সোমবার, ১১ জুন ২০১৮
প্রথম পাতা » ব্রেকিং নিউজ | রাজনীতি » বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন ভারত-বিএনপি সম্পর্কে পরিবর্তনের হাওয়া?
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন ভারত-বিএনপি সম্পর্কে পরিবর্তনের হাওয়া?
পক্ষকাল ডেস্ক ঃ
‘যদি বিএনপি ক্ষমতায় ফিরে আসে, তখন কি হবে?’
মাসখানেক আগে ভারতের একটি প্রভাবশালী সাপ্তাহিকে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে ঠিক এই প্রশ্নটি ছুঁড়ে দিয়েছিলেন ভারতের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দুজন বিশ্লেষক, যারা কাজ করেন একটি ফরেন পলিসি থিংক ট্যাংকের সঙ্গে।
মেইনস্ট্রিম উইকলি’তে প্রকাশিত এই নিবন্ধটির শিরোনাম ছিল, ‘ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ: হোয়াট ইফ বিএনপি রিটার্নস।’
এর ঠিক এক মাস পর বিএনপির কারাবন্দি নেতা খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে যখন দলের কর্মী-সমর্থকরা চরম উৎকণ্ঠায়, তখন বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদলকে দেখা গেল নয়া দিল্লিতে। সেখানে তাঁরা দফায় দফায় কথা বলছেন কীভাবে বাংলাদেশে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যায় সেটা নিয়ে।
আর ঠিক ওই একই সময় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছুটে গেছেন লন্ডনে, যেখানে গত প্রায় ১০ বছর ধরে নির্বাসিত দলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা তারেক রহমান বসবাস করছেন।
ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য হিন্দুতে একই রকম সময় প্রকাশিত হলো একটি প্রতিবেদন, যার মূল কথা, বিএনপি নেতারা ভারতের কাছে সাহায্য চাইছেন বাংলাদেশে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে।
বিএনপি বাংলাদেশে পরিচিত একটি ভারতবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে। কিন্তু গত মাসখানেকের ঘটনা কি সেখানে কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে? বিএনপি কি তার ভারত সম্পর্কিত অবস্থানে বড় পরিবর্তন আনছে? ভারতের নীতিনির্ধারকরা কি বাংলাদেশ নিয়ে নতুন করে ভাবছেন?
বিএনপি নিয়ে নতুন আগ্রহ
ভারতের কয়েকজন সাবেক কূটনীতিক, লেখক ও সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া যাচ্ছে যে বিএনপি ভারতের আস্থা অর্জনে নতুন করে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বিএনপির নেতাদের কথায়ও তার আভাস মিলছে। এর পাশাপাশি ভারতের নীতিনির্ধারকরাও বাংলাদেশে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিএনপিকে বিবেচনায় রাখতে চাইছেন।
বিএনপি যে বাংলাদেশে এখনো একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি, তারা যে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারে, আবারো বাংলাদেশে সরকার গঠন করতে পারে, এই বিবেচনাগুলো কিন্তু ভারত সরকারের নীতিনির্ধারকরা একেবারে বাদ দিতে চাইছেন না।
বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটি ধারণা হচ্ছে, ভারতের কাছে আওয়ামী লীগ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি পছন্দের দল এবং বিএনপি ক্ষমতায় ফিরে আসুক এটি তারা চায় না।
বাংলাদেশে একসময় ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন বীনা সিক্রি, ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত, যখন বিএনপি ছিল ক্ষমতায়। তিনি দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া’র বাংলাদেশ স্টাডি সেন্টারের সাবেক চেয়ারপারসন।
ভারত বিএনপিকে পছন্দ করে না এবং আওয়ামী লীগের প্রতিই তাদের পক্ষপাত, বীনা সিক্রি কিন্তু এই ধারণা একেবারেই নাকচ করে দিলেন। তিনি বলেন, ‘এটা একেবারেই ভুল প্রশ্ন এবং ভুল দৃষ্টিভঙ্গি। ভারত বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী, শান্তিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে আগ্রহী। ভারতের নেইবারহুড ফার্স্ট পলিসির মূল কথাও এটাই। পারস্পরিক সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা এবং পারস্পরিক অর্থনৈতিক স্বার্থের ভিত্তিতেই এটা হবে।’
বীনা সিক্রি স্বীকার করছেন যে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বিরাট উন্নতি হয়েছে, কিন্তু তিনি একই সঙ্গে এটাও বলছেন, ভারত বাংলাদেশের যে কোনো রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী, কথা বলতে প্রস্তুত। তবে তাদেরকে অবশ্যই দুই দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অব্যাহত রাখার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
বিএনপি প্রতিনিধি দল যে ভারতে গেছে বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের ব্যাপারে কথা বলতে সে ব্যাপারে তার মন্তব্য কি?
বীনা সিক্রি বলেন, ভারত যে কারো সঙ্গে কথা বলতে রাজি। কারণ ভারত পিপল-টু-পিপল রিলেশনশিপে বিশ্বাসী। কাজেই যে কোনো কারো সঙ্গেই ভারত কথা বলতে রাজি।
দিল্লির অগ্রাধিকার
ভারতের একটি প্রভাবশালী সাময়িকী মেইনস্ট্রিম উইকলিতে প্রকাশিত নিবন্ধটি লিখেছিলেন অপরুপা ভট্টাচার্য এবং সৌরিনা বেজ। এই লেখায় তারা সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন, যদি বিএনপি নির্বাচনে জিতে বাংলাদেশের ক্ষমতায় ফিরে আসে, তখন ভারত কি করবে?
তাদের মতামত হচ্ছে, শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি ভারতের সমর্থন অব্যাহত থাকলেও, ভারতের উচিত হবে না বাংলাদেশের ক্ষমতার লড়াইয়ে খালেদা জিয়া বা বিএনপিকে এখনো খরচের খাতায় লিখে ফেলা। তাদের মতে, যদি খালেদা জিয়া ক্ষমতায় ফিরে আসেন, তাহলে ভারতকে তার নীতি কিছুটা বদলাতে হবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ খুব ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেন ভারতীয় লেখক-সাংবাদিক এস এন এম আবদি। ভারতের নামকরা সাময়িকী আউটলুকের সাবেক ডেপুটি এডিটর।
ভারত তার সব ডিম এক ঝুড়িতে রেখেছে এটা তিনি বিশ্বাস করেন না। তাঁর মতে, ‘এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা। এটা ভারতীয় নীতির এক নম্বর প্রায়োরিটি। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারত কিন্তু একটি বিকল্প দৃশ্যপটের জন্যও তৈরি। ভারত বিএনপিকে খারিজ করে দেয়নি।’
‘ভারত অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। বিএনপি শুধু নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরো যেসব শক্তি রয়েছে, যেমন এরশাদ, এমনকি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও। ভারত তাদের সঙ্গে পর্যন্ত কথা বলে।’
এস এন এম আবদির মতে, মূলত তিনটি শহরে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা কথা বলেন, যোগাযোগ রক্ষা করেন। ঢাকায়, লন্ডনে, আর দিল্লিতে।
‘এটা কূটনীতিকরা করেন, এটা রিসার্চ অ্যান্ড এনালিসিস উইং বা ‘র’ করে, এবং পলিটিক্যাল লেভেলেও এই আলোচনা চলে। লন্ডনে যেসব লোকজন ভারত সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ, বিশেষ করে বিজেপি এবং আরএসএস’র নেতৃবৃন্দ, তাদের মাধ্যমেও এসব যোগাযোগ হয়।’
বিএনপির সঙ্গে ভারত যে সম্পর্ক রক্ষার চেষ্টা করে, সেটিকে আওয়ামী লীগ মোটেও সুনজরে দেখে না বলে মনে করেন তিনি।
‘ভারতের নতুন হাই কমিশনার হয়ে শ্রিংলা যখন ঢাকায় গেলেন, তিনি কিন্তু খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন, যেটা আওয়ামী লীগের পছন্দ হয়নি। গত বছর যখন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ঢাকায় গেলেন, আওয়ামী লীগ একদম চায়নি উনি খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু এই সফরের আগেই কিন্তু তখন লন্ডনে অবস্থানরত খালেদা জিয়াকে বার্তা দেওয়া হয় যে সুষমা স্বরাজ তাঁর সঙ্গে ঢাকায় সাক্ষাৎ করতে চান। খালেদা জিয়া তখন ঢাকায় ফিরে আসেন। আর সুষমা স্বরাজ তখন দেখা করেন তার সঙ্গে।’
এর সূত্র ধরে বিএনপির ভারত নীতিতেও পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন এস এন এম আবদি।
‘গত দুই বছরে আপনি কি বিএনপির নেতাদের কাউকে ভারতের সমালোচনা করতে দেখেছেন? প্রধানমন্ত্রী মোদির সমালোচনা করতে দেখেছেন? তারা করেননি। সর্বোচ্চ যেটা তারা করেছেন, তা হলো, তারা শেখ হাসিনার সরকারের সমালোচনা করেছেন ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের ন্যায্য দাবি আদায় করতে ব্যর্থতার জন্য। হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ সরকারকে আক্রমণের বেশি আর বিএনপি যায়নি। ভারতের সমালোচনা তারা আর করছে না।’
বিএনপির অবস্থানে পরিবর্তন
বিএনপি কি ভারতের আনুকূল্য লাভের জন্যই তাহলে ভারতের সমালোচনা বন্ধ করেছে?
‘ব্যাপারটি ঠিক তাই। বিএনপির বোধোদয় হয়েছে। বিএনপি তার বোধ-বুদ্ধি ফিরে পেয়েছে। পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে হাজার মাইল দূরে। ভারত হচ্ছে ঘরের পাশের প্রতিবেশী। ভৌগোলিকভাবে যদি দেখেন, ভারতের হাত বাংলাদেশের গলার ওপর। বাংলাদেশের একদিকে সমূদ্র। আর বাকি তিন দিকে হচ্ছে ভারত। কাজেই বাংলাদেশকে তো ভারতের সঙ্গে থাকতে হবে। আর ভারতেরও এই উপলব্ধি বাড়ছে যে বাংলাদেশের সঙ্গেই থাকতে হবে। কারণ বাংলাদেশে কোনো সমস্যা হওয়া মানে হচ্ছে ভারতের বগলে ফোঁড়া গজানোর মতো। বগলে ফোঁড়া হলে সেটা কতোটা যন্ত্রণাদায়ক, সেটা ভারত বুঝতে পারে।’
এক সাক্ষাৎকারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে তারা বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের জন্য ভারতের সহায়তা চান। তারা মনে করেন, বৃহৎ প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের ওপর ভারতের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। সেই প্রভাব ভারত কাজে লাগাতে পারে।’
কিন্তু ভারত কি সেই ভূমিকা পালন করতে প্রস্তুত?
বাংলাদেশে সাবেক ভারতীয় হাই কমিশনার বীনা সিক্রি মানতে নারাজ, এখানে ভারতের কোন ভূমিকা রয়েছে।
‘কিন্তু নির্বাচন আয়োজনের প্রাথমিক দায়িত্ব তো বাংলাদেশের। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কাজেই ভারত যে কোনোভাবেই বাংলাদেশের এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে, এটা হবে না। কখনো না। অতীতেও ভারত এটা কখনো করেনি এবং ভবিষ্যতেও ভারত কখনো এরকম হস্তক্ষেপের কথা বিবেচনা করবে বলে আমি মনে করি না।’
ভারতীয় সাংবাদিক এস এন এম আবদির মতও তাই।
‘আমার মনে হয় না ভারত এখানে আগ বাড়িয়ে কিছু করবে। সত্যি কথা বলতে কি সেটা ঘটবে বলে আমার মনে হয় না। তবে আমার মনে হয় নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষের রায় মেনে নিতে ভারত প্রস্তুত।’