সোমবার, ১৫ জানুয়ারী ২০১৮
প্রথম পাতা » ব্রেকিং নিউজ | রাজনীতি » প্রথম রাউন্ডে জিতেছে হেফাজত, হটেছে তাবলীগ
প্রথম রাউন্ডে জিতেছে হেফাজত, হটেছে তাবলীগ
পক্ষকাল ডেস্কঃ
প্রতিবছর ঢাকার উপকণ্ঠে তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় সমাবেশ - বিশ্বইজতেমা। বিপুল সংখ্যক মুসল্লির উপস্থিতি, জনসমাগমের কারণে যানজট ও গোটা মুসলিম বিশ্ব থেকে খ্যাতনামা বক্তাদের আগমনের কারণে এই ইজতেমা বিখ্যাত হয়ে আছে। কিন্তু এ বছরের ইজতেমা স্মরণীয় হয়ে থাকবে তাবলীগ জামাতের আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় সংগঠকদের সঙ্গে বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সংঘাতের কারণে। বাংলাদেশে কওমী মাদ্রাসা ব্যবস্থা পরিচালনা করে এই হেফাজত।
ইজতেমা উপলক্ষ্যে কওমী মাদ্রাসার কট্টর সমালোচক হিসেবে পরিচিত ভারতের মওলানা সাদের আগমন নিয়ে এই বিরোধ। ফলে বিক্ষোভে নেমে পড়ে হেফাজত, যাতে সৃষ্টি হয় গুরুতর যানজট। আর সাদ আটকা পড়েন একটি মসজিদে। ফলে শেষ পর্যন্ত তাবলীগ জামাতের নেতারা তার বয়ান বাতিল করে তাকে বাংলাদেশ থেকে বিদায় দিতে বাধ্য হন। এটা ছিলো বাংলাদেশের সরকারি দল সমর্থিত সংগঠনটির ক্ষমতার একটি প্রদর্শনী, বুঝা যায় আওয়ামী লীগও ভালোভাবে বন্ধু নির্বাচন করতে পেরেছে।
কি নিয়ে দ্বন্দ্ব?
বেশিরভাগ মানুষের কাছে ইজতেমা হলো নিজের ধর্মীয় পরিচয় তুলে ধরতে ইচ্ছুক এমন লোকজনের অংশগ্রহণে একটি পবিত্র সমাবেশ। সারা দেশ থেকে যারা ইজতেমায় যোগ দিতে আসেন তারা প্রধানত গ্রামীণ এলাকার নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। ইজতেমা মাঠে পৌছাতে অনেক ধকল সইতে হয় তাদের। গত দু’বছর ধরে তাবলীগের সংগঠক ও হেফাজতের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। প্রথমটির সংগঠকদের বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক, আরে পরেরটি একটি নিখাঁদ বাংলাদেশী সংগঠন। এবছর ওই দ্বন্দ্বের প্রকাশ্য বিস্ফোরণ ঘটেছে। এবং স্থানীয় মওলানারা লড়াইয়ে জিতেছেন।
ভারতের মওলানা সাদ শুধু কওমী মাদ্রাসা ব্যবস্থারই বিরোধী নন, তিনি যেকোন ধর্মীয় কার্য সম্পাদনে কোন ধরনের অর্থ সাহায্য প্রদানের বিরুদ্ধে অবমাননাকর ভাষায় অনেক লেখালেখিও করেছেন। তিনি সরাসরি কওমী মাদ্রাসাকে আক্রমণ করে কথা বলেন। যা কওমী ব্যবস্থা থেকে আসা হেফাজতকে মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ করেছে। অনেক দাতব্য ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে হেফাজত জড়িত। তাই, বলতে হবে তাবলীগ জামাতই প্রথম গুলিটি ছুড়েছে, আর পাল্টা আঘাত হেনেছে হেফাজত। সংঘাত সড়কে ছড়িয়ে পড়ার উপক্রম হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে আপাত শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতীয় মওলানা বয়ান দেবেন না বলে রাজি হন, আর হেফাজত তার বিক্ষোভ প্রত্যাহার করে নেয়।
কওমী মাদ্রাসার রাজনৈতিক অর্থনীতি
হেফাজত একটি পেশাদারীদের সংগঠন এবং তারা মসজিদভিত্তিক সেবা দিয়ে থাকে। অন্যদিকে, মওলানা সাদ ঘোষণা করেন যে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে অর্থপ্রদান ‘বেশ্যাকে মজুরি’ প্রদানের সামিল। অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে ধর্মীয় দলগুলোর এমন সব কর্মকাণ্ডকে সাদ-এর ওই বক্তব্যের ব্যাখ্যায় আওতায় নিয়ে আসা হয়। এই ফতোয়ার ফলে ধর্মীয় অর্থনৈতিক খাতের গ্রামীণ মসজিদভিত্তিক মৌলভীদের প্রচলিত আয়ের উৎসগুলো সম্পূর্ণরূপে বন্ধের উপক্রম হয়। তাই টিকে থাকার জন্য ভয়ংকরভাবে ওই ফতোয়ার বিরোধিতা করা ছাড়া হেফাজতের আর কোন উপায় ছিলো না।
আরো খোলাসা করে বলতে গেলে, এটা মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক ইসলামের সঙ্গে বাংলাদেশের ইসলামের পার্থক্য। মধ্যপ্রাচ্যের সমাজে ধর্মতত্ত্ববিদরা অর্থনৈতিকভাবে নির্ভর করেন সরকারি অনুদানের ওপর। অন্যদিকে বাংলাদেশে এরা কৃষিজীবী সমাজ ও তাদের সাংস্কৃতিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশে মসজিদভিত্তিক কওমী মাদ্রাসার বিকাশ ঐতিহাসিকভাবে অনেক বেশি প্রমাণসিদ্ধ। এখানে ধর্মপ্রচারক ও ধর্মবেত্তাগণ সবসময় দাতব্যের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন এবং বেসরকারি উৎস থেকে সমাজ তাদেরকে সহায়তা দিয়ে গেছে। দূর অতীত থেকে এই অনুশীলন চলে আসছে এবং এতে কোনরকম মাতবরী সবসময় সমস্যা সৃষ্টি করেছে। এমনকি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা প্রথম দিকে যখন জীবন-জীবিকার এই উৎসগুলো বন্ধের উদ্যোগ নেয় তাদেরকেও ফকির-সন্যাসীদের কাছ থেকে প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখিন হতে হয়েছে।
ইতিহাসের ওই ধারা বজায় রেখেছে বাংলা ও বর্তমান বাংলাদেশ এবং ১৯৭১ সালের পর রেমিটেন্সের আগমনে গ্রামীণ অঞ্চলে ওই শ্রেণীটি আরো শক্তিশালী হয়েছে। শুধু গরীবরা নয়, গ্রামীণ এলাকায় যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে তারাও এদেরকে সমর্থন দিয়ে গেছে। ফলে সামাজিক প্রভাবে দিক দিয়ে এরা এখন এতটাই শক্তিশালী যে কোন মৈত্রীজোট না করলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পর্যন্ত হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতা করেছে।
আওয়ামী লীগের বড় মিত্র
মধ্যবিত্ত ‘উদারপন্থী’রা এই মৈত্রীবন্ধনের নিন্দা করলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাতে টলেননি। কারণ এরা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা তিনি জানেন । এটা জামায়াতে ইসলামীর মতো রাজনৈতিক ধর্মীয় গ্রুপগুলোর প্রভাব কমিয়ে আনার জন্য একটি হাতিয়ারও তার হাতে তুলে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি’র সঙ্গে মিত্রতা রয়েছে ওই জামায়াতে ইসলামী দলটির।
কথিত ভারত-পন্থী অবস্থানের কারণে বিএনপি-জামায়াত জোট শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি বিনষ্টের যে চেষ্টা করছে সেক্ষেত্রেও হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতা তার ইসলামী প্রমাণযোগ্যতা উন্নত করেছে। অথচ এই একটি বিরোধী গোষ্ঠী চেয়েছিলো হেফাজতকে ব্যবহার করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে। কিন্তু তারা হেফাজতের শক্তিমত্তা ব্যবহারে ব্যর্থ হয়েছে।
কিন্তু হেফাজতকে কোন রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রস্তাব দেননি শেখ হাসিনা, তাদেরকে তিনি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কওমী মাদ্রাসা’র ডিগ্রি সনদের স্বীকৃতি দিয়েছেন। এসব প্রতিশ্রুতিতে সমর্থন পেয়েছেন হেফাজতের।
তাই এই জীবিকার টানাপোড়ন চলা বিশ্বে জীবিকার জন্য হুমকিস্বরূপ যেকোন ধর্মতত্ত্বই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। বাংলাদেশে ইসলাম বিস্তারের শেকড় সামাজিকভাবে মোগল সম্রাট আকবরের কৃষি ব্যবস্থার (পঞ্চদশ শতক) সঙ্গে যুক্ত। ওই ব্যবস্থা বাংলা ও ভারতের কৃষি ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা ঘটায় ও সমৃদ্ধি আনে।
বাংলাদেশের ইসলামী অনুশীলন ও ধর্মীয় পেশাদারিত্বের প্রভাবের সঙ্গে একাত্ম হতে না পারলে এই অরাজনৈতিক আন্দোলন- তাবলীগ জামাতকে চরম অস্তিত্ব রক্ষার সংকটে পড়তে হবে। প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনে হেফাজতে ইসলাম এখন শক্তিশালী। তাই সহজেই দ্বন্দ্বে জয়ী হয়েছে তারা।