শনিবার, ১৬ মার্চ ২০১৯
প্রথম পাতা » ব্রেকিং নিউজ | সম্পাদক বলছি » বঙ্গবন্ধুর ৯৯ জন্মদিন : জাতীয় শিশু দিবস
বঙ্গবন্ধুর ৯৯ জন্মদিন : জাতীয় শিশু দিবস
আজ ১৭ মার্চ। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শুভ জন্মদিন এবং জাতীয় শিশু দিবস। ১৯২০ সালের এই দিনে দুঃখী বাংলার দুঃখী মানুষের মুক্তির বার্তা নিয়ে গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক নেতা যিনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। জনসাধারণের কাছে তিনি ‘শেখ মুজিব’ এবং ‘শেখ সাহেব’ হিসেবে বেশি পরিচিত এবং তাঁর উপাধি ‘বঙ্গবন্ধু’। তিনি বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ছুটে বেড়িয়ে বাঙালির কাছে পৌঁছে দেন পরাধীনতার শিকল ভাঙার মন্ত্র। সে মন্ত্রে বলীয়ান হয়ে স্বাধীন দেশে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি আজ বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম সম্ভাবনাময় দেশে। তাঁর সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ শুধু নয়- এখন চাল বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে এবং দেশ উন্নতির পথে এগিয়েই চলছে।
বাংলা, বাঙালি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একবৃন্তে তিনটি চেতনার ফুল। বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের মাঝে বঙ্গবন্ধু চির অ¤øান, চিরঞ্জিব। তদ্রƒপ বাংলার শোষিত-বঞ্চিত-নির্যাতিত-মেহনতি জনতার হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু চিরভাস্বর। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা দিয়ে কর্মী থেকে নেতা, নেতা থেকে জননেতা, একটি দলের নেতা থেকে হয়েছেন দেশনায়ক। সাধারণের মধ্য থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নেতৃত্বের উদ্ভব। তিনি শাশ্বত গ্রামীণ সমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ছেলেবেলা থেকে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন। গরিব ও অসহায় মানুষের পাশে সব সময় দাঁড়াতেন শেখ মুজিব। ছোটবেলায় তাঁকে বর্ষাকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য তাঁর বাবা একটা ছাতা কিনে দিয়েছিলেন। মুজিব সেই ছাতাটি তাঁর এক বন্ধুকে দিয়ে দিয়েছিলেন, যার কোনো ছাতা ছিল না। আবার শীতকালে তাঁকে একটা চাদর দেয়া হয়েছিল। সেই চাদরটি তিনি এক অসহায় বৃদ্ধাকে দিয়েছিলেন। ক্ষুধায় কাতর দরিদ্র কৃষকদের নিজের ঘরের গোলার ধান বিলিয়ে দিতেও তাঁর উৎসাহ ছিল অপরিসীম। দরিদ্র মানুষের দুঃখ, কষ্ট তাঁকে সারাজীবন সাধারণ দুঃখী মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসায় সিক্ত করে তুলত। তিনি সাধারণ মানুষের আশাকে ভাষা দিতে, স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন এবং বছরের পর বছর যৌবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলো কাটিয়েছেন নির্জন কারাবাসে। মানুষের জন্য হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চকে বেছে নিতে কখনো কুণ্ঠিত হননি। ঘাতকের বুলেট বুক পেতে নিয়েছেন কিন্তু জনগণের সঙ্গে বেইমানি করেননি বঙ্গবন্ধু। তাই তিনি বাঙালি জাতির হৃদয়ের মণিকোঠায় অমর হয়ে আছেন। বস্তুতপক্ষে সমাজ ও পরিবেশ তাঁকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম করতে শিখিয়েছে। তাই পরবর্তী জীবনে তিনি কোনো শক্তির কাছে মাথানত করেননি।
পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়রা খাতুনের চার কন্যা ও দুই পুত্রের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয় সন্তান। তাঁর বড় বোন ফাতেমা বেগম, মেজ বোন আছিয়া বেগম, সেজ বোন হেলেন ও ছোট বোন লাইলী; ছোট ভাইয়ের নাম শেখ আবু নাসের। ১৯৩৮ সালে ১৮ বছর বয়সে তাঁর সঙ্গে ফজিলাতুন্নেসার বিয়ে হয়। এই দম্পতির ঘরে দুই কন্যা এবং তিন পুত্রের জন্ম হয়। কন্যারা হলেন শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। আর পুত্রদের নাম শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং শেখ রাসেল। তিনজন পুত্রই বঙ্গবন্ধু সঙ্গে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে আততায়ীর হাতে নিহত হন।
৭ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু পার্শ্ববর্তী গিমাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর পড়েছেন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুল ও গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলে। মিশন স্কুলে পড়ার সময় স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সে সময়ে স্কুলের মেরামত কাজ ও ছাদ সংস্কার এবং খেলার মাঠ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জরুরিভাবে অর্থ বরাদ্দ দেয়ার দাবি করেন শেখ মুজিবুর রহমান। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদান করায় তিনি জীবনে প্রথম গ্রেপ্তার হন। ১৯৪২ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে কলকাতায় গিয়ে বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৬ সালে তিনি বিএ পাস করেন। শেখ মুজিবুর রহমান এই সময় ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই সময় তিনি হোসেন সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমের মতো নেতাদের সান্নিধ্যে আসেন এবং ছাত্র-যুবনেতা হিসেবে রাজনীতির অঙ্গনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। কলকাতার কলেজ জীবনে বঙ্গবন্ধু এ উপমহাদেশের রাজনীতির স্বাভাবিক আবর্তে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর পরই ঢাকায় ফিরে নতুন রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা নিয়ে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ গঠন করেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৮-এর আইয়ুব সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ প্রধান হিসেবে ১৯৬৬-এর ঐতিহাসিক ৬ দফা স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারারুদ্ধ হন তিনি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ষাটের দশকে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। ১৯৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতা তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার পক্ষে জানায় অকুণ্ঠ সমর্থন। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির এ নির্বাচনী বিজয়কে মেনে নেয়নি। বাঙালির এই নেতা কখনো অন্যায়ের কাছে আপস করেননি। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত এই নেতা ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে এ দেশের আপামর জনগণ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করেন বহু কাক্সিক্ষত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরুর জন্মদিনটি শিশু দিবস হিসেবে পালিত হয়। অপরদিকে একটি স্বাধীন দেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটিও শিশু দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। কিন্তু এ দিনটি কেন জাতীয় শিশু দিবস হলো? কেন এ দিনটিকে শুধু শিশুদের দিন হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে? কারণ বঙ্গবন্ধু শিশুদের অত্যন্ত আদর করতেন, ভালোবাসতেন। সংগ্রামী জীবনের শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি শিশুদের জন্য ভাবতেন। শিশুদের আনন্দ ও হাসি-খুশিতে রাখার প্রতি গুরুত্ব দিতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আগামীতে দেশ গড়ার নেতৃত্ব দিতে হবে তাদেরই। সৃজনশীল মুক্তমনের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক, সব সময়ই তিনি তা আশা করতেন। শৈশব থেকেই তাঁর বড় হৃদয় ও ছোট-বড় সবার জন্য দরদি হওয়ার কারণই মানুষকে তিনি অধিকার আদায়ে উদ্বুদ্ধ করতে, সচেতন করতে, সংগ্রামী করতে পেরেছেন। রাজনীতির কাজে কিংবা দেশের বিভিন্ন কাজে যখন গ্রামেগঞ্জে যেতেন তখন চলার পথে শিশুদের দেখলে তিনি গাড়ি থামিয়ে তাদের সঙ্গে গল্প করতেন, খোঁজ-খবর নিতেন। দুস্থ ও গরিব শিশুদের দেখলে তাদের কাছে টানতেন। কখনো কখনো নিজের গাড়িতে উঠিয়ে অফিসে কিংবা বাড়িতে নিয়ে শিশুদের কাপড়চোপড়সহ অনেক উপহার দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটাতেন।
১৯৭৫ পরবর্তী ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু নাম মুছে ফেলার অনেক ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের সব ষড়যন্ত্রই ব্যর্থ হয়েছে। কারণ বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশুদিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯৯৭ সালের ১৭ মার্চ দিবসটি পালন শুরু হয়। কিন্তু ২০০১ সালে যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় এসেই তৎকালীন সরকার জাতীয় শিশুদিবস পালনের রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা বন্ধ করে দেয়। তবে দলীয় এবং বেসরকারি পর্যায়ে দিনটি পালন অব্যাহত ছিল। ২০০৯ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা আবার ক্ষমতায়। এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে আবার পালিত হচ্ছে জাতীয় শিশুদিবস। কিন্তু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কি এতই ফেলনা যে, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ছুড়ে ফেলতে হবে? সরকারিভাবে তাঁর জন্মদিন পালন বন্ধ হয়ে যাবে? বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতির নেতা। তিনি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি এবং জাতির পিতা। অথচ ভিন্ন আদর্শের অন্য সরকার ক্ষমতায় এলে তাঁর জন্মদিন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন হবে না, তা কি ভাবা যায়? বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান মানে বাঙালি জাতির সত্তাকে অস্বীকার করা।
আমাদের পক্ষকাল -
দেশ যখন শিক্ষা-কৃষি-অর্থনীতিসহ সব খাতে এগিয়ে চলছে ঠিক তখনই বিএনপি-জামায়াত শিশুদের জিম্মি করে রাজনীতি করছে। চরম দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তার মধ্যদিয়ে ১৫ লাখ শিক্ষার্থী এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা দিচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী বারবার হরতাল-অবরোধকারীদের তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে শিক্ষার সঠিক পরিবেশ ফিরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে এলেও অবরোধকারীরা সে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে একের পর এক হরতাল দিয়ে যাচ্ছে। বরং শিশু-কিশোরদের প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র দয়ার উদ্রেক হয়নি। পহেলা এপ্রিল থেকে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা। শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, সাধারণ মানুষ যে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত- তা থেকে সবাই মুক্তি চায়। যে রাজনীতি নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থী কিংবা সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারতে দ্বিধা করে না- সে রাজনীতি বন্ধ হোক। শিশু দিবসে আমরা আবারো শিশুদের অধিকারের কথা স্মরণ করব। আলোচনা করব শিশুদের নিয়ে। আমরা তাদের জন্য কী করলাম, কী করতে পারছি আর কী করার বাকি আছে তা খতিয়ে দেখতে হবে- তবে বঙ্গবন্ধুর যে স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা গড়ার, সে সোনার বাংলা নতুন প্রজন্মই গড়বে। শিশুদের সঠিকভাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব শুধু বাবা-মা বা পরিবারের নয়। রাষ্ট্রকেও নিতে হবে শিশুর মেধা বিকাশে সঠিক কর্মসূচি।
আগামীদিনের সুনাগরিক শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ এবং সুখীসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। নীতিহীন রাজনীতির এ নিষ্ঠুর হরতাল-অবরোধ থেকে মুক্তি পাক শিশু, শিক্ষাঙ্গন এবং আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ- এবারে জাতির পিতার জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবসে এ হোক আমাদের দৃপ্ত শপথ।
প্রফেসর মো. শাদাত উল্লা :