এরশাদনামাঃ যেন ভুলে না যাই
সৈকত রুশদীঃ
প্রত্যেক মানুষের ভালো ও মন্দ দিক আছে।
সদ্য প্রয়াত সাবেক স্বৈরশাসক লে.জে.হো.মো. এরশাদ একটি নির্বাচিত সরকারকে বেআইনীভাবে হটিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছিলেন (২৪ মার্চ ১৯৮২) সংবিধান লংঘন করে।
ক্ষমতায় টিকে থাকতে পুলিশকে দিয়ে গুলি চালিয়ে গণতন্ত্রকামী মানুষ হত্যা করিয়েছেন।
রক্ত ঝরিয়েছেন মানুষের জীবন, পরিবার ও সমাজে। অগণন মানুষের অসহনীয় কষ্টের কারণ হয়েছেন।
বিচার হয়নি জেনারেল মনজুর বীর উত্তম ও মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা, তাজুল, নূর হোসেন ও ডাঃ মিলন সহ গণতন্ত্রকামী বহু মানুষ হত্যায় তাঁর ভূমিকার।
আগের রাতে স্বপ্নে দেখে সেই মসজিদে যাওয়ার মতো মিথ্যাচার করেছেন পূর্ব নির্ধারিত পবিত্র মসজিদে দাঁড়িয়ে, অবলীলাক্রমে!
রাষ্ট্রের শীর্ষ ক্ষমতা দখলের আগে ও পদে থাকা অবস্থায় একাধিক পরকীয়া সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছেন। দাবি করা প্রথম সন্তানের জন্ম নিয়ে মিথ্যাচার করেছেন।
রক্ষিতাকে নিয়ে হজ্জ্বে যাওয়ার মতো ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। রাষ্ট্রের অর্থে।
ভালো কাজও আছে। যমুনা বহুমুখী সেতুতে রেললাইন বসানোর জন্য অবদান রেখেছেন। জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ সম্পন্ন ও মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছেন। রাষ্ট্রের অর্থে।
প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণে অগ্রণী ও কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন।
সরকার প্রধান হিসেবে ক্রমাগত সংবিধান লংঘন, ঘুষ, কমিশন ও দুর্নীতি, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা ও শাসন পদ্ধতিকে কলুষিত করা এবং লাম্পট্যকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে অগ্রদূত তিনিই।
রাষ্ট্র কোনো প্রাণী না হলেও চরিত্রহীন ব্যক্তি তার জন্য ধর্মীয় পরিচয়ের তকমা লাগিয়ে ও শুক্রবারকে ছুটির দিন ঘোষণা করেছেন।
সেটি যতোটা না ইসলাম ধর্মের সেবক হতে চেয়ে তার চেয়েও বেশি জনগণের ঘৃণা প্রশমিত করতে গরিষ্ঠ মুসলমান নাগরিকের ধর্মবোধকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে।
প্রভু কৃষ্ণের জন্মদিনে জন্মাষ্টমীতে সরকারী ছুটি ঘোষণা করে একই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সামনে রেখে হিন্দু ধর্মেরও সেবক হতে চেয়েছেন তিনিই!
নিজে ক্ষমতায় টিকে থাকতে বাংলাদেশকে ভারতের তাঁবেদার রাষ্ট্র বানানোর প্রথম পদক্ষেপ তাঁরই। দেশের স্বার্থের বিপক্ষে বেআইনী ও অনৈতিক সুযোগ দিয়েছেন ভারতকে তিনি।
এসবই তাঁর ক্ষমতায় থাকাকালে দেশবিরোধী ও গণবিরোধী পদক্ষেপের কিয়দংশ।
ক্ষমতা থেকে পতনের পর (৬ ডিসেম্বর ১৯৯০) যে ২৯ বছর বেঁচে ছিলেন তার পুরোটা সময় দেশের গণতন্ত্র ও রাজনীতিকে কলুষিত করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অন্যতম।
মিথ্যাচারে ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গে বাংলাদেশে প্রায় তুলনাহীন শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক তিনিই!
ঊনিশশ’ একাত্তরে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেননি এরশাদ। চাকুরী করেছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। জানা যায়, পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী বাঙালি সৈন্যদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালে বিচারকের দায়িত্বও পালন করেছেন নিষ্ঠার সাথে!
ভারতের কুচবিহারে জন্ম নেওয়া সাবেক সেনা প্রধান, সামরিক শাসক, রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারের বিশেষ দূত এবং জাতীয় সংসদ সদস্য ও গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা এরশাদের ঊননব্বই বছরের জীবনের অবসান হয়েছে আজ (১৪ জুলাই ২০১৯) বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়।
মানুষের অনিবার্য পরিণতি যে মৃত্যু, ক্ষমতায় থাকাকালে মনে থাকেনা স্বৈরশাসক ও শাসকদের, কিছু অমানুষের!
দিনশেষে মানুষকে মূল্যায়ন করা হয় ভালো কাজ বনাম খারাপ কাজের পাল্লায়।
জীবনকাল শেষেও সেই একই পাল্লায় মাপা হবে। সকল মানুষকে। রোজ হাশরের দিনে।
টরন্টো
১৪ জুলাই ২০১৯
চিত্র পরিচিতিঃ স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অংশ হিসেবে জাতীয় কবিতা পরিষদ সূচনা করে ‘জাতীয় কবিতা উৎসব’। এর দ্বিতীয় আসরের মঞ্চে বসে ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে’ শীর্ষক এই ব্যঙ্গচিত্রটি আঁকা শেষ করেই মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন আজন্ম প্রতিবাদী শিল্পী কামরুল হাসান, ২ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৮। [সংগৃহীত]