শনিবার, ১৩ জুলাই ২০১৯
প্রথম পাতা » জেলার খবর | ব্রেকিং নিউজ | রাজনীতি » এক হতভাগা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এম আই চৌধুরী
এক হতভাগা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এম আই চৌধুরী
আমিরুল ইসলাম রাঙা -
এম আই চৌধুরী ওরফে মোঃ ইসহাক আলী। মুক্তিযুদ্ধের সময় আটঘরিয়া এবং চাটমোহর উপজেলার এক বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছিল তার কর্মকান্ড। মুক্তিযুদ্ধে ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহন করে সাত নম্বর সেক্টরের অধীনে সীমান্তে যুদ্ধ করে অক্টোবর মাসের শেষ দিকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ১২ ডিসেম্বর আটঘরিয়া থানা আক্রমন এবং ১৪ ডিসেম্বর চাটমোহর থানা আক্রমনে নেতৃত্ব দেন। ২০ ডিসেম্বর চাটমোহর মুক্তদিবসে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য গ্রুপ তাঁকে আটক করেন । এরপর তাঁর আরো দুইভাই এবং ভগ্নিপতিকে ধরে আনার পর একসাথে চারজনকে হত্যা করা হয়। সেদিন শুধু তাকে হত্যা করেই ঘটনার শেষ হয়নি। তাঁকে হত্যা করে তাঁর কৃতিত্বটুকুও গুম করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এম আই চৌধুরীর নাম লেখা হলেও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তাঁর নাম কখনোই লেখা হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চাটমোহর উপজেলায় কিছু ঘটনা কলঙ্কিত করেছে । যেমন ১৯৭০ সালে চাটমোহর, ফরিদপুর ও শাহজাদপুর আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য ( এমএনএ) সৈয়দ হোসেন মনসুর মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে ছিলেন। চাটমোহর ও ফরিদপুর থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ( এমপিএ) অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক সমাজী মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন নাই। উনি পাবনার জেলার একমাত্র সংসদ সদস্য যিনি ভারতে যাননি। এছাড়া অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে চাটমোহরে মুক্তিযোদ্ধা রবীন্দ্রনাথ গোস্বামী, মুক্তিযোদ্ধা অজিত কুমার এবং মুক্তিযোদ্ধা গোবিন্দ কুমার রহস্যময়ভাবে গুম এবং খুন হয়। পরিশেষে ২০ ডিসেম্বর হত্যা করা হয় এম আই চৌধুরী সহ তাঁর পরিবারের চারজনকে।
এম আই চৌধুরী চাটমোহর উপজেলার ডিবিগ্রাম ইউনিয়নের নরাইখালী গ্রামে ১৯৫৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আলহাজ মোঃ আয়েজ উদ্দিন। চার ভাই দুই বোনের মধ্য এম আই চৌধুরী ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তিনি ১৯৭০ সালে এসএসসি পাস করে চাটমোহর কলেজে ভর্তি হন। ৬৯ এর গণআন্দোলন, ৭০ এর নির্বাচন এবং ৭১ এর মার্চ মাসের উত্তাল আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহন করেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চ লাইটের নামে সারাদেশে লক্ষ লক্ষ নীরিহ মানুষকে হত্যা করে। জুন জুলাই মাসে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় পুরা এলাকা জলমগ্ন হয়। ঠিক এমন একটি সময়ে এলাকার এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে এম আই চৌধুরী ভারতে যান। সেখানে যাবার পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রিক্রুট হন এবং দার্জিলিং জেলার পানিঘাটায় ২৮ দিনব্যাপী সশস্ত্র প্রশিক্ষন নেন। এরপর তাঁকে পশ্চিম দিনাজপুর জেলার তরঙ্গপুর ক্যাম্প আনা হয়। সেখানে মাসব্যাপী সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধ করে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে সাত নম্বর সেক্টরে আনা হয়। সেখানেও কয়েকদিন যুদ্ধ করার পর সাত নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে এম আই চৌধুরীকে গ্রুপ কমান্ডার করে ভারী অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পাবনা প্রবেশের নির্দেশ দেওয়া হয়। অক্টোবর মাসের ২০/২৫ তারিখের দিকে তাঁর দলবল নিয়ে পাবনায় প্রবেশ করেন। এরপর চাটমোহর ও আটঘরিয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে অবস্থান গ্রহন করেন।
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এম আই চৌধুরী যখন এলাকায় আসেন তখন চাটমোহর উপজেলায় ময়েজ উদ্দিন ময়েজ, এস এম মোজাহারুল হক, আমজাদ হোসেন লাল, ইদ্রিস আলী চঞ্চল প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধাদের দল অবস্থান করছিল। আটঘরিয়া উপজেলায় তখন ছিল আনোয়ার হোসেন রেনু ( আটঘরিয়া), ওয়াছেব আলী ( ঈশ্বরদী), শাহজাহান আলী ( পাবনা) এবং আবদুল মান্নান গোরা ( পাবনা) প্রমুখদের দল। এরমধ্যে এম আই চৌধুরী দেরীতে এলাকায় আসার কারনে তার অবস্থান ছিল চাটমোহর এবং আটঘরিয়ার মাঝামাঝি স্থানসমুহে। এম আই চৌধুরীর বাহিনী আলাদা ভাবে বেশ কয়েকটি অপারেশন নিজেরা করে। বিশেষ করে গফুরাবাদ রেলব্রীজ অপারেশন এবং কামালপুর গ্রামে রাজাকার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ ছিল উল্লেখ করার মত।
১২ ডিসেম্বর এম আই চৌধুরী এবং শাজাহান কমান্ডারের নেতৃত্বে আটঘরিয়া থানা আক্রমণ করা হয় এবং ঐদিনই আটঘরিয়া থানা শত্রুমুক্ত হয়। এরপর ১৪ ডিসেম্বর এম আই চৌধুরী এবং সেখানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের দল যৌথভাবে চাটমোহর থানা আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমনে পাকিস্তান বাহিনীর অনেকেই হতাহত হন।এক পর্যায়ে থানায় অবস্থানরত পাকিস্তান বাহিনীর সবাই আত্মসমর্পনে সম্মত হয়। তারা শর্ত আরোপ করে মুক্তিবাহিনী নয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে তারা আত্মসমর্পন করতে চান। সেই মোতাবেক স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা পাবনায় যোগাযোগ করলে বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল ২০ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর পোশাক পরে চাটমোহর থানায় উপস্থিত হন। এরপর পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পন করলে চাটমোহর থানা শত্রুমুক্ত হয়।
অসমর্থিত সুত্রে প্রকাশ পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পনের পর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এম আই চৌধুরী থানা ভবনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। এরপরেই ঘটে সেই মর্মান্তিক ঘটনা। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি গ্রুপ পাবনার মুক্তিবাহিনীর লিডার রফিকুল ইসলাম বকুলের কাছে অভিযোগ করেন, প্রায় দুইমাস আগে এম আই চৌধুরী নিজে মুক্তিযোদ্ধা রবীন্দ্রনাথ গোস্বামী, অজিত এবং গোবিন্দকে খুন করেছে। এরপর রফিকুল ইসলাম বকুল পাবনা রওয়ানা হওয়ার পরই স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা এম আই চৌধুরীকে আটক করে। এই সংবাদ প্রচার হলে এম আই চৌধুরীর ভাই আবু বকর সিদ্দিক ভাইয়ের খোঁজে থানায় গেলে তাকেও আটকানো হয়। এরপর ইদ্রিস আলী চঞ্চলের নেতৃত্বে আরেকদল মুক্তিযোদ্ধা এম আই চৌধুরীর গ্রামের বাড়ী গফুরাবাদ স্টেশনের পাশে নরাইখালী গ্রামে গিয়ে তার বড় ভাই ইউসুফ আলী এবং ভগ্নিপতি আফসার আলীকে ধরে থানায় নিয়ে আসে। ঐ রাতেই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এম আই চৌধুরী তার দুই ভাই এবং ভগ্নিপতি এই চারজনকে একসাথে হত্যা করে চাটমোহর থানা কমপ্লেক্সের ভিতর মাটি চাপা দেওয়া হয়।
৪৮ বছর পর এই ঘটনা লেখতে গিয়ে বার বার আবেগ তাড়িত হয়ে পড়ছি। চোখের সামনে ভেসে উঠছে তিন সন্তান এবং জামাইকে হারানো বাবা আর মায়ের প্রতিচ্ছবি। কেমন করে এমন শোক উনারা সহ্য করেছিলেন। এমন একটি মর্মান্তিক ঘটনায় এম আই চৌধুরীর দুই ভাবী শিশু সন্তানদের নিয়ে বিধবা হওয়ার কথা ভাবতে গেলে পাষান হৃদয়টাও ভেঙ্গে যায়। ভগ্নিপতি খুন হওয়ায় একমাত্র শিশুপুত্র নিয়ে বোনটা বিধবা হয়ে যায়। সেই লোহমর্ষক ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া একমাত্র ভাই কাশেম আলী অর্ধমৃত অবস্থায় এখনো বেঁচে আছেন। সেই দুর্বিসহ জীবনের কথা মনে হলে এখনো আঁতকে উঠেন।
এই মর্মান্তিক ঘটনার এত বছর পরেও এলাকার মানুষ ভুলতে পারেননি। রুপকথার গল্পের মত এখনো ঘটনাটি মানুষের মুখে মুখে ভেসে বেড়ায়। ঘটনার সাথে যারা জড়িত ছিলেন তাদের অনেকেই বেঁচে নাই। অন্যতম এক হত্যাকারী স্বাধীনতার দুই মাসের মধ্যে পাবনা শহরের বানী সিনেমা হলের সামনে খুন হন। খুনীদের অনেকে মারা গেছেন - অনেকে এলাকা ছাড়া হয়েছেন। অনেকে মৃত্যুপথের যাত্রী। অপরাধীদের রাষ্ট্রীয় আদালতে বিচার করা যায়নি তবে প্রকৃতির বিচার থেকে তারা রেহাই পায়নি। প্রায়শ্চিত্ত তাদের ভোগ করতে হবে। সবার মৃত্যু হবে তবে এই ঘটনার কথা বিলুপ্ত হবেনা। এখানে জনতার কাছে একটি প্রশ্ন রেখে যাই - এম আই চৌধুরী যদি কোন অপরাধ করে থাকে তার জন্য নিরোপরাধী ভাইদের এবং ভগ্নিপতিকে হত্যা করা কি অপরাধ নয়? এম আই চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কোন কর্মকান্ডে যদি জড়িত না থাকেন তাহলে তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তি না করা কি অপরাধ নয়?
এম আই চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় দুই মাস এই এলাকায় থেকে যুদ্ধ করেছেন, একটি মানুষও বলতে পারবেনা তিনি কোন খারাপ কাজে জড়িত ছিলেন । তার গ্রুপে থাকা কোন মুক্তিযোদ্ধা তাকে খারাপ বলতে পারবে না। তাহলে কেন তাকে হত্যা করা হলো? অনেকে মনে করে স্থানীয় নেতৃত্ব আর প্রতিহিংসার কারনে এমন নারকীয় ঘটনা সংগঠিত হয়েছিল। এম আই চৌধুরীকে হত্যার সাথে জড়িতরা কখনোই তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে দেয় নাই। কিন্তু কেন? ভারতীয় প্রশিক্ষন নেওয়া মুক্তিযুদ্ধের গ্রুপ কমান্ডার যিনি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুনামের সাথে যুদ্ধ করলেন, তিনি কেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হলোনা? চাটমোহর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাথে যেনারা জড়িত ছিলেন বা আছেন তারা কি জবাব দিবেন?
আশাকরি চাটমোহর উপজেলা প্রশাসন, পাবনা জেলা প্রশাসন এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয় বিষয়টি দেখবেন।
( সমাপ্ত)
লেখক পরিচিতি -
আমিরুল ইসলাম রাঙা
( মুক্তিযুদ্ধে এক নগন্য যোদ্ধা)
প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সভাপতি
আটঘরিয়া প্রেসক্লাব, পাবনা।
৬ জুলাই ২০১৯