্তমানে একাদশ শ্রেণীতে পড়ুয়া আয়েশা জানায়, প্রথমে সে বিষয়টি বুঝে উঠতে পারেনি। পরে বুঝতে পারলো, ওই শিক্ষার্থী তাকে পাকিস্তানি বলে উপহাস করেছে।
আয়েশার মা নাজরিন* বলেন, ‘আমি উদ্বিগ্ন। সত্তর ও আশির দশকে পূর্ব-ভারতে বেড়ে উঠেছি। দিল্লির কলেজে পড়েছি। কখনো মনে হয়নি, এই দেশ আমার না।’
মুসলিমবিদ্বেষের এমন ঘটনা ভারতে একদিনেই জন্ম নেয়নি। এ বিষয়ে দিল্লির বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় জামেয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়ার অধ্যাপক জনকি রাজন বলেন, ‘মুসলিমবিরোধী এই মনোভাব ভারতভাগের সময় থেকেই চলে আসছে। ৩০ বছর ধরে স্কুলশিশুদের নিয়ে গবেষণা করা এই অধ্যাপক বলেন, ‘যারা সেই সময়ের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখেছে, তারা এখনো বেঁচে আছে। তারা তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সেই চেতনা উস্কে দিয়ে যাচ্ছে।’
এর কারণ হিসেবে অভিভাবকরা জানান, গণমাধ্যমগুলোতে পশ্চিম এশীয় মুসলিমদের সন্ত্রাসী হিসেবে উপস্থাপন করে ২৪ ঘণ্টা স্পর্শকাতর সংবাদ যাচ্ছে, সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে মুসলিম শিশুরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
দিল্লির সেন্ট মেরি স্কুলের অধ্যক্ষ অ্যানি কোশি বলেন, ‘শিশুরা সমাজে বড়দের যা করতে দেখে, যা শোনে, তা-ই তাদের আচরণে ফুটিয়ে তোলে। ইন্দো-পাকিস্তান সীমান্ত, গোরক্ষা ও তিন তালাকের মতো ইস্যুগুলোতে অবস্থা এমন হয়েছে যে আপনি মুসলিম মানে আপনি পাকিস্তানি।’
কোনো কোনো স্কুল এমন ঘটনার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই এসব ঘটনা আবার প্রশাসনের নজরে আসে না।