ডেঙ্গুর ঝুঁকি সম্ভাবনা আছে অক্টোবর পর্যন্ত
পক্ষকাল সংবাদ-
রাজধানীতে বেড়েছে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ। ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের উল্লেখযোগ্য অংশই শিশু। ঢাকা শিশু হাসপাতাল থেকে গতকাল তোলা। ছবি: সামসুল হায়দার বাদশা
টানা চার দিন রেকর্ড পরিমাণ বাড়ার পর গতকাল একটু কমলেও আগামী অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর ঝুঁকি রয়েছে। তাই ক্রাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে দ্রুত অ্যাডিস মশা নির্মূল করা জরুরি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মশা নিধন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ৩৯০ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন। ২২ জুলাই রোগীর সংখ্যা ৩১৯ জন থাকলেও এরপর যথাক্রমে ৪০৮, ৪৭৩, ৫৬০ ও ৫৩৬ জনে দাঁড়ায়। বেড খালি না থাকায় কিছু বেসরকারি হাসপাতাল ডেঙ্গু রোগী ভর্তি বন্ধ রেখেছে। তবে সরকারিভাবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে দুটি বিশেষায়িত হাসপাতাল। এদিকে, চীনের গুয়াংঝু শহর এলাকায় ডেঙ্গু জ্বর মহামারি আকার ধারণ করেছিল। তাই চীনের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, অ্যাডিস মশা ধ্বংস করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সরকার এডিস মশার বংশ বিস্তারের উৎসস্থল ধ্বংসে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে সফল হয়েছে। গুয়াংঝু শহরে এখন ডেঙ্গু জ্বর নেই বললেই চলে। এই ব্যবস্থাই বাংলাদেশকে নিতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
রাজধানীতে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ডা. তানিয়া সুলতানা (২৮) নামে আরো এক নারী চিকিৎসক মারা গেছেন। বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় ধানমন্ডিতে বেসরকারি আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) চিকিত্সাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তানিয়া সুলতানা গত ২২ জুলাই থেকে জ্বরে ভুগছিলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। ২৪ জুলাই তাকে রাজধানীর মগবাজারে কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে বৃহস্পতিবার তাকে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাক্তার আব্দুল কাহার আকন্দের অধীনে ভর্তি করা হয়। মৃত তানিয়া সুলতানা সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের ৪৭ ব্যাচের ছাত্রী ছিলেন। সরকারি হিসেবে এ নিয়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তিন জন চিকিৎসক ও এক জন নার্সসহ ১০ জন মারা গেছেন। এর আগে রাজধানীর উত্তরায় বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ডা. নিগার নাহিদ দিপু নামে একজন নারী চিকিত্সক ও গত কয়েক দিন আগে হবিগঞ্জ জেলার সিভিল সার্জন ডা. শাহাদাত হোসেন হাজরা মারা যান।
প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ জানান, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে মশা মারার বিকল্প নেই। আর সিরিয়াস না হলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ারও কোনো প্রয়োজন নেই। জ্বর হলে প্রথমে প্লাটিলেট পরীক্ষা করাতে হবে। শরীরে কোথাও রক্তক্ষরণ হচ্ছে কি না দেখতে হবে। রক্তক্ষরণ না হলে, প্লাটিলেট খুব বেশি না কমে এলে রোগী বাসায় থেকে নিয়ম মেনে চললে কোনো অসুবিধা হবে না।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৯০ জন ডেঙ্গু রোগী সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৩৬ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৮ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ২২ জন, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৯ জন, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ৩৭ জন, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৪১ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১১০ জন। এছাড়া, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৩ জন ও খুলনা বিভাগে ২ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
ডেঙ্গু আতঙ্ক দেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কোনো কোনো পরিবারের একাধিক সদস্য ডেঙ্গু আক্রান্ত। বেশির ভাগ হাসপাতালে পা ফেলার জায়গা নেই। নির্ধারিত বেড ছাড়িয়ে ফ্লোরে, বারান্দায়, লিফটের পাশে, বাথরুমের দরজার সামনে—যে যেখানে পারছে সেখানেই বিছানা পেতে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিচ্ছে। রোগীর ঢল সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরাও। চিকিৎসকরা বলছেন, হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। কিন্তু সে পরিমাণে নেই ডাক্তার বা নার্সের সংখ্যা। ফলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে রোগী থেকে শুরু করে চিকিৎসকসহ সবারই। ইতিমধ্যে কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল সিট খালি নেই উল্লেখ করে রোগী ভর্তি বন্ধ বলে নোটিশ টানিয়ে দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, এখন সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে ডেঙ্গু রোগীর সেবা দিতে হবে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাইডলাইন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়া আছে। কেউ চিকিত্সা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে আগামীকাল রবিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মনিটরিং টিম মাঠে কাজ শুরু করবে। তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের জন্য প্রয়োজনে ১ হাজার বেডের দুটি বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। হাসপাতাল দুটি হলো, চানখারপুলে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ও মহাখালীতে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট।
ডেঙ্গু নির্মূলে চীনের সফলতা
ডেঙ্গু নির্মূল করতে হলে অ্যাডিস মশা ধ্বংস করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সফলতা দেখিয়েছে চীন। মাত্র দুই বছরে চীনের শহর গুয়াংঝুর দুটি দ্বীপপুঞ্জ থেকে এই মশা প্রায় নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি দ্য ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধে এই সাফল্যের কথা উঠে এসেছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, দুটি বিদ্যমান পদ্ধতির সমন্বয় করে সেখানে এশিয়ান টাইগার নামে পরিচিত এই মশার পরিমাণ ৯৪ শতাংশ কমিয়ে আনা হয়েছে। ন্যাচারে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়, বিগত দুই দশকে রোগবাহী এসব মশা নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। এতে মশার বংশ বৃদ্ধি রোধ এবং তাদের রোগ ছড়ানোর ক্ষমতা হ্রাসেরই মূল চেষ্টা ছিল। তবে নতুন গবেষণায় ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে।
গবেষণা দলের প্রধান ও জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের মশার বাস্তুসংস্থান-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ পিটার আর্মব্রাস্টার বলেন, তাদের গবেষণার ফলাফলে মশা ধ্বংস করতে এবং মশা সংক্রমিত রোগ নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী উপায় পাওয়া গেছে। তিনি জানান, নতুন পদ্ধতিতে দুই স্তরের পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়।