যাদের বিশ্বাস করে ঠকেছিলেন শেখ হাসিনা
পক্ষকাল ডেস্ক ০৬ জুন- আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা আদিলগ্ন ছিল এক দুর্যোগময় সময়। সে সময় তিনি অস্তিত্বের সংকটে থাকা দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলকে বাঁচিয়ে ছিলেন। শেখ হাসিনার কাছে আওয়ামী লীগ পুনর্জীবিত হয়েছিল এবং আজকের অবস্থানে আসতে পেরেছে। দলের মধ্যে অনেকেই তার সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন, অনেকেই তার সাথে সুবিচার করেননি। তাদের সঙ্গে লড়াই করে প্রতিকূল পরিস্থিতি ও পরিশ্রম দিয়ে দলকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন। কিন্তু দলের বাইরেও শেখ হাসিনা অনেক মানুষকে বিশ্বাস করেছিলেন। অনেকের উপর আস্থা রেখেছিলেন এবং অনেককে তিনি শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলেন, কিন্তু তারা শেখ হাসিনার সেই আস্থা বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধার মর্যাদা দিতে পারেননি। বরং তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তাদের জন্য শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনের অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত নন কিন্তু শেখ হাসিনার আনুকূল্য পেয়েছেন। শেখ হাসিনা যাদের উপর আস্থা রেখেছিলেন। তাদের কাছে তিনি ঠকেছেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে নিয়ে এই প্রতিবেদন:
বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ: বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। ১৯৯০ সালে যখন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়, তখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবে এই নিয়ে টানাপোড়েন চলতে থাকে। টানাপোড়েনের সমাধান দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে প্রধান উপদেষ্টা করার প্রস্তাব দেন এবং তার এই প্রস্তাবের আলোকেই শাহাবুদ্দিন আহমেদকে প্রধান উপদেষ্টা করার জন্য মনোনীত করা হয়। কিন্তু বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন যে তিনি প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন শেষে আবার প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে আসতে চান। তার জন্য সংবিধান সংশোধন করা হয় একানব্বই সালে। তিনি প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যেয়ে আবার অবসর নেন।
১৯৯৬ সালের দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা উদার গণতান্ত্রিক নীতি এবং অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের ধারা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। আর এ জন্য তিনি রাষ্ট্র অভিভাবক হিসেবে একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে মনোনীত করতে চেয়েছিলেন। যদিও দলের অধিকাংশ নেতারা শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা অবসরে যাওয়া বিচারপতি শাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনয়নের সিদ্ধান্ত অটুট থাকেন । তিনি এবং তার বোন শেখ রেহানা দুজনই বিচারপতি শাহাবুদ্দিন এর কাছে গিয়ে তাঁকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানান। এর পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে একজন নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত করেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি শেখ হাসিনার উপর যে আস্থা রেখেছিলেন তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন তার প্রতিদান দেন নি। বরং তিনি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত, অজনপ্রিয়, এবং বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার জন্য যা যা করা দরকার সবকিছুই করেছেন এবং একারনেই আওয়ামী লীগ পরবর্তীতে কখনই আর দলের বাইরে রাষ্ট্রপতি করতে আগ্রহী হয় নি। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন এখনো জীবিত রয়েছেন এবং তিনি গুলশানে নিজের বাড়িতে থাকছেন এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। আওয়ামী লীগের কাছে তিনি একজন ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত। তবে শেখ হাসিনা অবশ্য এই সমস্ত মনে রাখেন না। যারা তার সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন তাদের বিচারের ভার তিনি ইতিহাসের উপর ছেড়ে দিয়েছেন।
বিচারপতি লতিফুর রহমান: ২০০১ সালে এদেশে প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারই শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নিয়েছেন। আওয়ামী সভাপতি শেখ হাসিনা ক্ষমতা হস্তান্তর করে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানকে তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণ করেই বিচারপতি লতিফুর রহমান তার আসল চেহারা উম্মোচন করেন। এই সময় তিনি একের পর এক এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকেন, যে পদক্ষেপগুলো আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যায়। আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে হারানোর জন্য যা যা করা দরকার বিচারপতি লতিফুর রহমান তাই করেছেন। সেক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। লতিফুর রহমান শপথ নেওয়ার ১৫ মিনিটের মধ্যে একসঙ্গে ১৩ জন সচিবকে বদলির আদেশ দেন। এটা নজিরবিহীন এবং শিষ্টাচার বিরোধী। এরপর তিনি একের পর এক যে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছিল, যার সবগুলোই ছিল আওয়ামী লীগকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলানো। লতিফুর রহমান আওয়ামী লীগের কাছে একজন বিশ্বাস ঘাতক হিসেবেই পরিচিত। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা লতিফুর রহমানের ব্যাপারে আগেই আওয়ামী লীগ সভাপতিকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি সেদিকে কর্ণপাত না করে তিনি লতিফুর রহমানকে যথাযথ মর্যাদা এবং বিশ্বাসের জায়গা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বিশ্বাসের মর্যাদা লতিফুর রহমান রাখতে পারেননি।
ড. মোহাম্মদ ইউনুস: শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতির সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। আওয়ামী লীগ সভাপতি তাকে গ্রামীন ব্যাংকের জন্য বাজেটে আলাদা বরাদ্ধ দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, গ্রামীন ফোনের জন্য তিনি মধ্যসত্তা হিসেবে তদবির করেছিলেন। সেই গ্রামীন ফোনের আবেদনও মঞ্জুর করেছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ড. মোহাম্মদ ইউনুসও সেই গ্রামীন ফোনের প্রাপ্তির কথা আনুষ্ঠানিকভাবে অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেছিলেন যে, এই গ্রামীন ফোনের লাইসেন্স পেতে তার একটা চায়ের অর্থও খরচ করতে হয়নি। সেই ড. ইউনুস আন্তর্জাতিক নানা রকম হিসেব নিকেশে শেখ হাসিনার বিরোধী অবস্থানে চলে যান এবং শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার যে ফর্মূলা তৈরী হয়েছিল ওয়ান ইলেভেনের সময়, তার অন্যতম প্রণেতা ছিলেন ড. মোহাম্মদ ইউনুস। শুধুমাত্র তাই নয়, বিভিন্ন সময় তিনি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলে বিষোদাগার এবং অযাচিত মন্তব্য করেছেন বলেও একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। বিশেষ করে যখন ওয়ান ইলেভেনের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যখন তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসেন তখন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বাধা দেওয়ার ব্যাপারে ড. ইউনুসের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো পদ্মা সেতু তৈরীতে বাধা দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি বিশ্বব্যংকে লবিং করেছিলেন।
বিচারপতি এসকে সিনহা: বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে প্রধান বিচারপতি করার ক্ষেত্রে আপত্তি জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা। আওয়ামী লীগ সভাপতি ক্যাবিনেট মিটিংয়েই দলের মন্ত্রিসভার বৈঠকেও এ কথা স্বীকার করেছেন যে, তিনি যোগ্যতার নিরিখেই তাকে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পেয়েই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কূটকৌশল তৈরী করেন। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটা জুডেশিয়াল ক্যুয়ের নীল নকশা তৈরী করেছিলেন তিনি। এমনকি জামাত- বিএনপির সঙ্গে একটি গোপন আতাত করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করার জন্যও অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিলেন বলে এখন সুনিদিষ্ট তথ্যা প্রমান পাওয়া যায়। এ কারণে সিনহাকে সরে যেতে হয়। কিন্তু বিচারপতি সিনহা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন বিশ্বাসঘাক হিসেবে তিনি পরিচিত হবেন।
এই সমস্ত ব্যাক্তিরা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেননি। কিন্তু শেখ হাসিনা তাদেরকে মর্যাদা দিয়েছিল। তাদের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। কিন্তু তারা শেখ হাসিনাকে ঠকিয়েছেন। অবশ্য এতে শেখ হাসিনার রাজনীতির ক্যারিয়ারে কোন রকম টানাপোড়েন তৈরী হয়নি। বরং তারাই ইতিহাসে তাদেরকে মলিন করেছেন। ইতিহাসে তাদের যে মর্যাদার জায়গা। সেই জায়গাকে তারা ক্ষুন্ন করেছেন।