বৃহস্পতিবার, ৮ মার্চ ২০১৮
প্রথম পাতা » ব্রেকিং নিউজ » শহীদ জননী জাহানারা ইমামের পাশে শায়িত ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের পাশে শায়িত ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী
পক্ষকাল ডেস্ক ;আজ সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসেছিল ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর মরদেহ। লাল সবুজের পতাকায় আচ্ছাদিত কফিনটি ছেয়ে গেছে ফুলে ফুলে। মুক্তিযোদ্ধা ও ভাস্কর এ নারী সারাজীবন যেমন মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিলেন। বিদায় বেলাতেও তার কমতি হয়নি। অগণিত মানুষের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা নিয়ে তিনি বৃহস্পতিবার মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন। তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসে দেশের বিশিষ্টজনরা বলেছেন, আজীবন তিনি সংগ্রামী নারীদের প্রেরণার প্রতীক হয়ে থাকবেন।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী মঙ্গলবার রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ল্যাবএইড থেকে তার মরদেহ পিংক সিটির বাসায় নেয়ার পর সেই রাতেই বাদ এশা প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তার মরদেহ রাখা হয় ল্যাবএইড হাসপাতালের হিমঘরে। সেখান থেকে মঙ্গলবার সকাল ১১টা ১০ মিনিটে তার মরদেহ নিয়ে আসা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় নাগরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি। শুরুতেই তাকে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় সম্মান গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এতে নেতৃত্ব দেন জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ। সেখানে এক ঘণ্টা জাতির শ্রদ্ধা জানানো শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে দ্বিতীয় দফা জানাজা হয়।
বিকাল সাড়ে ৩টায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে এসেছিলেন দেশের বিশিষ্টজনরা। জাতীয় সংসদের পক্ষে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
আওয়ামী লীগের পক্ষে সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু শ্রদ্ধা জানায়।
সাংগঠনিকভাবে আরও শ্রদ্ধা জানায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়াকার্স পার্টি, মহিলা পরিষদ, কর্মজীবী নারী, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্র ইউনিয়ন, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, নৌপুলিশ, ছাত্রমৈত্রী, গণজাগরণ মঞ্চ, স্বাস্থ্য অধিদফতর, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ল্যাবএইড, গণসঙ্গীতশিল্পী সমন্বয় পরিষদ, ঋষিজ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, উদীচী, জাতীয় কবিতা পরিষদ, সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, প্রজন্ম’৭১, ছায়ানট, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন।
ব্যক্তিগতভাবে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর প্রতি শ্রদ্ধা জানান ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, রামেন্দু মজুমদার, ডা. সারওয়ার আলী, প্রাবন্ধিক মফিদুল হক, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেক, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, শিল্পী মনিরুল ইসলাম, কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, শিল্পী ফকির আলমগীর, শুভ্রদেব, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, কবি কামাল চৌধুরী, নাট্যজন ম হামিদ প্রমুখ।
শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্ব শেষে পরিবারের পক্ষে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর মেয়ে ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী বলেন, মা গত চার মাস ঘরের বাইরে যেতে পারেননি। তিনি ফাল্গুন দেখেননি। আজ আপনারা এত ফুলে মাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তাকে এক ফাল্গুন উপহার দিলেন। মা তার শেষ ঠিকানা পেয়েছেন, মা ঘুমাবেন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের পাশে। এর জন্য আমরা গর্বিত।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন সিরাজগঞ্জ ও পটুয়াখালী থেকে আগত সাত বীরাঙ্গনা। সিরাজগঞ্জ থেকে আসা বীরাঙ্গনা রাহেলা বেওয়া বলেন, ‘কোন বিপদে কারে কমু, যামু কৈই’। কথাগুলো বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী সব নারী আন্দোলনের সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার এ কণ্ঠস্বর কখনো পিছপা হননি। তিনি বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতির জন্য যে লড়াই করে গেছেন, সরকার তা এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আশা করেন তিনি।
ওবায়দুল কাদের বলেন, একজন নির্যাতিত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার যে ত্যাগ-তিতিক্ষা, তা নতুন প্রজন্মের কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তার ভাস্কর্য শিল্পচর্চায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে, শিল্প পেয়েছে এক নতুন মাত্রা।
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি জীবনভর লড়াই করে গেছেন। সাহস থাকলে যেসব বাধা অতিক্রম করা যায়, তার উদাহরণ ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। তার ওপর বারবার আঘাত এসেছে, কিন্তু তিনি বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী একই সঙ্গে সাহস ও সম্ভ্রমের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তার অবদান অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। সংস্কৃতি চর্চায় তার ভাস্কর্য এক নতুন সংযোজন। নতুন প্রজন্ম তার সম্পর্কে ভালোভাবে জানলে, দেশকে আরও ভালোভাবে জানতে পারবে।
কামাল লোহানী বলেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের কথা লুকিয়ে না রেখে লোকসমাজে তা প্রকাশ করেছেন। নির্যাতিত নারীর পক্ষে দাঁড়িয়ে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার অনন্য অবদানের কথা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ থাকবে।
রামেন্দু মজুমদার বলেন, তিনি অনেক বড় মাপের শিল্পী ছিলেন। তবে তার সামাজিক গুরুত্ব আরও বেশি। তিনি একাত্তরের নির্যাতিত নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, প্রেরণা জুগিয়েছেন। সে সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে সব সময় সোচ্চার ছিলেন।